রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

সবকিছু এলোমেলো

মাকিদ হায়দার

সবকিছু এলোমেলো

মানুষের এক জীবনে তো সবকিছু সঙ্গী হয় না। সঙ্গী না হলেও ইচ্ছা জেগে থাকে যদি কখনো দেখতে পেতাম। পড়ালেখার জীবনে অনেক রাজা-মহারাজার চোখ ঝলসানো ভবনের ছবি দেখে মনে হয়েছিল, যদি কোনো দিন ওইসব ভবনের গা ছুঁয়ে দেখতে পারতাম তাহলে সেই ইচ্ছা হয়তোবা পূরণ হতো। স্কুল জীবনেই সেসব ইচ্ছার মধ্য দিয়ে আমাদের মতো শিশু-কিশোরদের মননে গেঁথে গিয়েছিল পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের একটি সম্রাট শাজাহানের প্রিয়তমা স্ত্রী বেগম মমতাজ মহলের মৃত্যুর পরে যে ভবনটি সম্রাট তাঁর স্ত্রীর স্মৃতিস্বরূপ ভারতের আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে আগামী দিনের মানুষের জন্য কয়েক শ বছর আগে বানিয়ে- আগামীর মানুষদের জন্য যে সত্য কথাটি তিনি জানিয়ে গিয়েছিলেন আমার বোধে সেটি, প্রিয়তমাকে, আমার মতো আপনারাও মধ্যহৃদেই রাখবেন।

সেই মমতাজ মহলের দর্শনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থী এসে সম্রাট শাজাহানের অমর কীর্তির প্রশংসা করেই ক্ষান্ত হন না, নত মাথায় অনেকেই শাজাহান এবং মমতাজের পাশাপাশি কবরে ফুল দিতে পেরে, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জানান, প্রেমকে, ভালোবাসাকে, চিরতরে জাগ্রত রাখতেই সম্রাটের মহান কীর্তি। সেই মহান কীর্তি দেখতে কয়েক বছর আগে সপরিবারে কলকাতায় গিয়েছিলাম। আমার অনুজ দাউদ হায়দার দীর্ঘদিন পরে সে বছর বার্লিন থেকে বোম্বে এসে, বোম্বের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে কথা বলেছিল। দাউদ হায়দার ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি থেকে নির্বাসিত জীবনযাপন করছে। একটি কবিতা লেখার অপরাধে। ও যখন ভারতে আসে তখন আমরা সপরিবারে প্রথমে গিয়ে আগে উঠতাম শ্রী অন্নদাশঙ্কর রায়ের বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। আমাদের স্বজনরা যে বছর বেশি থাকত সে বছর ওই এলাকার বা  আশপাশের হোটেলে গিয়ে উঠতাম। অগ্রজ জিয়া হায়দার এবং রশীদ হায়দার যখন দাউদের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন ওদের যাত্রায় আমরা যাত্রাসঙ্গী না হয়ে আলাদাভাবে কেউ বাসে, ট্রেনে, প্লেনে যেতাম কলকাতায়। অগ্রজ জিয়া হায়দার মারা যাওয়ার পরে ২০১৪ সালে আমাদের সব স্বজন গিয়েছিলাম কলকাতায়। উঠেছিলাম হোটেলে। আমাদের কলকাতা যাওয়ার সপ্তাহখানেক পরে দাউদ এলো বোম্বে থেকে। জানাল এবার আপনারা সবাই আমার সঙ্গে দিল্লি যাবেন, আগ্রার তাজমহলসহ বৃন্দাবন দেখতে। সেই দলে যুক্ত হলেন ঢাকার শান্তিনগরের পিয়াল চৌধুরী। তিনি তার স্ত্রী, বাচ্চাসহ সঙ্গী হলেন আমাদের যাত্রায়। দিল্লিতে গিয়ে একটি মানসম্পন্ন হোটেলে থেকেছি। পুরাতন দিল্লির সম্রাট আকবরের শাসনামলের এবং পরবর্তীতে যারা ভারতবর্ষ শাসন করেছিলেন, তাদের রুচি, তাদের চিন্তাশক্তির এবং স্থাপত্যকলা দেখে আমার মনে হলো ভারতের সৌভাগ্য ওইসব স্থাপত্যশিল্প যদি না পাকদের হাতে পড়ত তাহলে হয়তো বহুদিন আগেই বিলীন হয়ে যেত। [না, পাক শব্দটি সৈয়দ মুজতবা আলী, লিখেছেন তাঁর বাংলাদেশ গ্রন্থে]। ভারতীয়দের প্রধান সুবিধা, তাদের দেশের রাজস্থান থেকে আগরতলা পর্যন্ত ট্রেনে ভ্রমণ করা যায়। কলকাতায় আমি গেলেই প্রথমই চলে যাই বহরমপুরে। সেখানকার স্থায়ী নিবাসী নাসির আহমদ মাহবুব। যিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিশেষ পারদর্শিতা দেখানোর পরও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষকতার সুযোগ না হওয়ায় অভিমান ভরে তার স্বভূমিতে গিয়ে একটি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক হয়েছিলেন। সেই নাসিরের বাড়িতে গিয়ে দিন কয়েকের জন্য আশ্রয় নিয়েছি। আগে বারকয়েক, গত বছরের শেষ দিকে কলকাতায় গিয়ে উঠেছিলাম দাউদের বন্ধু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রী তৃপ্তি ঘটকের মতিলাল নেহরু রোডের সুসজ্জিত একটি ফ্ল্যাটে। ওখানে গিয়ে কলকাতার বন্ধুদের জানিয়ে দিই আমার উপস্থিতির কথা। একই সঙ্গে বহরমপুরের নাসিরকে এবং আরেক ঘনিষ্ঠজন, ডাক্তার হীরক দাশকে। ডা. দাশ বহরমপুর মেডিকেল কলেজের একটি বিভাগের প্রধান। তিনি যখন ঢাকায় পা রাখেন, তাকে আমি সঙ্গ দিই মহানন্দে। সেই মহানন্দের হাত ধরেই, গত বছরের শেষ দিকে কয়েকটি দিন আশ্রয় পেয়েছিলাম ডা. হীরকের ঘরে। দুঃখের বিষয়, মিসেস হীরক কয়েক বছর আগেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে গিয়েছেন। যাওয়ার আগে একটি মাত্র ছেলে, অরুণাভ দাশকে গিয়েছেন রেখে, ছেলেটি ভবিষ্যতের ডাক্তার। সেদিন ছিল রবিবার, ডাক্তার হীরক তাঁর নতুন গাড়ি নিয়ে আমাকে দেখাতে নিয়ে গেলেন হাজারদুয়ারী, দুয়ারীর দক্ষিণ দিকের বিশাল জাদুঘর। যে জাদুঘরে এখনো বিদ্যমান লর্ড ক্লাইভের যুদ্ধাস্ত্র। ঢাল, তলোয়ার, উপনিবেশের শাসনক্ষমতা, যাদের সাহায্য লর্ড ক্লাইভ নিয়েছিলেন তাদের ব্যবহৃত সামগ্রী। সেখান থেকে গিয়েছিলাম নতুন হীরাঝিলে। প্রতিজনের প্রবেশমূল্য ভারতীয় ১০০ রুপি এবং বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে কয়েকজন লোকের মূর্তি। সেসব মূর্তির মাঝখানে বসে আছেন ঘসেটি বেগম। তার বাঁ পাশে উমিচাঁদ, মীরজাফর, জগৎ-শেঠ, ডান পাশে লর্ড ক্লাইভ এবং সাঙ্গোপাঙ্গরা। মূর্তিগুলোকে দূর থেকে দেখলেই মনে হবে, সজীব মানুষগুলো শলাপরামর্শে নিমগ্ন। ওই নতুন মতিঝিল, হীরাঝিল দুটো মিলিয়ে ছিলাম দীর্ঘক্ষণ। মূর্তিগুলোর চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, ঘসেটি বেগমের কানে কুমন্ত্রণা দিচ্ছে মীরজাফর এবং অন্য বিশ্বাসঘাতকরা।

দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার আগেই দেখতে গেলাম জগৎ-শেঠের বাড়ি, শেঠ ছিলেন বিশাল ধনী। মীরজাফর নবাব সিরাজের আপনজন হওয়া সত্ত্বেও ঘসেটি বেগমের কুমন্ত্রণায় এবং প্রচণ্ড লোভী হওয়ায় লর্ড ক্লাইভ তাকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করেছিলেন। বিকালের দিকে দেখতে গেলাম মীর জাফর আলী খানের বাড়ি। বাড়ির সামনে ঢোকার পথে সম্ভবত ১৭১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত চার গম্বুজওয়ালা গেট। গেটের ডানে-বাঁয়ে প্রহরীদের থাকার ব্যবস্থা। সেই গেট থেকে বেশ অনেকখানি এগিয়ে পশ্চিমে গিয়ে দেখতে পেলাম আরও একটি বিশাল গেট। বাইরে থেকে তালা দেওয়া। মীরজাফরের পঞ্চম অথবা সপ্তম পুরুষরা ওই দোতলা-তিন তলা বাড়িটিতে থাকলেও দর্শনার্থীর প্রবেশ নিষেধ। নিষেধের কারণ স্থানীয় এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি জানালেন, দর্শনার্থীরা সদর গেটে যাওয়ার সময় থু থু ছিটিয়ে ভিজিটিং খাতায় অশ্রাব্য কথা লিখে যান। সেই প্রেক্ষাপটে দর্শনার্থীর প্রবেশ নিষেধ। ডা. হীরকের গাড়িতে এলাম ভাগীরথী নদীর তীরে, পূর্বপাড়ে তিনি গাড়িটি রেখে আমাকে নদী পার করিয়ে নিয়ে গেলেন সিরাজ ও লুৎফার কবর দেখাতে। গিয়ে দেখি প্রচুর বিদেশি দর্শনার্থী। কবর এবং পুরনো বিল্ডিংয়ের যথেষ্ট বয়স হলেও খুব পুরনো বলে মনে হলো না আমার। সারি সারি কবরগুলো যেমন ঢাকার বনানী কবরস্থানে বেগম ফজিলাতুন নেছাসহ সেই কালরাত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনকের পুরো পরিবারের সবাই, একমাত্র শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। মীরজাফর এবং তার সাঙ্গরা নবাব সিরাজ, বেগম সিরাজ ও সিরাজের সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের অধিকাংশেরই কবর ওই গোরস্থানে। গোরস্থানটি এমনভাবে ব্রিটিশরা বানিয়েছে, গোরস্থানের প্রবেশমুখে দাঁড়ালেই দেখা যায় ডানে-বাঁয়ে সারি সারি কবর। নবাব সিরাজের পরিবারকে মীরজাফর এবং তার সাঙ্গরা সিংহাসন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে ভেবেছিলেন যাক, বালাই গেল। যেমন ভেবেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। যিনি একদা ছিলেন বাঙালি জাতির জনকের দক্ষিণহস্ত। অনূরূপভাবে ছিলেন সিরাজের আপন খালাম্মা ঘসেটি বেগম, অতি নিকটজন মীরজাফর। সেই মীরজাফরের কবর দেখতে গেলাম একটি ভাঙাচোরা রাস্তার পাশেই। যে পথিক ওই পথ দিয়ে যাচ্ছেনÑ তিনিই মীরজাফরের কবরের ওপর থু থু ছিটিয়ে যাচ্ছেন। যে কোনো মানুষের কাছে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি মানুষের ঘৃণা। ৩০০-৩৫০ বছর মীরজাফরের মুখে, কবরে মানুষজন ঘৃণায় উগলে দিচ্ছে থু থু। অন্যদিকে সম্রাট শাজাহানের এবং বেগম মমতাজ মহলের কবরে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ফুল দিয়ে সম্মান জানিয়ে চলেছেন বছরের পর বছর। আমরা যারা বাংলাদেশি পর্যটক, তাদের কাছ থেকে তাজমহলে ঢোকার পথে অর্থদণ্ড ভালোই দিতে হলো, অথচ জনপ্রতি বাংলাদেশি পর্যটকের কাছ থেকে যদি ৫০ রুপি নিত, তবে সহনীয় হতো। কেননা, যতটা জানি সার্কভুক্ত দেশের পর্যটকদের জন্য একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দেওয়ার রীতি নাকি শুরু করা হয়েছিল। পরে বোধহয় তা স্থায়িত্ব পায়নি। সপ্তাশ্চর্যের ভিতর একদা ছিল চীন দেশের প্রাচীর। আমি একাধিকবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করলেও চীনে যাইনি। হংকং থেকে সহজেই হয়তো যাওয়া যেত। সেসব সপ্তমাশ্চর্যের কথা আজকাল ভূগোল বইতে লেখা হয় কিনা জানি না। তবে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলার হিন্দু জমিদাররা যেসব দৃষ্টিনন্দন ভবন বানিয়েছিলেন, সেগুলোকে পূর্ব পাকিস্তান সরকার লিজ দিয়েছে। দিয়েছে নিলাম। যেন এই পূর্ববঙ্গে হিন্দু জমিদারদের কোনো নিদর্শন, কোনো শিল্পমণ্ডিত ভবন না থাকে। সে রকম একটি ভবন পাবনা শহরের শীতলাই জমিদারবাড়ি বা ভবনটি। যে ভবনটিতে এসে থাকতেন কবি রবীন্দ্রনাথ। ভবনটি বিশাল। আমার ধারণা, প্রায় ১০০ বিঘার ওপর নির্মিত হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, পাকিস্তান সরকার ভবনটিকে একটি ওষুধ কোম্পানিকে লিজ দেওয়ায় যা হওয়ার তাই হয়েছে। বিশাল মাঠের উত্তর দিকে নতুন ডিজাইনের একটি ভবনের আড়ালে হারিয়ে গেছে মূল ভবনটি। আমি বর্তমান পাবনা জেলা প্রশাসক শিল্প-সাহিত্যের ধারক-বাহক এবং গুণীজন জসিম উদ্দিন আহমদকে অনুরোধ করব, ওই শীতলাই জমিদারবাড়ির যে কক্ষটিতে রবীন্দ্রনাথ থাকতেন সে কক্ষটিতে একটি রবীন্দ্র জাদুঘর করা যেতে পারে এবং প্রবেশমূল্যে ঢুকতে হবে দর্শনার্থীদের। যেমন দিল্লির আগ্রায়, প্রেমিক শাজাহান এবং তাঁর প্রেমিকা বেগম মমতাজের সমাধি দেখতে গেলে দিতে হয় অর্থ। প্রেম দীর্ঘস্থায়ী হোক। দীর্ঘস্থায়ী হোক তাজমহল। তবে প্রেম সর্বকালেই যে প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য সুখ্যাতি এনে দিয়েছে, তা বলা সমীচীন কী অসমীচীন সে বিষয়টিকে কখনই মাথায় নেননি ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের সপ্তম এডওয়ার্ড। তিনি রাজা এবং ইংল্যান্ডের রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে হয়েও সামান্য এক রজকিনির প্রেমে পড়ে মায়া ত্যাগ করেছিলেন রাজসিংহাসনের। লেডি সিমসন এবং সপ্তম এডওয়ার্ড সর্বকালের সব প্রেমিকের কাছে উজ্জ্বলতম উদাহরণ। অন্যদিকে রয়ে গেছেন শাজাহান ও মমতাজ। সব প্রেমের পরিণতিতে আমরা দেখতে পাই হয়তো একটি শুভ বিবাহ। আবার অনেক ছেলে এবং মেয়ে যে কোনো প্রলোভনে উভয়-উভয়কে ভুলে যেতেও দ্বিধাবোধ করে না। প্রেমের কাব্যকাহিনি আমরা গ্রিক ও রোমান মিথলজি পাঠান্তে জেনেছি গ্রিক দেবী ভেনাস ছিলেন প্রেমদেবী। অন্যদিকে ছিলেন আফ্রোদিতি। ওরা দুজনই ছিলেন দেবী। তবে ভারতীয় মিথলজিতে দেবতা মদনের কথা বলা হয়েছে। দেবতা মদন প্রেমিক-প্রেমিকাদের চোখে শর বা তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে প্রেমিক ও প্রেমিকা দুজনকেই অন্ধ করে প্রেমসাগরে সমর্পণ করেন। দীর্ঘদিন প্রেম শেষে বিয়ে হওয়ার বা করার দিনক্ষণ উভয় পক্ষের পিতা-মাতা, স্বজনরা সর্বসম্মত হয়েই আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন তাদের স্বজনদের, বন্ধু-বান্ধবদের। অতি সম্প্রতি আমার এক ধনী বন্ধুর মেয়ের গায়ে হলুদে গিয়ে অবাক হয়েছিলাম। বন্ধুর বারিধারায় দোতলা ভবনটি সাজিয়েছেন আলো দিয়ে...। এবং বিয়ের দিন যে গেট দিয়ে বরযাত্রীরা প্রবেশ করবেন, সেটিকে সাজিয়েছেন আঙ্গুর, আপেল, নাশপাতি, ডালিম, কেনু এবং কালো আঙ্গুর দিয়ে। বাংলাদেশের কোনো ফল সেখানে অনুপস্থিত। ঝলমলে আলোয় মেয়েটির গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন যারা তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেন এবং গৃহকর্তাকে তার অমর কীর্তির জন্য ধন্যবাদ দিলেও আমি দিইনি। মনে মনে ভাবলাম অন্তত কয়েকটি দেশি পেয়ারা থাকলে মন্দ হতো না, কিন্তু না হওয়ার কারণ বন্ধুটির অর্থ-প্রাচুর্যের সংবাদ উপস্থিতির কাছে পৌঁছানো। কৌতুকচ্ছলে বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, খরচ কত হলো। জানালেন কোটিখানেকের ওপর। সবকিছু মিলিয়ে উপস্থিতিদের একজন জানালেন, এত সমারোহের পেছনের কারণটি হলো আপনার বন্ধুকন্যা। প্রায় ১০ বছর প্রেমে নিমগ্ন ছিলেন হবু জামাইয়ের সঙ্গে। দুর্ভাগ্যবশত ১০ বছরের প্রেমের বিয়েটির সমাপ্তি ঘটেছিল বছরখানেকের মাথায়। দুজন দুজনকে তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়ে কে যে কোথায় গেল জানা হয়নি। তবে আমি নিশ্চিত, আমার বন্ধুর বাড়িতে সে রাতে কোনো আলো জ্বলেনি। যেমনটি জ্বলেছিল গায়ে হলুদের দিনে। বাজেনি কোনো বাদ্য। ঝোলানো হয়নি বিদেশি ফুল ও ফল। তবে অনেক পরে জেনেছিলাম অন্য কথা। ছেলেটি দুই নৌকায় পা দিয়েছিল। তিনি নাকি এখন বিদেশে দ্বিতীয় নৌকার মাঝি। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রের ৪১ নম্বর পত্রটির ভাষ্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি জানিয়েছেন, মেয়েদের সঙ্গে যেন জলের বেশি ভাব পরস্পরের যেন একটি সাদৃশ্য এবং সখিত্ব আছেÑ জল এবং মেয়ে উভয়েই বেশ সহজে ছলছল জ্বল জ্বল করতে থাকে, একটা বেশ সহজ গতি, ছন্দ তরঙ্গ এবং সংগীত আছেÑ সব পাত্রেই আপনাকে স্থাপন করতে পারে। দুঃখ-তাপে অল্পে অল্পে শুকিয়ে যেতে পারে। কিন্তু আঘাতে একেবারে জন্মের মতো দুখানা হয়ে ভেঙে যায় না। জানিনে আমার সেই বন্ধুকন্যাটি ভেঙে গিয়েছে কিনা।   

            লেখক : কবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর