বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

মেয়েরা আত্মহত্যা করছে

তসলিমা নাসরিন

মেয়েরা আত্মহত্যা করছে

পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পুরুষদের সঙ্গে প্রেম করলে মেয়েদের দুঃখ-কষ্টে ভুগতে হয়। তারপরও মেয়েরা এদেরই প্রেমে পড়ে। এ ছাড়া উপায় নেই। উপায় নেই কারণ চারদিকে এরাই বাস করে। ঘরে বাইরে এরাই। জন্মের পর মেয়েরা এদেরই দেখে, কৈশোরে পৌঁছে এদেরই, যৌবনে পা দিয়ে এদেরই স্পর্শ করতে হয়। এরা যেমন চায়, তেমন করেই মেয়েরা নিজেকে গড়ে তোলে। তারপরও মেয়েদের অপমান আর অবহেলা সয়ে সয়ে বাঁচতে হয়। মেয়েরা যতবার আত্মহত্যা করে ততবার প্রমাণ করে তাদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। পুরুষেরা যে আত্মহত্যা করে না তা নয়। করে। আসলে সভ্য দেশগুলোতে নারীর চেয়ে পুরুষেরাই বেশি আত্মহত্যা করে। তবে বেশির ভাগই করে মানসিক সমস্যার কারণে। নারীর প্রেমে উন্মাদ হয়ে আত্মহত্যা পুরুষেরা খুব একটা করে না। প্রেমিকা বা স্ত্রী প্রেম ঠিকঠাক দিতে না পারলে বরং পুরুষেরা তাদের হত্যা করে। প্রেমের ক্ষেত্রে আত্মহত্যাটা মেয়েদের জন্য বাঁধা।

প্রেমে পড়লেই মেয়েরা বড় দুর্বল, বড় ক্ষুদ্র, বড় মূল্যহীন, বড় অকিঞ্চিৎকর, বড় অপ্রতিভ, বড় অবলা, বড় অসহায় হয়ে ওঠে। আত্মসম্মানবোধ লোপ পায়। পুরুষকে ভালোবাসা মানে পুরুষের জন্য নারীর জীবন উৎসর্গ করা। নারীকে ভালোবাসা মানে নারীকে নিরাপত্তা দেওয়ার নামে পুরুষ দেখভাল করবে, খবরদারি করবে। এ আর যাই হোক, প্রেম নয়। প্রেমের সংজ্ঞা নতুন করে রচনা করতে হবে মেয়েদেরই। অবশ্য মেয়েরা পাল্টালেই তো সমাজ পাল্টাবে না, পুরুষরা যতক্ষণ না পাল্টাবে, পুরুষতন্ত্রের ওপর আঘাত যতক্ষণ তারা না করবে, ততদিন পুরুষতন্ত্র রচিত প্রেমের সংজ্ঞাও ঠিক এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে।

পুরুষেরা তো পুরুষের জন্য নারীর প্রেম ঠিক কী রকম হওয়া চাই তা বলেই দিয়েছে। বলেই দিয়েছে যে পুরুষহীন নারীর জীবন মূল্যহীন। তাই পুরুষের মৃত্যু হলে নারীকেও মৃত্যুবরণ করতে হবে। সতীদাহ প্রথাই তো বড় উদাহরণ। যে নারী মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে নারী সতী, অর্থাৎ সে নারী পুরুষকে সত্যিকার ভালোবাসে।

সতীদাহ প্রথা ব্রিটিশ রাজ নিষিদ্ধ করেছে বটে, তবে কী করে নারী তার পুরুষকে ভালোবাসবে, সেটি কিন্তু এখনো পুরুষের মনে ও মস্তিষ্কে একইভাবে গেঁথে আছে। নারীও সংক্রমিত হয় প্রেমের পুরুষতান্ত্রিক সংজ্ঞায়। সতীদাহর চর্চা সমাজে আগের মতো নেই বটে, তবে আগুন এখনো আছে, যে আগুনে নারীরা জেনে বা না-জেনে আজও পুড়ছে। এখনো সমাজ সেই নারীকে সতী বলে, আদর্শ নারী বলে, যে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে পুরুষের স্বার্থরক্ষা করে, যে নারী নিজের সাধআহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে পুরুষের সাধআহ্লাদ মেটায়, যে নারী পুরুষের সংসারে পুরুষের আদেশ নিষেধ মান্য করে এক ধরনের দাসীবৃত্তি করে। পুরুষের জন্য নারী নিজের জীবন উৎসর্গ করে। এও একধরনের আত্মহত্যা। পুরুষের অবহেলা পেলে জীবন অর্থহীন হয়ে যায় সেসব নারীর, আত্মহত্যা করতে তাদের বাধে না। সতীদাহর আগুন আজকাল চোখে দেখা যায় না। তবে গভীর করে দেখলে যে কেউ বুঝবে, সেই প্রাচীনকালের সতীদাহের চর্চাই চলছে ঘরে ঘরে। মেয়েরা কেন যে ভুলে যায় তারা একটা অসভ্য অশিক্ষিত নারীবিদ্বেষী সমাজে বাস করছে! ভালো মেয়েদের, বুদ্ধিমতী মেয়েদের, মেরুদণ্ড সোজা করে চলা মেয়েদের এই নষ্ট সমাজ নানাভাবে নানা কায়দায় অপমান করে, অপদস্থ করে, গালি দেয়, চরিত্র নিয়ে কুকথা বলে। যে মেয়েদের এসব করা হয় না, যে মেয়েদের ‘ভালো মেয়ে’ বলা হয়, তারা আসলে মাথামোটা, গবেট, নির্বোধ, আত্মবিশ্বাস নেই, মানসম্মানের ছিটোফোঁটা নেই এমন মেয়ে। যে মেয়েরা বাধা পায়, গালি খায়, তারাই সত্যিকার হীরা। তারা বিচলিত হলে চলবে কেন! আত্মহত্যা করলে চলবে কেন! নারীবিদ্বেষী সমাজটাকে তুমুল অবজ্ঞা করা শিখতে হবে।

কাউকে পরোয়া না করে নিন্দুকের মুখে থুথু দিয়ে যা ভালো মনে হয়, যা ইচ্ছে করে, তাই করা শিখতে হবে। পুরুষেরা তো মেয়েদের ধর্ষণ করে করে, নির্যাতন করে করে মেরেই ফেলছে। প্রতিদিন মারছে। মেয়েরা নিজেদের মারবে কেন? মেয়েরা যখন আত্মহত্যা করে, নিজের অজান্তে তারা তখন পুরুষ হয়ে যায়। পুরুষ যেমন করে মেয়েদের ঘৃণা করে, তেমন করে মেয়েরা নিজেদের ঘৃণা করে, পুরুষ যেভাবে মেয়েদের হত্যা করে, সেভাবে মেয়েরাও নিজেদের হত্যা করে।

মেয়েদের পুরুষ হলে চলবে না। মেয়েদের মেয়ে হয়ে থাকতে হবে। মেয়েরা মেয়ে হয়ে থাকলে আত্মহত্যা করা বন্ধ করবে। মেয়েরা মেয়ে হয়ে থাকলে মেয়েদের ঘৃণা করা বন্ধ করবে। মেয়েরা মেয়ে হয়ে থাকলে পুরুষেরা মেয়েদের রূপের এবং গুণের যে সংজ্ঞা তৈরি করেছে তা মানবে না, বরং সংজ্ঞাটা তারা নিজেরাই তৈরি করবে। মেয়েদের পুরুষ হওয়া মানে পুরুষের পোশাক পরে, পুরুষের মতো পেশা গ্রহণ করে পুরুষ হওয়া নয়। মানসিকতায় পুরুষ হওয়া। পিতৃতন্ত্র সব পুরুষকে যে মানসিকতায় গড়েছে, সেই মানসিকতাকে অস্বীকার করাই হলো পুরুষ হওয়াকে অস্বীকার করা। এই কাজটি যতক্ষণ পর্যন্ত না করবে মেয়েরা, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা পুরুষের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতাকেই ভাগ করে নেবে। ভাগ করে নেয় বলেই পুরুষের সঙ্গে জোট বেঁধে মেয়েরাও মেয়েদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। পুরুষরা তাদের এই মানসিকতারই সুষম বণ্টন চায়, অন্য কোনো কিছু- বিয়ে, তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার- এসব সমানভাবে ভাগ করতে চায় না। তাদের আরও হাজারো অধিকারকে, হাজারো স্বাধীনতাকে কারও সঙ্গে ভাগ করতে তারা নারাজ। তারা যে চোখে মেয়েদের দেখে, মেয়েদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরে, মেয়েদের গালি দেয়, যেভাবে মেয়েদের ঘরবন্দী করে, অথবা মেয়েদের ঘরবার করে, সেভাবে মেয়েদেরও বলা হয় করতে, সেভাবে মেয়েরাও করে। যেভাবে মেয়েদের মরে যাওয়ার প্রত্যাশা করে, যেভাবে মারে, সেভাবেই মেয়েরা নিজেদের মারে, এবং নিজেরা মরে। আজও পিতৃতন্ত্র টিকে আছে পৃথিবীতে শুধু পুরুষেরা একে টিকিয়ে রাখছে বলে নয়, নির্বোধ মেয়েরা একে টিকিয়ে রাখছে বলেও।

মেয়েরা ঘরে ঘরে অপমান আর অবহেলা সয়ে বেঁচে থাকছে। কেউ সইতে না পারলে আত্মহত্যা করছে। মেয়েদের আত্মহত্যার পেছনে যদি কেউ থাকে, সে পুরুষ। আবার এই পুরুষই মেয়েদের কিন্তু সুখ দিচ্ছে। অনেক মেয়েই অবশ্য দুঃখকেও সুখ বলে ভেবে নেয়। অসম সম্পর্কে প্রেম হয় না, প্রভু আর দাসীর মধ্যে প্রেম হতে পারে না।

পুরুষ অত্যাচারিত হলে সর্বস্তরের নারী পুরুষ এগিয়ে আসে। নারী অত্যাচারিত হলে শুধু মানবাধিকার কর্মী আর নারীবাদীরাই এগিয়ে আসে। কারণ নারীর ওপর অত্যাচারকে এখনো, আজো, সমাজের বড় কোনো সমস্যা বলে বিবেচনা করা হয় না। যতদিন না হবে, ততদিন নারীরা আত্মহত্যা করবে, ততদিন আমরা আত্মহত্যার খবর পাব, প্রতিবাদ করব এবং আমাদের প্রতিবাদে কারও কিছু যাবে আসবে না।

            লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর