বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভারতে নির্বাচন : দিল্লি দখলের লড়াই শুরু

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ভারতে নির্বাচন : দিল্লি দখলের লড়াই শুরু

বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের কঠিন পরীক্ষা শুরু আজ। ভারতের লোকসভা নির্বাচনের সাত দফা ভোট গ্রহণ শুরু আজ বৃহস্পতিবার। শেষ হবে ১৯ মে। প্রথম দফায় লোকসভার মোট ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৭৭টি আসনে ভোট হবে। যেহেতু আর সময় নেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয়স্বজন মেইল করে জানতে চাইছেন এবারের ভোটে দিল্লি কার দখলে যাবে? মোদি না রাহুল? নাকি অন্য কেউ। প্রধানমন্ত্রীর পদের দাবিদার দুই সপ্তাহ আগে পর্যন্ত ছিলেন মোদি ও রাহুল গান্ধী, এখন ভোটের আগে যুক্ত হয়েছেন আরও দুজন। তারা হলেন- তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্র শেখর রাও, অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইড়ু। আর বহুদিন ধরে যাদের নাম শোনা যাচ্ছিল তারা হলেন- পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ও উত্তরপ্রদেশের বহুজন সমাজ পার্টি দলের নেতা মায়াবতী- তারা সবাই আঞ্চলিক দল গঠন করে নির্বাচনে লড়ছেন। গত সাত দিন ধরে ওই দুই নেত্রীর সভা-সমিতিতে বক্তব্য রাখাকালীন তাদের শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ও বাচনভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তারা ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে গেছেন। নির্বাচনী শেষ পরিস্থিতি দেখে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আঞ্চলিক দলগুলো সর্বভারতীয় দুই দল কংগ্রেস ও বিজেপিকে এককথায় বলতে গেলে সরাসরি ব্ল্যাকমেইল করছে।

সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন বেসরকারি চ্যানেলে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে আগাম সমীক্ষায় যা দেখা যাচ্ছে, তাতে মোটামুটি বলা যায় আঞ্চলিক দলগুলো স্থানীয় ইস্যু সামনে রেখে কিছুটা লাভবান হবে। আঞ্চলিক দলগুলোর নিজস্ব টিভি চ্যানেলের এ সমীক্ষা কতটা কার্যকর হবে তা জানা যাবে ২৩ মে ফল প্রকাশের দিন। সম্প্রতি কলকাতার মমতাপন্থি এক চ্যানেলের সমীক্ষায় যে ফলাফল দেখানো হয়েছে, তার সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির কোনো মিলই নেই। যিনি সমীক্ষা করেছেন তিনি রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন লেকচারার। দীর্ঘদিনের পরিচিত। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম-দেশের ৯৫ কোটি ভোটারের মধ্যে আপনারা সমীক্ষা চালিয়েছেন মাত্র ৫৪ হাজার লোকের মধ্যে। তাহলে কত শতাংশ লোকের মধ্যে আপনারা সমীক্ষা চালালেন? উত্তরটা এড়িয়ে তিনি জবাব দিলেন- আমি দলের একজন সৈনিক, প্রশ্ন করলাম কোন দলের? তিনি উত্তর দিলেন দিদির দলের। তিনি আরও বলেন, দিদি আমাকে কথা দিয়েছেন নির্বাচন শেষে শান্তিনিকেতনে বিশ্ববাংলা বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করবেন আর সেখানে আমাকে উপাচার্য করবেন।

গত ছয় দশক ধরে নির্বাচনের রিপোর্ট করছি, শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের নানা দেশের। দেখতে পাচ্ছি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে আঞ্চলিক দলের নেতানেত্রীরা যে ভাষায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করছেন সে ভাষা গান্ধী, প্যাটেল, মাওলানা আজাদ ও রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের নয়, টিভির পর্দায় সে ভাষা শোনা যায় কিন্তু সংবাদপত্রে তা লেখা যায় না বা ছাপা যায় না।

শুধু এবার নয়, আমার মনে আছে ১৯৮৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনে আগাম সমীক্ষা করা হয়েছিল দিল্লির একটি সংস্থাকে দিয়ে। তাদের সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্টই আবার ক্ষমতায় ফিরছে বিপুল আসনের ব্যবধানে। তখন আমাকে ও দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাবেক চিফ অব ব্যুরো তরুণ গাঙ্গুলিকে বলা হয়েছিল রিপোর্টটা ঘুরিয়ে দিয়ে বলতে হবে জ্যোতি বাবু হেরে যাবেন ও কংগ্রেসের প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী মুখ্যমন্ত্রী হবেন। আমরা তাতে রাজি হইনি। কিন্তু রিপোর্ট ঘুরিয়ে ছাপা হয়েছিল নির্বাচনের দু-তিন দিন আগে। আমাকে বলা হলো আপনি যা জানেন তাই লিখুন। নির্বাচনের কয়েক দিন আগে আমাকে যখন বলা হয়েছিল আপনি লিখুন। লিখেছিলাম, ফলাফলে দেখা গেল আমাদের হিসাব পুরোপুরি মিলে গিয়েছিল। ৪০ বছর আগের সেই ঘটনার ধাঁচ কিন্তু এখন ১০০ গুণ বেড়ে গেছে। কারণ রাজ্যে রাজ্যে বহু দল এবং তাদের নিজস্ব অনেক চ্যানেল আছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির নিজস্ব আটটি চ্যানেল আছে।

ভারতের নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বলে খুবই জনপ্রিয় ও পরিচিত যোগেন্দ্র যাদব। তার নির্বাচনী সমীক্ষায় দেখা গেছে মোটামুটিভাবে ৮০ শতাংশ মিলে যায়। আমরা দুজনে একসঙ্গে বিদেশের বহু নির্বাচনের রিপোর্ট করেছি। এই লেখার আগে যোগেন্দ্র সাহেবের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছিলাম। তিনি দুই দিন সময় নিয়েছিলেন, দুই দিন পর তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, আঞ্চলিক দলগুলো আঞ্চলিক ইস্যু নিয়ে নির্বাচনে লড়ছে, তাদের সামনে জাতীয় কোনো ইস্যু নেই। সর্বভারতীয় দল কংগ্রেস ইতিমধ্যে যে ইশতেহার প্রকাশ করেছে তা যদি করতে পারে তাহলে কংগ্রেসের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে আশ্চর্য হব না।

কংগ্রেস যে ইশতেহার প্রকাশ করেছে তা একবার দেখা যাক-

১. কর্মসংস্থান : ১ এপ্রিল ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী চার লাখ সরকারি শূন্যপদ পূরণ, বেসরকারি সংস্থা, বিচার বিভাগীয় এবং সংসদীয় পদে কর্মী নিয়োগ।

২. ন্যায় প্রকল্প : পাঁচ কোটি গরিব পরিবারকে বছরে ৭২ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। প্রত্যেক সদস্যের অ্যাকাউন্টে মাসে ছয় হাজার টাকা দেওয়া হবে।

৩. কর প্রদান : কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে প্রত্যক্ষ কর চালু করবে। চলতি জিএসটি আইনের পরিবর্তে রেজিমভিত্তিক একক ও নির্ধারিত মানের করব্যবস্থা চালু করবে।

৪. বাজেট : কৃষি বাজেট করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কংগ্রেস। রেল বাজেট পৃথক হবে।

৫. ভোট : ইভিএমের কারচুপি বন্ধ করা হবে। সংরক্ষণÑ মহিলাদের লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভায় ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ হবে। শিল্পে জিডিপি ১৬ থেকে বেড়ে ২৫ শতাংশ করা হবে। বিদেশনীতির জন্য জাতীয় কাউন্সিল তৈরি করা হবে এবং প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিজেপির ইশতেহারে প্রথমেই দেখা যাক ২০১৪ সালের ইশতেহারে তারা কী বলেছিল। বলেছিল, ‘আচ্ছে দিন’। পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেল ভারতে এলো ঘোর দুর্দিন। ইশতেহারটি প্রকাশ করে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, আগামী বছর স্বাধীনতার ৭৫ বছর। ৭৫টি কর্মসূচি নেওয়া হবে। রাফেল কেলেঙ্কারি নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করা হয়নি। মামলাটি এখন দেশের শীর্ষ আদালতে। ফিরে গেল আবার সেই রামমন্দিরে। ক্ষমতায় ফিরে এলে রামমন্দির বানানো হবে। সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য পৃথক আইন। বিজেপির ইশতেহার দেখে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ১৯৪০ সালের লাহোরের মুসলিম লীগের জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বের যে প্রবক্তা ছিলেন সে পথেই হাঁটতে চলেছেন মোদি ও অমিত শাহরা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতরা মনে করেন বিজেপির চিন্তা হলো ভারতকে আবার বিভক্ত করার একটি অপকৌশল মাত্র। যোগেন্দ্র যাদবের মতো বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ৭২ বছর ধরে যে ধর্মনিরপেক্ষতা এ দেশে গেঁথে বসেছে তাকে নাড়া দিতে গেলেও ফল হবে ভয়ঙ্কর যা মোদি ও অমিত শাহরা সামলাতে পারবেন না। তাই সারা ভারতবর্ষে একই প্রশ্ন, মোদি ও অমিত শাহর জমানায় ভারতকে কি আবার বিভক্ত করা হবে? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে মে মাসের ৩০ তারিখে।

 

            লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর