বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

নামাজ ফরজ হলো যেভাবে

মুফতি হেলাল উদ্দীন হাবিবী

নামাজ ফরজ হলো যেভাবে

নবুয়তের দশম বছরে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে সংঘটিত হয়েছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা; যা অনন্তকাল ইতিহাসের পাতায় ‘মেরাজ নামে’ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে ঘটে যাওয়া অসংখ্য অলৌকিক ঘটনাবলির মধ্যে সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, গৌরবোজ্জ্বল ও চমকপ্রদ হলো এই মেরাজ ভ্রমণ। এ রাতে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বন্ধু হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরশে আজিমে নিজ সান্নিধ্যে নিয়ে স্বীয় দিদার দানের মাধ্যমে বিরল সম্মাননা প্রদান করেন।

বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘বোরাক’ নামক এক বিশেষ যানে আরোহণ করে মক্কার মাসজিদুল হারাম থেকে প্রায় দেড় হাজার মাইল দূরে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে উপস্থিত হন। অতঃপর সেখান থেকে তিনি এবং তাঁর বোরাকসহ এক অলৌকিক সিঁড়ির মাধ্যমে ঊর্ধ্বালোকে গমন করেন এবং পর্যায়ক্রমে প্রথম আসমান থেকে সপ্ত আসমান অতিক্রম করে বায়তুল মামুরে যান। সেখান থেকে সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে পৌঁছেন। এরপর তিনি একাকী ‘রফরফ’ নামক বিশেষ বাহনে আরোহণ করে আল্লাহতায়ালার একান্ত সান্নিধ্যে মিলিত হন। ইস্রা শব্দের অর্থ নৈশভ্রমণ, আর মেরাজের শাব্দিক অর্থ সোপান, ঊর্ধ্বারোহণ ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত এ সফরকে ইস্রা এবং বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে আরশে আজিম পর্যন্ত সফরকে মেরাজ বলা হয়। আল কোরআনে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বন্ধু হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ সফর প্রসঙ্গে বলেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি বরকতময় করেছিলাম, যাতে আমি তাকে আমার কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-০১। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, রজবের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচাতো বোন উম্মে হানি বিনতে আবু তালিবের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। (অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি হাতিমে কাবায় ছিলেন) এ সময় হজরত জিবরাইল ও মিকাইল (আ.) এসে তাঁকে নিয়ে বায়তুল্লাহর কাছে হাতিমের ভিতরে যান। সেখানে তাঁর বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ করে কলব বের করে একটি জান্নাতি সোনার প্লেটে রাখলেন এবং তাঁকে জমজম কূপের পানি দ্বারা ধুয়ে আবার জোড়া লাগিয়ে দিলেন। এ ঘটনাকে ‘শাক্কুস সদর’ বা বক্ষ বিদারণ বলে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনে তিনবার বক্ষ বিদারণ হয়েছিল।

অতঃপর তিনি বোরাক নামক ঐশী বাহনে আরোহণ করে বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে সব নবীর উপস্থিতিতে দুই রাকাত নামাজের ইমামতি করেন। এরপর তিনি এক অলৌকিক জান্নাতি সিঁড়ির মাধ্যমে ঊর্ধ্বারোহণ শুরু করেন এবং একের পর এক আসমান অতিক্রম করতে থাকেন। প্রতিটি আসমানে অগণন ফেরেশতা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। প্রথম আসমানে হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হজরত ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদরিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.) এবং সপ্তম আসমানে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এরপর তিনি সিদরাতুল মুনতাহা গমন করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন রঙের ও সোনার প্রজাপতি উড়তে দেখেন এবং হজরত জিবরাইল (আ.)-কে স্বরূপে দেখতে পান। অতঃপর তিনি একটি দিগন্তবেষ্টিত সবুজ রঙের গদিবিশিষ্ট পালকি ‘রফরফ’ নামক বাহনে চড়ে ৭০ হাজার নূরের পর্দা পেরিয়ে আরশে আজিম পর্যন্ত পৌঁছে যান এবং মহান প্রভুর একান্ত সাক্ষাতে মিলিত হন। আল্লাহতায়ালা এ সম্পর্কে কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর সে কাছে এলো এবং ঝুঁকে গেল। এমনকি দুই ধনুকের দূরত্ব পরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি কাছে এসে গেল। এভাবে তিনি নিজ বান্দার প্রতি যে ওহি নাজিল করার ছিল তা নাজিল করলেন। সে যা দেখেছে তার অন্তর তাতে কোনো ভুল করেনি। তবু কি তোমরা বাগ্বিতণ্ডা করবে? সে যা দেখেছে তা নিয়ে।’ সূরা নাজম, আয়াত ৮-১২। হজরত মালিক ইবনে সাসায়া (রা.) থেকে বর্ণিত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেরাজের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমি হাতিমে কাবায় ছিলাম। আমার কাছে এক আগমনকারী এলেন। এরপর আমার বক্ষ বিদীর্ণ করলেন এবং আমার কলব বের করলেন। আমার কাছে একটি সোনার প্লেট নিয়ে এলেন, যা ইমান দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। অতঃপর জমজমের পানি দ্বারা আমার কলবকে ধুইলেন এবং আমার কলব ইমান ও হিকমত দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেওয়া হলো। অতঃপর আমার কাছে একটি সাদা প্রাণীর বাহন আনা হলো, যা খচ্চর থেকে ছোট এবং গাধা থেকে কিছুটা বড়। যেটাকে বোরাক বলা হয়, যেটি দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে তার কদম রাখে। এর ওপর আমাকে আরোহণ করানো হলো। আমার সঙ্গে জিবরাইল ছিলেন। আমরা দুনিয়ার আকাশের দিকে উঠতে থাকলাম।’ বুখারি, মুসলিম। এ সফরে তাকে জান্নাতের অনাবিল সুখ-শান্তি ও জাহান্নামের কঠোর শাস্তি দেখানো হয়। অতঃপর সফর থেকে ফিরে আসার সময় মহান আল্লাহতায়ালা অনুগ্রহ করে মেরাজের উপহারস্বরূপ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের প্রতি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করলেন। আর এর দ্বারা নামাজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। কেননা অন্যান্য ইবাদত ফরজ করা হয়েছে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিবরাইল (আ.)-কে পাঠানোর মাধ্যমে। আর নামাজ ফরজ হয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরশে আজিমে ডেকে নিয়ে মহান স্রষ্টার দিদারের মাধ্যমে। তাই তো বলা হয়, মুমিনের মেরাজ হলো নামাজ।

লেখক : খতিব, মাসজিদুল কোরআন জামে মসজিদ কাজলা, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।

  Email: [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর