বাংলা সনের সঙ্গে কৃষির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। সারা বছরকে ছয়টি ঋতুতে ভাগ করা হয় মূলত কৃষিকাজের সুবিধার্থেই। মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সন প্রবর্তন করেন তার সিংহাসন-আরোহণের সময় থেকে, অর্থাৎ ৫ নভেম্বর, ১৫৫৬ সাল থেকে। বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হওয়ার আগে বাংলা সন ‘ফসলি সন’ নামেই পরিচিত ছিল। সে সময় বাংলার কৃষক চৈত্রের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। এ আচারকে বলা হতো পুণ্যাহ। ভূস্বামীরা পয়লা বৈশাখে কৃষককে মিষ্টিমুখ করাতেন। খোলা হতো নতুন বছরে খাজনার নতুন খাতা। এরপর বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব হয়ে দাঁড়ায় হালখাতা। গ্রাম-গঞ্জ-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের শুরুতে পুরনো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে খুলতেন নতুন হিসাবের খাতা। এ উপলক্ষে চলত উৎসব, মিষ্টিমুখ। মেলা বসত গ্রামে গ্রামে। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে ইরফান হাবিব রচিত ‘মুঘল ভারতের কৃষিব্যবস্থা’ বইটির কথা। সেখানে মুঘল আমলের কৃষির যে চিত্র পাওয়া যায় তা সত্যি বিস্ময়কর। মুঘল আমলে গ্রামীণ অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি ও হস্তশিল্প। কৃষিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল নানারকম কুটিরশিল্প। সে সময় থেকেই আখ ও তালের রস থেকে বিভিন্ন ধরনের চিনি তৈরি হতো। আবুল ফজল পাঁচ রকম চিনির কথা বলেছেন। চিনিশিল্পের প্রধান কেন্দ্রস্থল ছিল বাংলা, আগ্রা ও লাহোরের মধ্যবর্তী এলাকা এবং গোলকুণ্ডা। এ অঞ্চল থেকে আরব, মেসোপটেমিয়া ও পারস্যে চিনি রপ্তানি হতো। ঘানিতে তেলবীজ থেকে তৈরি হতো তেল। সিন্ধু, গুজরাট, গোলকুণ্ডা, মহীশূর, উড়িষ্যা ও বাংলায় এ পদ্ধতির প্রচলন ছিল। তামাকশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল বুরহানপুর, বাংলা ও বিহার। ভারতবর্ষেই তুলার চাষ হতো। বিশেষ করে বাংলা ছিল তুলা চাষের প্রধান আখড়া। কাপড় রং ও উজ্জ্বল করতে আগ্রা, ঢাকা, কাশিমবাজার, আহমেদাবাদ প্রভৃতি বস্ত্রশিল্পের কেন্দ্রে নীলের চাহিদা ছিল। কৃষিজাত শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বস্ত্রবয়ন শিল্প। দেশজুড়ে বিভিন্ন ধরনের কাপড় তৈরি হতো। বাংলার বস্ত্রশিল্পের খ্যাতি ছিল জগজ্জুড়ে। ঢাকার মসলিন বস্ত্র ছিল খুব বিখ্যাত। পশম বা উলের জন্য বিখ্যাত ছিল কাবুল, কাশ্মীর ও পশ্চিম রাজস্থান। শণ ও পাটের তৈরি জিনিসও বহুল ব্যবহৃত হতো। ভারতের প্রায় সর্বত্র শণ উৎপন্ন হতো। বাংলায় হতো পাটের চাষ। পাট দিয়ে তৈরি হতো দড়ি, বস্তা বা থলে। কাশিমবাজারের দড়ি ছিল বিখ্যাত। এ অঞ্চলের পাটের শাড়ির ছিল অন্যরকম কদর। সে সময়টা বলা চলে কৃষি ও কৃষকের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি ও কৃষককে ঘিরেই সব রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে কৃষক শোষিত হলেও সমাজে কৃষকের সম্মান ছিল, ছিল অন্যরকম গ্রহণযোগ্যতা। কৃষকের পয়লা বৈশাখও ছিল আনন্দঘন এক ব্যাপার।