রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

রুয়ান্ডার গণতান্ত্রিক স্টাইল আমি কি বাংলাদেশি

নঈম নিজাম

রুয়ান্ডার গণতান্ত্রিক স্টাইল আমি কি বাংলাদেশি

জিও আছে কি আপনার? জবাবে বললাম, আমি সরকারি কর্মকর্তা নই। তাই জিও নেই। দরকারও নেই। এবার ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা আবার কথা বললেন। এর মাঝে পাশের জনের কাছে জানতে চাইলেন, রুয়ান্ডার ভিসা পদ্ধতি কী? পাশের জন বললেন, দরকার নেই। অন অ্যারাইভাল। অবস্থা দেখে বুঝলাম ইমিগ্রেশনে তিনি নতুন। বুঝতে একটু সময় লাগবে। আমি বললাম, দিল্লির রুয়ান্ডা দূতাবাস একটি ছাড়পত্র পাঠিয়েছে। এর ফটোকপি আছে। যদিও অন অ্যারাইভাল দেশের জন্য এ ছাড়পত্রের দরকার নেই। এবার কর্মকর্তা কথা বাড়ালেন না। সিল দিলেন। এর আগেও আমার এমন হয়েছে। একবার দিল্লি যাচ্ছিলাম, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা জানতে চান জিও আছে কি? বললাম নেই। সময় নষ্ট করছিলেন কর্মকর্তা। পরে ওপর লেভেলের এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ফোন করতে হয়েছিল। তিনি বুঝিয়ে বলেন, কার জিও দরকার আর কার নেই। এভাবেই শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দর অতিক্রম করি ২৪ মার্চ। দীর্ঘ পথযাত্রা ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল হয়ে রুয়ান্ডা। সেখান থেকে আমেরিকা। কী কারণে এবার পথে পথে ঝামেলা হয়েছে।  কথায় আছে, একবার ঝামেলা শুরু হলে চলতেই থাকে। আমারও হয়েছে তাই। সময়সূচি বজায় রাখতে টার্কিশ এয়ার বাংলাদেশ বিমানকে হার মানায়। শাহজালাল থেকে নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা পর ছাড়ে ইস্তাম্বুল ফ্লাইট। আবার ইস্তাম্বুল থেকে রুয়ান্ডার কিগালি ফ্লাইটও বিলম্বে ছাড়ে এক ঘণ্টা। কিগালি থেকে ইস্তাম্বুল ফ্লাইটও দেরি হয় এক ঘণ্টা। তবে বোস্টন ফ্লাইট ছিল নির্ধারিত সময়ে। ফেরার দিন নিউইয়র্ক থেকে এক ঘণ্টা ৩০ মিনিট পর ফ্লাইট ছাড়ে। আমি তখনই বুঝি কানেকটিং ফ্লাইটে ঢাকা যেতে সমস্যা হতে পারে। ঢাকার ফ্লাইট লেট না হলে মিস হবে। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। বোর্ডিং কার্ড পকেটে নিয়েই একটা অস্বস্তিতে নিউইয়র্ক ছাড়ি।

ইস্তাম্বুল নেমে দৌড়ে গেলাম গেটের দিকে। গেট ক্লোজড। বোর্ডিং ব্রিজে ঢাকাগামী ফ্লাইটটি তখনো দাঁড়িয়ে। কিন্তু গেটে কেউ নেই। সবাই সবকিছু বন্ধ করে চলে গেছে। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। পাশের একটি কাউন্টারে যেতেই বলল, ওপরে গিয়ে যোগাযোগ কর। টার্কিশ এয়ারলাইনস লাউঞ্জে দায়িত্বরত কর্মীর কাছে জানালাম, ফ্লাইট লেট করলে তোমরা। মিস করলাম আমি। এখন কী করব? জবাবে বলল, একটু অপেক্ষা কর। ঘণ্টাখানেক পর জানাল, তারা আমাকে দুবাই হয়ে ঢাকা পাঠাতে পারে সম্মত থাকলে। অথবা এক দিন ওখানে থেকে ঢাকা ফেরত আসতে পারি। বললাম, সম্মত আছি। তারা বলল, রাত ১২টায় তোমার ফ্লাইট। লাগেজের কী হবে জানতে চাই? জবাবে বলল, লাগেজ সরাসরি ঢাকা যাবে। সমস্যা নেই। নতুন লাগেজ ট্যাগ নম্বর নিলাম।  ইস্তাম্বুল থেকে টার্কিশ এয়ার এরপর আমিরাতে দুবাই হয়ে ঢাকা এলাম। বিমানবন্দরে বেল্টের সামনে দীর্ঘ অপেক্ষার পরও লাগেজ পেলাম না। আমিরাতের কোনো লোকই নেই লাগেজ এলাকায়। তাদের কাছে অভিযোগ করতে পারলাম না। গেলাম বিমানবন্দর অভিযোগ কেন্দ্রে। তাদের বিস্তারিত জানালাম। প্রথমে কেন্দ্রে অবস্থান করা কর্মীটি বলল, আপনার সর্বশেষ ফ্লাইট আমিরাত। তাদের মতামত না নিয়ে অভিযোগ নিতে পারি না। আমি জানতে চাই, আপনি কার জন্য কাজ করেন বাংলাদেশ না আমিরাতের? জবাবে বলল, বাংলাদেশের সরকারি চাকরি। বললাম, আমি সরকারকে ট্যাক্স প্রদানকারী একজন নাগরিক। অভিযোগ নিতে হবে। আমার ফ্লাইটের বিস্তারিত ডকুমেন্টস রাখুন। আমার দিকে তাকাল অভিযোগ কেন্দ্রের ছেলেটি। তারপর কথা বাড়াল না। ক্লান্তি নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হচ্ছি। হাতে ছোট্ট একটি ব্যাগ। সবুজ সীমা অতিক্রম করার সময় কাস্টমস কর্মকর্তা আমার দিকে তাকালেন। তারপর ইংরেজিতে জানতে চাইলেন আমি কোন দেশের নাগরিক? পরিষ্কার বাংলায় বললাম, বাংলাদেশ। এবার কর্মকর্তা বললেন, ডিক্লারেশন কি দেবেন? বললাম, লাগেজ নেই। হারিয়েছে টার্কিশ এয়ার অথবা আমিরাত। সেই লাগেজেও কিছু নেই, ব্যবহার করা গত ১০ দিনের জামাকাপড় আর নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ প্রতিদিনের কপি ছাড়া। সবসময় বাইরে গেলে টুকটাক শার্ট, প্যান্ট কিনি। এবার তাও কেনার সময় পাইনি। নিউইয়র্কে প্রকাশিত পত্রিকায় লাগেজ ঠাসা। কিন্তু সেই লাগেজ আমার কাছে নেই। আর থাকলেও কি ডিক্লেয়ার করব? তার পরও কর্মকর্তা নানা কথা বলতেই থাকেন। বললাম, হ্যান্ড লাগেজ স্ক্যান করুন। তারা তাই করল। এবার বললাম, আমাকে স্ক্যান করুন। পরে গল্প বানাবেন চলবে না। এ সময় যাত্রীদের কয়েকজন এগিয়ে এলেন। তারা বললেন, ভাই, আপনার সঙ্গে এ আচরণ! বুঝুন আমাদের সঙ্গে কী করে? যাত্রীদের কয়েকজন প্রতিবাদও শুরু করেন। এ সময় অন্য সংস্থার লোকজন এগিয়ে আসেন। তারা আমাকে এগিয়ে দেন সামনের দিকে।

মাঝে মাঝে মনটা খারাপ হয়ে যায় এত বছরেও আমরা বিমানবন্দরে নিয়মশৃঙ্খলা ঠিক করতে পারলাম না! ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার না করলেই মানুষকে হয়রানি করে। এ হয়রানি থেকে আমরা যখন নিস্তার পাই না তখন সাধারণ মানুষের অবস্থান কোথায়? অথচ চেষ্টা করলে সবই সম্ভব। মাত্র ২২ বছরে রুয়ান্ডার মতো একটি দেশ ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় উদীয়মান বর্ধনশীল দেশ এখন রুয়ান্ডা। সেই রুয়ান্ডায় এবার আমরা কয়েকজন সাংবাদিক গিয়েছিলাম। একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল এ এক অপার রহস্য। অথচ বেশিদিন আগের কথাও নয়। ১৯৯৩ সালে রুয়ান্ডা ধ্বংসের মুখে পড়ে। প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানার প্লেন বিধ্বস্ত হয় কিগালি বিমানবন্দরে। মিসাইল নিক্ষেপ অথবা গুলি করে নামানো হয়েছিল প্লেনটি। এই প্লেনে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট ছাড়াও ছিলেন বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট এবং বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা। কারা গুলি করে নামিয়েছিল প্লেনটি, তা জানার আগেই শুরু হয়ে যায় ধ্বংসলীলা। কেয়ামত নেমে আসে রুয়ান্ডার জনজীবনে। তুতসি ও হুতু সম্প্রদায় জড়িয়ে পড়ে জাতিগত ভয়াবহ দাঙ্গায়। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মাঝামাঝি নিষ্ঠুর হত্যালীলায় প্রাণ হারায় ৮ লাখের বেশি মানুষ। প্রেসিডেন্ট সমর্থক হুতু বাহিনী হত্যা করতে থাকে তুতসিদের। সরকার সমর্থক রেডিও-টিভিতে ঘোষণা দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। তুতসি অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় হত্যাকাণ্ডে  সরকারি বাহিনীও অংশ নেয়। হত্যার শিকার হন নিরীহ সংখ্যালঘু তুতসিরা। যারা জানতেনও না তাদের অপরাধ কী।

এই জাতিগত বিরোধের একটা ইতিহাস রয়েছে। সেই ইতিহাসের শুরু পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। ১৯১৬ সালে বেলজিয়াম দখল করে নেয় রুয়ান্ডা। নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তারা জাতিগত বিরোধের বীজ বপন করে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের গায়ের রং, ভাষা, সংস্কৃতি একই ছিল। এর মাঝে তুতসিরা ছিল হুতুদের চেয়ে কিছুটা লম্বা ও পাতলা গড়নের। তুতসিদের আদি বাসস্থান ছিল ইথিওপিয়া। বেলজিয়াম রাষ্ট্রক্ষমতা চালানোর সময় এসব বেরিয়ে আসে। বিভাজনের ক্ষমতায় বেলজিয়ানরা প্রথম দিকে হুতুদের প্রাধান্য দিত। পরে অবশ্য তাদের অবস্থান বদল করে। গরুর পরিমাণ বেশি কম নির্ধারণে আলাদা পরিচয়পত্রও বেলজিয়াম সরকার চালু করে। কিন্তু কোনো ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়। ১৯৬২ সালে বেলজিয়ান শাসকরা বিদায় নেয়। স্বাধীনতা লাভ করে দেশটি। তবে তার আগে শিক্ষাদীক্ষায় শেষ ২০ বছরে তুতসিরা এগিয়ে যায় হুতুদের থেকে। শেষ দিকে বেলজিয়ানদের আনুকূল্য পেয়েছিল তুতসিরা। কিন্তু জাতিগত বিরোধ থেকেই যায়।  স্বাধীনতার পর দেশটির ক্ষমতা ফিরে পায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতুরা। এ সময় একাধিক দাঙ্গায় অনেক তুতসি আশপাশের দেশে চলে যায়। সত্তর দশকের শুরুতে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে রুয়ান্ডা। ’৭৩ সালে হুতু সম্প্রদায়ের নেতা জুভেনাল হাবিয়ারিমানা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে সাধারণ মানুষের আস্থা হারান। এই সময়ে কাগামের নেতৃত্বে উগান্ডায় পালিয়ে যাওয়া তুতসিরা একটি ফ্রন্ট গঠন করেন। পালিয়ে যাওয়া তুতসিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে এ ফ্রন্ট কাজ শুরু করে। সে আরেক ইতিহাস। প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর খবরের পর শুরু হয় গণহত্যা। চার্চে আশ্রয় গ্রহণকারীরাও নিস্তার পাননি। সেই সময়ে হুতু সাংবাদিকদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। বেতার-টিভির শীর্ষ কর্মকর্তারা ঘোষণা দিয়ে হত্যালীলায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান তাদের সম্প্রদায়ের সর্বস্তরের লোকজনকে। এভাবে মিডিয়ার নজিরবিহীন নেতিবাচক ভূমিকা কালো অধ্যায় হয়ে আছে আজও। ভয়াবহ এ দাঙ্গায় প্রেসিডেন্টের ন্যাশনাল গার্ড অবস্থান নেয় খুুনিদের পক্ষে। তারা প্রধানমন্ত্রীকেও নিস্তার দেয়নি। হুতু খুনিদের টার্গেট ছিল তুতসিদের চিরতরে শেষ করে দেওয়া। এ কারণে নারী ও শিশুরাও রেহাই পায়নি। প্রতিবেশী হত্যা করেছে আরেক প্রতিবেশীকে। এ অবস্থায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করা হয় দেশটিতে। অন্যদিকে তুতসি বিদ্রোহীরা ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। যুদ্ধ করেই কিগালির নিয়ন্ত্রণ নেয় তুতসির বিদ্রোহীরা। ২০ লাখ হুতু পালিয়ে যায় কঙ্গোতে। ততক্ষণে ৮ লাখ মানুষের জীবন শেষ। নেতা হিসেবে কাগাম রুয়ান্ডায় লাইমলাইটে আসেন। যুদ্ধ শেষে হুতু ও তুতসি সম্প্রদায় যৌথভাবে সরকার গঠন করে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট কাগাম প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান। পরে প্রেসিডেন্ট বিজিংমুংগু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকানোর দায়ে অভিযুক্ত হওয়ায় কাগাম সামনে চলে আসেন। তিনি বর্তমানে সফলভাবে রুয়ান্ডার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে আমি অবতরণ করি কিগালি বিমানবন্দরে। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা জানতে চান আফ্রিকান সিইও সম্মেলনে যোগ দেব কিনা। জবাবে বললাম, হ্যাঁ। হোটেলের কাগজপত্র আর বাংলাদেশে নিযুক্ত রুয়ান্ডার অনারারি কনস্যুলার ইকবাল হোসেন চৌধুরীর দিল্লি দূতাবাস থেকে আনা ছাড়পত্র দিলাম। কর্মকর্তা দ্রুত কাজ শুরু করলেন। বললেন ৩০ ডলার অন অ্যারাইভাল ভিসা ফি দেওয়ার জন্য। দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাসপোর্টে সিল দিলেন। ৩০ ডলারের রসিদ দিলেন। ৫ মিনিটের মধ্যে সব কাজ শেষ করে দেখি লাগেজ বেল্টে ঘুরছে। বিমানবন্দরের চেহারায় পরিবর্তনের ছোঁয়া দেখলাম। আমাদের টিম সদস্য রুয়ান্ডার অনারারি কনস্যুলার ইকবাল হোসেন চৌধুরী ছাড়াও সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল, শ্যামল দত্ত, জ ই মামুন, মুন্নী সাহা, এটিএন বাংলার পরিচালক চন্দন সিনহা, পপুলার ট্রাভেল এজেন্সির ইকবাল, ব্যবসায়ী মনজুরুল, আলমগীর শাহীন, কলকাতার তপনদা, ফ্রান্সের কিটু মজুমদার, ভারতের একলব সিং, গৌরবভাইসহ টিম সদস্যরা এক দিন আগে এসেছেন। বিমানবন্দরে পরিচয় হলো আমস্টারড্যামে বাস করা নাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে। দুজন একসঙ্গে এক গাড়িতে উঠলাম। মধ্যরাতে হোটেলে প্রবেশ করতেই অভ্যর্থনাকারী বললেন, আপনার বন্ধুরা সবাই এতক্ষণ অপেক্ষায় থেকে একটু আগে ঘুমাতে গেছেন, এই নিন চাবি। রুমে ঢুকে গরম পানিতে শাওয়ার নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। বেশিক্ষণ ঘুম হয়নি। সকাল ৮টায় জেগে উঠে সিদ্ধান্ত নিলাম হাঁটতে বের হব। রিসিপশনে জানতে চাইলাম নিরাপত্তা কেমন? হাঁটতে বের হলে সমস্যা নেই তো? তারা বলল, কোনো সমস্যা নেই। তুমি হাঁটতে পারো। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে হোটেলে ফিরলাম। দুই দিনের জন্য আসা। ২৭ তারিখ মধ্যরাতে আমার ফ্লাইট। তাই অল্প সময়ে যতটা সম্ভব জানতে হবে। দেখতে হবে রুয়ান্ডা। সকালে হেঁটে এসে দেখলাম বুলবুল ভাই গল্প করছেন, মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠান ‘আশা’র রুয়ান্ডার দায়িত্বে কর্মরত জামিলের সঙ্গে। পরিচয়ের পর জামিলের সঙ্গে চলে গেলাম তাদের অফিস দেখতে। পথে আলাপে আলাপে জামিল জানালেন, খুব দ্রুত দেশটি বদলে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা খুবই ভালো। রয়েছে আইনের শাসন। সরকারি অফিসে ঘুষ-দুর্নীতি নেই। মানুষ খুশি। দুপুরে টিম সদস্যদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের পর আমরা শহর ঘুরে দেখি। সাধারণ মানুষ আমাদের বাস দেখে হাত নেড়ে অভিবাদন জানায়। আমরা রাস্তায় নেমে চা খেলাম। মানুষজনের সঙ্গে গল্প করলাম।

পরদিন সকালে আমি গণহত্যার স্মৃতি ধরে রাখা জাদুঘর দেখতে যাই। অন্যরা গেছেন সাফারি পার্কে। জাদুঘরে নিষ্ঠুরতার চিহ্নগুলো ধরে রেখেছে তারা। একটি স্থানে দেখলাম দাঙ্গা বন্ধে স্কুলছাত্রদের ঘুরে দাঁড়ানোর চিত্র। হুতুরা একটি স্কুলে প্রবেশ করে তুতসি ছাত্রদের খুঁজতে থাকে। যখনই তুতসি ছাত্রদের আলাদা হতে বলা হলো ছাত্ররা একসঙ্গে উত্তর দেয় এখানে সবাই রুয়ান্ডিয়ান। হুতু, তুতসি বলে কেউ নেই। ছাত্রদের সঙ্গে এ নিয়ে হামলাকারীদের সংঘাত হয়। কিন্তু সেই সংঘাতই আজকের রুয়ান্ডাকে বদলে দিয়েছে। এখন সবাই এক কথা বলছেন, আমাদের এখানে কোনো জাতিগত বিরোধ নেই। আমরা সবাই রুয়ান্ডিয়ান। আমরা দেশকে বদলাতে চাই। উন্নতি-সমৃদ্ধি চাই। শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত, আইনের শাসন চাই। সেজন্য মিলেমিশে কাজ করছি। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত রুয়ান্ডা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। ইউরোপের মতো সাজাচ্ছে আফ্রিকান একটি দেশকে। বাড়িঘর নির্মাণে ইউরোপের ছাপ। রাজনীতির খোঁজ নিতে বিরোধী দল নিয়ে রুয়ান্ডার একজন সরকারি কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করলাম আমরা সাংবাদিকরা। জবাবে সেই কর্মকর্তা বলেন, আমাদের  বিরোধী দলের কী দরকার? বিরোধিতা করার মতো এখানে কিছু নেই। সবকিছু স্বাভাবিক চলছে। সরকার ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। মূল কাজ দুর্নীতিমুক্ত দেশ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সেটা সরকার করেছে। উন্নয়ন হচ্ছে অবাধে। বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। দুই দিনের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাবদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সাড়া দিতে বাধ্য সরকারি প্রতিষ্ঠান। না দিলেই ব্যবস্থা। আইনের শাসনের বরখেলাপ হলেই সরকারি কর্মকর্তাদের খবর আছে। পুলিশি রাষ্ট্র নয় রুয়ান্ডা। পুলিশ জনগণের পাশে থাকে। আর না থাকলেই সরকার কঠোর।

এসব নিয়ে কিগালিতে বসবাস করা বাংলাদেশিরাও জানান, তারা শান্তিতে আছেন। কোনো সমস্যা নেই। সরকারি অফিস বিদেশি বিনিয়োগ পেলেই সহায়তা করে। কোনো ব্যুরোক্র্যাসি নেই। কোনো চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী নেই। এভাবে বদলে যাওয়া নজিরবিহীন। ভাবাই যায় না অতি অল্প সময়ে কী করে একটি দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রুয়ান্ডা এখন বিশ্বে উদাহরণ তৈরি করছে। এ উদাহরণ উন্নয়নের, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন পরিচালনার। একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ কীভাবে বদলাতে পারে তা দেখিয়ে দিয়েছে রুয়ান্ডার অধিবাসীরা। বিশ্বকে তাক লাগিয়ে তারা বলছে, আসো দেখো কী করে উন্নত হতে হয় ধ্বংসস্তূপ থেকে। শেখো। কথা বলা যায় অনেক। কাজ সবাই করতে পারে না। কেউ কেউ করে।

            লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর