মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

দেশে এখন কোনো রাজনীতি নেই

সৈয়দ বোরহান কবীর

দেশে এখন কোনো রাজনীতি নেই

আজকাল কান পাতলেই নানা কথা শোনা যায়। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কথা। সন্দেহ আর সংশয়ের কথা। আশঙ্কা আর অনিশ্চয়তার কথা। একের পর এক আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে, বিশেষ করে ঢাকায়। পুরো দেশ আগুন আতঙ্কে ভুগছে। সড়কে প্রাণহানি যেন এখন এক নৈমত্তিক ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। প্রতিবাদ, আশ্বাস কিছুই যেন শুনছে না ঘাতক চালকরা। রোজার অনেক আগে থেকেই বাজারে আগুন লেগেছে। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। রাজনীতির মাঠ ফাঁকা। সেখানে আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে বিরোধ ছাড়া আলোচনা করার মতো কোনো খবর নেই। বেগম জিয়ার অসুস্থতা, কিংবা বিএনপির সংসদে যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে মানুষের মধ্যে ন্যূনতম আগ্রহ নেই। সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। ক্রমশ নিজের জগতে গুটিয়ে যাচ্ছি আমরা। আমরা নিজেরা ভালো থাকতে চাই শুধু। চারপাশে কী হচ্ছে এ নিয়ে কারও আগ্রহ নেই। তাও কি আমরা ভালো আছি?

একদিকে উন্নয়নের আওয়াজ। জিডিপি আর দ্রুত ধাবমান অর্থনৈতিক সূচকের হিসাবে তৃপ্তির ঢেকুর। অন্যদিকে, মৃত্যুর মিছিল, কেউ আগুনে, কেউ সড়কে। বাংলাদেশ যেন এক অসুখী দেশ হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। এখন মানুষ অনাহারে মরে না, মরে আগুনে। এখন কার্তিকের মঙ্গা নেই আছে সড়কের মরণথাবা। এর মাঝেই মানুষের দীর্ঘশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসছে প্রশ্ন, দেশ কি ঠিকঠাকভাবে চলছে? সব কিছু ঠিকঠাক তো?

এ নিয়ে ভাববার সময় নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। একমাত্র শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগের সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। যিনি মন্ত্রী, তিনি চান মন্ত্রিত্ব আঁকড়ে রাখতে, প্রধানমন্ত্রীর নেক নজরে থাকতে। যিনি প্রতিমন্ত্রী, তিনি চান কিছু একটা করে মন্ত্রী হতে। যিনি সংসদ সদস্য, তার মতো দুঃখী মানুষ যেন এই পৃথিবীতে নেই। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী না হয়ে তিনি যেন পথের ভিখারি। যারা মন্ত্রী, এমপি কিছুই নন কিন্তু আওয়ামী লীগ করেন; তারা দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ টেন্ডার, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা আর্থিক সুবিধা বাগিয়ে নিতে ভীষণ ব্যস্ত। অন্যরা প্রায় ছিটকে পড়া। আওয়ামী লীগ থেকে তারা প্রায় আমজনতায় পরিণত হয়েছেন। এদের কাজ নেই। দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর এক অংশ তারা। আগে তাও আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের খোঁজখবর নিতেন, এখন সেটাও হয়ে ওঠে না। কদিন আগে আওয়ামী লীগের একজন তৃণমূলের নেতা বলছিলেন, অধিকাংশ মন্ত্রীই তাকে চেনেন না। চিনবে কী করে? যারা মন্ত্রী হয়েছেন, তাদের বেশির ভাগের রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস দীর্ঘ নয়।

এবার আসা যাক, বিএনপি প্রসঙ্গে। বিএনপি এখন এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় দল। ৩০ ডিসেম্বরে নির্বাচনের শক তারা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তারা যেন এক ঘোরের মধ্যে আছে। তারা ভাবতেই পারে না যে, তাদের এরকম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিএনপির সম্ভবত কোনো নেতাই কল্পনা করতে পারেননি, তাদের নেতা বেগম খালেদা জিয়া এতদিন এভাবে জেলে থাকবেন। তাদের কল্পনার সীমার মধ্যেও ছিল না, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তাদের এই দশা হবে। তাই দেশের মানুষের কথা ভাববে কী, বিএনপি এখন নিজেদের নিয়ে ভেবেই কূল-কিনারা পাচ্ছে না। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। সোজা-সাপটা বলা যায়, দেশে এখন কোনো রাজনীতি নেই। না সরকারি দলে, না বিরোধী দলে। রাজনীতি শূন্য এই দেশে তাই আর ভোটউৎসব হয় না। উপজেলা নির্বাচনে ভোটার বিমুখতা, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকেই লজ্জায় ফেলেছে। একটা দেশে যখন রাজনীতি থাকে না, তখন দেশ চলে যায় আমলা আর প্রশাসনের হাতে। আমলারাই এখন দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তায় পরিণত হয়েছেন। এমনকি কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের আমলারা মন্ত্রীদের পরামর্শ দিচ্ছেন। অনেক আমলাই আজকাল আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো আচরণ করেন। কদিন আগে এক সচিবের রুমে দেখলাম আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ধরনা দিচ্ছেন। ওই সচিব তাদের কীভাবে রাজনীতি করতে হবে তার পরামর্শ দিচ্ছেন। লজ্জায় আমি কুঁকড়ে গেলাম। আমরা স্বীকার করি, আর না-ই করি, দেশ চালাচ্ছেন গুটি কয়েক আমলা, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড় রকমের প্রভাব ফেলছে। নাম বলতে চাই না, কিন্তু হাতেগোনা ওই ব্যক্তিদের নাম সবাই জানে। তাদের মেধা কিংবা দক্ষতা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু একটা রাষ্ট্রে যখন রাজনীতির নিয়ন্তা হয় আমলাতন্ত্র, তখন সেই রাষ্ট্র একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে বাধ্য। রাজনীতিহীন একটা রাষ্ট্র হলো রক্তশূন্য এক মানুষের মতো। বাংলাদেশ কি ক্রমশ রক্তশূন্য হয়ে পড়ছে?

রাজনীতিহীন একটি রাষ্ট্র বিপজ্জনক। আমরা যদি একটু ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখি, তাহলে যতবার দেশে অসাংবিধানিক শাসন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে, ততবারই আক্রান্ত হয়েছে রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদরা। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর, সামরিক জান্তারা রাজনীতিকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছে। রাজনীতিবিদদের চরিত্রহরণের পরিকল্পিত প্রচেষ্টা দেখা গেছে। ’৮২ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও সিংহাসনে বসেছিলেন, রাজনীতিকে ব্যর্থ প্রমাণ করেই। আর ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের অন্যতম লক্ষ্যই ছিল বিরাজনীতিকরণ। বাংলাদেশে বার বার সংবিধান লঙ্ঘন করে উর্দিপরা কিছু মানুষ দেশের সর্বেসর্ভা হয়েছেন। দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়েই তারা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন, রাজনীতিবিদরা দেশের মঙ্গল চান না। তারা দুর্নীতিবাজ। তারা অশিক্ষিত। অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের পক্ষে সবচেয়ে ভালো যুক্তি হলো রাজনীতিবিদদের গালি দেওয়া। সাধারণ মানুষও রাজনীতিবিদদের সমালোচনা সাময়িকভাবে গ্রহণ করে, তারা হাত তালি দেয়। কিন্তু কিছু দিন পরই তাদের মোহভঙ্গ ঘটে। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে, ভালো হোক মন্দ হোক, রাজনীতিবিদদের কাছে তারা অন্তত তাদের সমস্যার কথা জানতে পারে। তাই অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে রাজনীতির জয় হয়েছে বার বার। আরেকটি কথা, বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং অর্জনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের সব অর্জনই রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের হাত ধরেই। ১৯৫২, ’৬৯, ’৭১, ’৯০ সব রাজনৈতিক বিজয়ের মাধ্যমেই বাংলাদেশ একটা করে মাইলফলক ছুঁয়েছে। ২০০৭ সালে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে শিক্ষিত লোকদের সরকারের চেয়ে, আওয়ামী লীগ সরকার দেশ যে অনেক ভালো চালাচ্ছে, তা নিয়ে সংশয়বাদী মানুষ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে।

কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয়, এখনো দেশে ওয়ান-ইলেভেনের ভূত সক্রিয়। বিরাজনীতিকরণের চক্রটি এখনো তৎপর। তাদের তৎপরতায় দেশকে আবার বিরাজনীতিকরণের পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিনা, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে? ২০১৯ সালের মন্ত্রিসভায় সিনিয়রদের বাদ দেওয়া হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি, যথেষ্ট বায়োপ্রবীণ ব্যক্তি আছেন মন্ত্রিসভায়। মন্ত্রিসভা থেকে আসলে বাদ দেওয়া হয়েছে, প্রবীণ রাজনীতিবিদদের। যাদের ওপর আমলারা খবরদারি করতে পারতেন না। আবার তাদের বাদ দেওয়ার কারণ হিসেবে অদ্ভুত গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এমনকি সামরিক জামানার মতো ওই সব নেতাকে ‘দুর্নীতিবাজ’ হিসেবে চিত্রিত করারও এক নোংরা, কুৎসিত খেলা দৃশ্যমান। আমি দুর্নীতির পক্ষে নই, কেউ যদি দুর্নীতি করে তার অবশ্যই বিচার করা উচিত। কিন্তু বিচার না করে, কুৎসা ছড়ানো রাজনীতিবিরোধী অপশক্তিরই পুরনো খেলা। সেই খেলা আবার নতুন করে শুরু হলো কিনা, সে প্রশ্ন অনেকের মনেই এসেছে। নতুন মন্ত্রিসভার বয়স তিন মাস হতে চলল। এই তিন মাসে মন্ত্রিসভার আমলা নির্ভরতার চিত্র স্পষ্ট। মন্ত্রণালয়গুলোর কাজে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নেই। উদাহরণ দেওয়া যাক, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম অত্যন্ত সজ্জনব্যক্তি। ভালো মানুষ। সৎ মানুষ হিসেবে আদালত পাড়ায় তার সুনাম আছে। কিন্তু আগুন লাগার ঘটনার পর, তিনি যে সমাধানের পথে যাচ্ছেন, সেটার মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দিক-দর্শন নেই। এটা স্রেফ একটা আমলাতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা কায়েম। আমি গৃহায়ণমন্ত্রীর প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রণয়নের প্রকল্প ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। এক সময় এ তালিকায় যাদের নাম আছে, তারা নানা হুমকি দেবে, আন্দোলন করবে, রাজউকের এক শ্রেণির কর্মকর্তাকে তারা কিনে ফেলবে। এক সময় এই অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তিনি যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্যাকে দেখতেন, তাহলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাজ, ক্ষমতা এবং দায়িত্ব পুনর্মূল্যায়ন করতেন। কীভাবে রাজউককে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি থেকে জনগণের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা যায়, তার উপায় খুঁজতেন। এটা খুঁজলেই বোঝা যেত, জাতির পিতার চিন্তা আর বর্তমান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাজ সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটা কথা সব সময় বলেন, ‘বাংলাদেশে সব অপকর্মের সূচনা ৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে।’ এর চেয়ে বড় সত্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্ভবত নেই।

জাতির পিতা ঢাকা মহানগরীকে আধুনিক, বাসযোগ্য এবং পরিকল্পিত করতে চেয়েছিলেন। ‘একটু পড়াশোনা করলেই দেখা যাবে, তার চিন্তা ছিল কত সুদূরপ্রসারী। তিনি জাতীয় সংসদ, পরিকল্পনা কমিশন, গণভবন এবং আগারগাঁওকে ঘিরে সরকারি অফিসপাড়া গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বাণিজ্যিক এবং আবাসিক এলাকা আলাদা করতে চেয়েছিলেন। আজ রাজউকে টাকা দিলেই আবাসিক বাড়ি কমার্শিয়াল হয়ে যায়। রাজধানীতে আবাসিক এলাকা বলে এক বসুন্ধরা ছাড়া (তাও যেটি বেসরকারি) আর কিছু নেই। সমস্যাটা কেবল আগুন লাগা নয়, সমস্যাটা হলো রাজধানীতে সুন্দর, সুস্থ নাগরিক জীবন। একটা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং আমলাতান্ত্রিক সমাধানের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। রাজনৈতিক সমাধানে সমস্যার স্বরূপ খোঁজা হয়, সমস্যার উৎস খোঁজা হয় এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের মতামতের ভিত্তিতে সমাধান খুঁজে বের করা হয়। আর আমলাতান্ত্রিক সমাধান হলো, যেখানে সমস্যা সেটার ওপর শুধু কাজ করা হয়। আমলাতান্ত্রিক সমাধানে প্রথমেই তদন্ত কমিটি হয়, তারপর আইন প্রয়োগ হয় তারপর সমস্যাকে ধামাচাপা দেওয়া হয়। এ যেন মাথাব্যথা হলেই প্যারাসিটামল দেওয়ার মতো। এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পর আমরা আমলাতান্ত্রিক সমাধান দেখছি। যা দীর্ঘমেয়াদে কোনো ফল দেবে না। বরং যারা নানারকম ঝুঁকিতে ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন, তাদের পথে বসাবে এবং সরকারের শত্রু বানাবে।