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাতে থাকে কৃষি ব্যবস্থাপনা। বাজারে তৈরি হতে থাকে মধ্যস্বত্বভোগী। কৃষক হারাতে শুরু করে তার লাভের অঙ্ক। ইংরেজের শাসন আর জমিদারদের অব্যবস্থাপনায় কৃষি ও কৃষক হারিয়ে ফেলে তার সুদিন। হাতের লাঙল ফেলে নিজের অধিকারের জন্য করতে হয় সংগ্রাম। কৃষকের পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে এক যন্ত্রণার নাম। এসব বইয়ে পড়া ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষককে দেখেছি খুব কাছ থেকে। প্রায় চার দশক ধরে কাজ করছি কৃষকদের নিয়ে। একটি দেশ যাত্রা করে কৃষিপ্রধান অর্থনীতি নিয়ে। সেখানে কৃষক মানেই হাড় জীর্ণ এক মানুষ। শত ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে। সেই কষ্ট জর্জরিত মানুষটিই ছিল মূল অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তার পয়লা বৈশাখ বলতে কিছুই ছিল না। পান্তা দিয়ে শুরু করা বছর শেষও হতো পান্তাতেই। সারা বছর লড়াই করতে হয়েছে একদিকে প্রকৃতির সঙ্গে, অন্যদিকে মহাজনের সঙ্গে। গ্রামে চৈত্র মাস মানেই ছিল অভাবের এক সময়। সে সময়টায় গোলার ধান ফুরাত। ভাতের অভাবে বাজার থেকে কেনা আটার রুটি খেতে হতো। তখনো পয়লা বৈশাখ মানে কোনো আনন্দ নয়, বৈশাখ মানে আর কয়েকদিন পর উঠবে বোরো ফসল। থালা ভরা গরম ভাত তুলে দিতে পারবে সন্তানের পাতে। এটুকু ছিল সান্ত্বনার। আর কিছু নয়, ভাতের অভাবের অভিশাপ ছিল এক দশক আগেও। উত্তরাঞ্চলের মঙ্গার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে!
এখন সময় বদলেছে। বদলেছে কৃষি। একটা ছোট্ট প্রযুক্তি, উন্নত বীজ পাল্টে দিয়েছে সব। আগে ধান ফলাতে লাগত ১৪০ দিন। কার্তিকের শেষে ও চৈত্রের শেষে ১০-১২ দিন খাদ্যাভাব দেখা দিত চরম আকারে। সে সময়টায় কর্মহীনতায় মঙ্গা হতো। এখন শর্ট ডিউরেশনের (স্বল্পমেয়াদি) ধানের জাত আবিষ্কৃত হওয়ায় ধান উৎপাদনে লাগছে ১১০ থেকে ১২০ দিন। কার্তিকের আগেই ধান উঠছে গোলায়। ফলে কার্তিকের মঙ্গা দূর হয়ে গেছে। বছরে এখন তিনটি ফসল চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। জাত উন্নয়ন করায় বেড়েছে ফলন। শুধু ধান আর পাটই নয়, কৃষক চাষ করছে উচ্চ ফলনশীল ফল-ফসল। লাভের হিসাবটা কৃষক ঠিকই বুঝে গেছে। বেশ সচেতন হয়ে উঠেছে নিজের অধিকার সম্পর্কে। কৃষকের খাবারের থালায় ভাতের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে শাক-সবজি, মাছ-মাংস আর ফল। পয়লা বৈশাখ মানে সত্যিই এখন আনন্দের। ঈদ বা পুজোর মতোই এ উৎসবেও চাই নতুন পোশাক, খাওয়া-দাওয়ার বাহারি আয়োজন। গত এক মাস ধরে প্রাক-বাজেট আলোচনা ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর জন্য আমাকে যেতে হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। কথা বলেছি হাজারো কৃষকের সঙ্গে। পাল্টে গেছে কৃষি ও কৃষকের সংজ্ঞা। পাল্টেছে কৃষকের ধ্যান-ধারণা। উৎপাদনের পাশাপাশি বাজার সম্পর্কেও কৃষক বেশ ভালো খোঁজখবর রাখেন। কখন কোন ফসল করলে লাভ বেশি পাওয়া যাবে এ হিসাবটাও রাখছেন বুঝে-শুনেই। আমি সবসময়ই বিশ্বাস করেছি, বাংলাদেশের কৃষি অমিত সম্ভাবনার এক ক্ষেত্র আর কৃষক অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো এক মহানায়ক। এ বাংলাদেশের কৃষকই নিজস্ব তাড়না থেকে সমৃদ্ধ করেছে কৃষিকে। তবে সংকটের অশনিসংকেত এখনো শুনতে পাই। সারা বিশ্বই ঝুঁকেছে প্রযুক্তির কৃষিতে। শিল্পবিপ্লবের মতোই নতুন এক বিপ্লব আসবে কৃষিতে। গ্রিনহাউসে প্রযুক্তির কৃষি হবে শিল্পের কৃষি। হিসাব কষে শিল্পকারখানার মেশিনের মতোই গাছ থেকে আসবে ফল-ফসল। মাছ চাষ থেকে শুরু করে সব ধরনের কৃষিই চলে আসছে বদ্ধ ঘরে। দিগন্তজোড়া কৃষি নয়, বরং কৃষির সম্প্রসারণ হচ্ছে ঊর্ধ্বমুখী। নিশ্চিত লাভের উন্নত প্রযুক্তির এ কৃষিতে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে। তাই এতে বিনিয়োগ করবে বড় বড় শিল্পপতিরা। গার্মেন্ট কারখানার মতোই কৃষির জমিগুলোয় গড়ে উঠবে কৃষি-শিল্প প্রতিষ্ঠান। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক তাদের নিজের জমিতে গড়ে ওঠা কৃষি-শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হবে। প্রকৃত কৃষকের হাত থেকে কৃষি চলে যাবে কারখানায় যন্ত্রের কাছে। তার একসময় সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মতো উপযোগিতা হারাবে বাণিজ্যিক কৃষির যান্ত্রিক উৎপাদনব্যবস্থা। তখন ওই কৃষি ক্ষেত্রগুলো হবে যন্ত্রের ভাগাড়। যান্ত্রিক বর্জ্যে মাটিও হারাবে তার স্বাভাবিক উর্বরতা। এ সময়ের ভিতর কৃষকের হাত থেকে কৃষি সরে যাওয়ায় হাজার বছরের লব্ধ কৃষিজ্ঞান যেমন হারিয়ে ফেলবে, তেমনি হারিয়ে ফেলবে প্রাকৃতিক কৃষি-কৌশল। ভবিষ্যতের কৃষিতে এক গভীর বিপর্যয়ের আভাস আমি পাই। তাই এখন থেকেই এসব বিষয়ে কৃষককে সচেতন হতে হবে। সরকারি-অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এখন থেকেই হিসাব কষতে হবে আগামীর কৃষির। প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পিত কৃষি ব্যবস্থাপনা যেমন নিশ্চিত করতে পারে টেকসই উন্নয়নের, তেমনি ভাগ্য ফেরাতে পারে কৃষিসংশ্লিষ্ট সবার।বলছিলাম কৃষকের পয়লা বৈশাখ নিয়ে। এ বিষয়ে আরও এক সংকটের কথা বলতে হচ্ছে। সারা বিশ্বকেই এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশেষ করে সমুদ্র-নিকটবর্তী দেশগুলো এর প্রভাব টের পাচ্ছে বেশ ভালোভাবেই। আমি মনে করি, কৃষকই সবচেয়ে বেশি প্রকৃতিমগ্ন। পেশাগত কারণেই প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ যেমন রোদ-বৃষ্টি-ঝড় সম্পর্কে সম্যক ধারণা তাকে রাখতেই হয়। যুগ যুগ ধরে পরম্পরায় পরিবেশ ও আবহাওয়া সম্পর্কে এক ধরনের জানাবোঝা কৃষকের রয়েছে। আকাশ দেখলেই সে বলে দিতে পারে ঠিক কতক্ষণ পরে বৃষ্টি হবে। বাতাসে কান পাতলেই সে বুঝতে পারে এবারের বর্ষায় বৃষ্টি কতটুকু হবে। পুরোপুরি না মিললেও এ হিসাব-নিকাশগুলো কৃষককে কৃষিকাজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সহযোগিতা করেছে দিনের পর দিন। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনের এই সময়ে এসে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। অসময়ের বৃষ্টি কিংবা রোদ বদলে দিয়েছে কৃষকের এত বছরের প্রকৃতির পাঠ। ফলত কৃষককেই মুখোমুখি হতে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের। বলতে হচ্ছে কৃষিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। সব কৃষকের কাছেই আমার প্রশ্ন থাকে- আচ্ছা, রোদ-বৃষ্টির হিসাব কি ঠিক আছে? চারা কি সময়মতো গজায়? কৃষক জানান, না, রোদ-বৃষ্টির চিরকালীন যে নিয়ম তা আর আগের মতো নেই। বীজ থেকে চারাও ঠিক আগের সময়ে গজাচ্ছে না। শীতকাল ঠিক শীতকালের জায়গায় নেই, যেমন বর্ষা নেই বর্ষাকালে। ফলে কৃষকের বৈশাখও বদলে যাচ্ছে, বৈশাখও থাকছে না আর বৈশাখের জায়গায়। তবে আমি আশাবাদী মানুষ। বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষি নিয়ে অপার স্বপ্ন চোখে। আমার বিশ্বাস, এ দেশের সংগ্রামী কৃষক ঠিকই বাতলে নেবে নিজস্ব পথ, উত্তরণের দারুণ কৌশল। আসছে বাংলা নতুন বছর। পয়লা বৈশাখ। নতুন বছরে এ দেশের কৃষক হয়ে উঠুক আরও উদ্দীপ্ত। সবাইকে বাংলা নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।