সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা
স্মরণ

কাজী আরেফ আহমদ- এগিয়ে চলার প্রেরণা

কাজী সালমা সুলতানা

কাজী আরেফ আহমদ- এগিয়ে চলার প্রেরণা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্র্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে এক নিভৃতচারী প্রেরণার নাম কাজী আরেফ আহমেদ। আজ ৮ এপ্রিল তার ৭৭তম জন্মবাষিকী। নির্মোহ ও নির্লোভ এ ব্যক্তিত্বের রাজনীতিতে পদচারণা শুরু ষাট দশকে সংঘটিত মুসলমান-হিন্দু দাঙ্গা প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকার মাধ্যমে। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জগন্নাথ কলেজে অধ্যয়নকালে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এ দশক ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনার উন্মেষকাল এবং পাকিস্তানি শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংঘটিত হওয়ার সময়। কাজী আরেফ তার ঘনিষ্ঠ দুই সহযোদ্ধা সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গড়ে তোলেন গোপন সংগঠন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’। ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত বাঙালির মুক্তির সনদ ‘ছয় দফা’ এগিয়ে নেওয়া, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, জাতীয় পতাকা রূপায়ণ, ৭০-এর নির্বাচন, জাতীয় সংগীত নির্ধারণ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণাসহ প্রতিটি পর্বেই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে লক্ষ্য পথে এগিয়ে গেছে। এই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত হয়।

স্বাধীন দেশে আত্মপ্রকাশ করা প্রথম রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের অন্যতম উদ্যোক্তা কাজী আরেফ আহমেদ। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে তিনি এ সংগঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন আমৃত্যু। ১৯৭৫-এ নৃশংসভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শাহাদাতবরণের পর আওয়ামী লীগ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগকে সক্রিয় করতে কাজী আরেফ আহমেদ সমমনা দলগুলো নিয়ে গড়ে তোলেন ১০-দলীয় ঐক্যজোট। তিনি রাজনীতিতে সেনাছাউনির হস্তক্ষেপের তীব্র বিরোধী ছিলেন। রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের ক্ষমতাবান করে তোলে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী সামরিক জান্তারা। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম জামায়াতের আমির হিসেবে প্রকাশ্যে আসে। এ সময়ে কাজী আরেফ আহমেদ সমমনা রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক ও সামাজিক দলকে সংগঠিত করে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে তোলেন ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। এ জাতীয় সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে আন্দোলনের একপর্যায়ে গণআদালত গঠন করা হয়। ২৬ মার্চ ১৯৯২, ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার করা হয় এবং দোষী প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসিতে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় হয়। এ আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করতে অসামান্য অবদান রাখে। সেই চেতনাতেই বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় দেখে যেতে পারেননি কাজী আরেফ আহমেদ। মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানী ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে এক জনসভায় প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। জনসভা মঞ্চে কাজী আরেফসহ কয়েকজন জাসদ নেতাও সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হলেও সব অপরাধীর সাজা কার্যকর হয়নি। কয়েকজন এখনো পলাতক রয়েছে।

আজীবন যে নেতা সংগ্রাম করেছেন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে। যে নেতা লড়াই করেছেন মানুষের ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, আইনের শাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে একটি সুখী বাংলাদেশ গড়ে তোলার; সেই নেতাকে জীবন দিতে হলো সন্ত্রাসীদের গুলিতে জনসভার মঞ্চে। তার চেতনায় এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। ৭৭তম জন্মবার্ষিকীতে কাজী আরেফের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

সর্বশেষ খবর