এটা তো শুধু আগুনের ক্ষেত্রে উদাহরণ দিলাম। সব ক্ষেত্রেই এখন আমলাতান্ত্রিক অ্যান্টিবায়োটিক সমাধান দেওয়া হচ্ছে। যার পাশর্^প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ হতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চিকিৎসকদের গ্রামে থাকতে হবে। এটি প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। অথচ এর বাস্তবায়নে ব্যবহার করা হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক পথ। জোর করে, ডাক্তারকে গ্রামে পাঠানো হচ্ছে। ওই চিকিৎসক গিয়েই ছুটি নিচ্ছেন না হলে নানা বাহানায় কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন। অথচ জাতির পিতা এ সমস্যাটি ৭২-এ বুঝতে পেরেছিলেন। এ জন্য তিনি চিকিৎসক নিয়োগ বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। জাতির পিতার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিতে, স্থানীয়ভাবে চিকিৎসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত ছিল। এখন দেশের এক শ্রেণির আমলা কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর নাম বলে গলা ফাটিয়ে ফেলেন। অথচ তারা যদি বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের লক্ষ্য ও কর্মসূচিগুলো একটু খতিয়ে দেখতেন, তাহলে আজ অনেক সমস্যার সমাধান হতো। ‘বাংলাদেশ সরকার (১৯৭১-৭৫)’ শিরোনামে এ সম্পর্কে এইচ টি ইমামের একটি অমূল্য গ্রন্থ আছে। ওই গ্রন্থটি যদি, যারা আজকাল সরকার চালান তারা পাঠ করেন, তাহলে দেখবেন, জাতির পিতা যে কোনো সমস্যা সমাধানে তিন ধরনের পথ অনুসরণ করতেন। স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি। রাজনীতিতে যেমন কোনো শটকার্ট পথ নেই বলে জাতির পিতা মনে করতেন, তেমনি প্রতিটি সমস্যার সমাধানে রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনাকে গুরুত্ব দিতেন। আমাদের দেশে আজ যারা জাতির পিতার বন্দনা করছেন, তাদের অধিকাংশই শুধু প্রধানমন্ত্রীর কৃপা লাভের জন্য এবং তার সুনজরে থাকার জন্য এসব করছেন। এসব যে অন্তর থেকে নয়, আদর্শ উৎসারিত নয়, তা বোঝার জন্য পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।

আওয়ামী লীগই এ দেশে রাজনৈতিক উন্মেষ এবং বিকাশের প্রধান বাহন। আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই এ দেশের মানুষ রাজনীতি মনস্ক হয়েছেন, রাজনীতির জন্য সর্বস্ব উজাড় করতে শিখেছেন। এখন কি আওয়ামী লীগকে দিয়েই রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠানোর আয়োজন চলছে? এ কারণেই ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়, যে বিজয় সম্ভবত আওয়ামী লীগও চায়নি। এ কারণেই কি মন্ত্রিসভা থেকে রাজনীতিবিদদের বেছে বেছে বাদ দেওয়া হয়েছে? এ কারণেই কি আমলাতান্ত্রিক শাসন দেশে কায়েম করার চেষ্টা হচ্ছে? যেখানে আওয়ামী লীগ শুধু নামে সরকারে থাকবে, দেশ চালাবে আমলারা?

এসব প্রশ্নের উত্তর চটজলদি যা এককথায় দেওয়া সম্ভব নয়। তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এক তরফা হওয়ার পরও মানুষ বিপুলভাবে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারকে স্বাগত জানিয়েছিল।

জনগণ বিএনপির সন্ত্রাস, নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। জ¦ালাও-পোড়াও’র বিপরীতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা। আর এবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরও, জনগণের মধ্যে হতাশা, অজানা আশঙ্কা। একটি দুর্ঘটনাও তাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। এ দুটি ঘটনার পার্থক্যের মধ্য দিয়েই হয়তো এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যায়। ২০১৪ সালে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পরও মানুষের সমর্থনের রাজনৈতিক কার্যকারণ ছিল। আর এবার সাধারণ মানুষ মনে করে না যে, এই নির্বাচন একটি রাজনৈতিক নির্বাচন। অধিকাংশ মানুষ মনে করে এটা একটি আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন। এবং যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জনগণকে উপেক্ষা করা হয়েছে। তাই এখন আগুন, সড়ক কিংবা দুর্ঘটনা নিয়ে যে সমস্যাগুলো চলছে, যা দেশের মানুষকে উদ্বিগ্ন করছে তার রাজনৈতিক সমাধান খুঁজতে হবে, রাজনৈতিকভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশকে যেভাবে রাজনীতি শূন্য করার নীরব প্রক্রিয়া চলছে, তার সবচেয়ে বড় মাশুল দিতে হবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকেই।

                লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ই-মেইল : [email protected]

 

সর্বশেষ খবর