শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

ইসলামী সংস্কৃতি ও আমাদের করণীয়

মুফতি মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহিল বাকী

পেশ ইমাম ও ভারপ্রাপ্ত খতিব, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, ঢাকা

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে সংস্কৃতি হচ্ছে এমন একটি সামাজিক বিধান যা মানুষকে সাংস্কৃতিক ফললাভে সর্বাধিক সাহায্য করে। চারটি মৌল উপাদান নিয়ে সংস্কৃতি গঠিত হয়। অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণ, রাজনৈতিক শৃঙ্খলা, নৈতিক নীতিমালা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার মজবুত ভিত্তি। সংস্কৃতির সংগঠন এবং উন্নতি-অগ্রগতির জন্য ভৌগোলিক-অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপাদান অপরিহার্য। মনস্তাত্ত্বিক উপাদান যেমন ধর্ম, ভাষা ও শিক্ষা-দীক্ষা। দুনিয়ার বুকে মানুষের প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই সংস্কৃতির ইতিহাস শুরু হয়েছে। সভ্যতার ধারা পরস্পর সম্পৃক্ত। একেকটি জাতি পরবর্তী জাতির কাছে সভ্যতার এ ধারা হস্তান্তর করে আসছে। সম্ভবত এমন কোনো জাতি ছিল না, সভ্যতার ইতিহাসের পাতায় যারা কিছু না কিছু সংযোজন করেনি। অবশ্য যে জিনিসটি একটি সংস্কৃতিকে অন্য সংস্কৃতি থেকে পার্থক্য করে তা হলো সংস্কৃতির বুনিয়াদের শক্তি যার ওপর সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে আছে এবং সেসব প্রভাব ও কল্যাণকর দিক যা এ সংস্কৃতির ফলে গোটা মানবজাতির ওপর পতিত হয়ে থাকে। আপন মিশন ও পয়গামের দিক থেকে যে সংস্কৃতি যতটুকু সামগ্রিক এবং সর্বজনীন, প্রাকৃতিক দিক থেকে যত বেশি মানবকল্যাণমুখী, চারিত্রিক দিক থেকে যত বেশি বাস্তবানুরাগী সে সংস্কৃতি ইতিহাসে তত বেশি সুদূরপ্রসারী ও অনুসরণযোগ্য বলে স্বীকৃতি লাভ করবে। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণে ইসলামী সংস্কৃতি হৃদয়গ্রাহী ও সুদূরপ্রসারী হয়েছে। বুনিয়াদিভাবে ইসলামী সংস্কৃতির প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো তাওহিদ। তাওহিদ তথা একাত্মবাদের ওপর এ সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপিত। ইসলামী সভ্যতার বাহ্যিক যত রূপ দেখা যাবে তাতে তাওহিদের ছাপ থাকবেই। এ তাওহিদ মানুষকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়। তাওহিদের তাৎপর্যকে মানুষের অন্তরে পরিপুষ্ট করার ফলেই মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। শাসক শ্রেণির স্বৈরাচার পোপতন্ত্র বা ধর্মীয় পুরোহিততন্ত্রের কবল থেকে গণমানুষ মুক্তি পেয়েছে। ইসলামী সংস্কৃতির দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে গতি-প্রকৃতির দিক থেকে তা সমগ্র মানবতার ওপর সুদূরপ্রসারী এবং পয়গাম ও মিশনের দিক থেকে সামগ্রিক ও বিশ্বজনীন। বংশ, গোত্র এবং দেশের বিভিন্নতা সত্ত্বেও মানবজাতির ঐক্যের কথা আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে- ‘হে মানব জাতি! এক নারী-পুরুষ থেকে আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের নানা দলে ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পারো।’ আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি অধিক প্রিয় যিনি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহভীরু। মানবতাবোধ সৃষ্টির জন্য এর চেয়ে বড় আর কী ঘোষণা হতে পারে? এই মানবতাবোধ না থাকার কারণে মানবতাকে ধ্বংস করার জন্য যত আধুনিক অস্ত্র তৈরি হচ্ছে এবং এর পেছনে যত টাকা খরচ হচ্ছে অসহায় মানবতাকে রক্ষার জন্য তার শতভাগের এক ভাগও খরচ করা হচ্ছে না। মানবতাবোধের এই বিশ্বাসের অভাবের কারণেই মানববিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বর্তমান বিশ্বে। এ সংস্কৃতি কখন যে কাকে আক্রমণ করে বা কে কখন আক্রান্ত হয় তার শঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। ইসলামী সংস্কৃতির তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইসলাম তার বিধানে এবং সব তৎপরতার নৈতিক মূল্যবোধ ও চারিত্রিক নীতিমালাকে সর্বপ্রথম স্থান দিয়েছে। ব্যক্তি, দল ও শাসক শ্রেণির বৈষয়িক উদ্দেশ্য হাসিলের উপায় হিসেবেও ব্যবহার করেনি। রাজ্য শাসন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, আইন প্রণয়ন, যুদ্ধ-সন্ধি, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক কার্যাদিতে চারিত্রিক মূলনীতির সামঞ্জস্যবিধানের প্রতি সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে।

ইসলামী সংস্কৃতির চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ সংস্কৃতি জ্ঞানের সত্য-সঠিক নীতিমালায় বিশ্বাসী এবং পূত-পবিত্রতার নীতি-বিশ্বাসকে তার কেন্দ্র বলে মনে করে। বুদ্ধি-বিবেককে যুগপৎ আহ্বান জানায়। পশ্চিমা বিশ্বে ধর্মচর্চা আর জ্ঞানচর্চা একটা আরেকটার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। আর ইসলামে একে অন্যের পরিপূরক। পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবে কিছু কিছু মুসলমান ধর্মচর্চা ও জ্ঞানচর্চাকে একটা আরেকটার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করায়। অথচ আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘বিজ্ঞান মুসলমানের হারানো সম্পদ যেখানে কোনো বিষয়ে জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যাবে, সেখানেই উপস্থিত হয়ে যে জ্ঞান অর্জন তার জন্য জরুরি বলে মনে করবে।’ এ কারণেই ইসলাম বিজয়ী বেশে যেসব এলাকায় প্রবেশ করেছে সে অঞ্চলের সংস্কৃতিকে ইসলামের বুনিয়াদি আকিদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে আপন করে নিয়েছে। মুসলমান বর্তমানে নিজ সংস্কৃতি ভুলে চরিত্রবিধ্বংসী বেলেল্লাপনা সংস্কৃতির স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘কল্যাণের কাজে সহযোগিতা কর। সীমালঙ্ঘন ও পাপের কাজে সহযোগিতা থেকে নিজেকে দূরে রাখ।’ ইসলামী সংস্কৃতি লালনের মাধ্যমে আল্লাহ যেন মুসলমানদের ইসলামবিরোধী সংস্কৃতির কুফল থেকে বাঁচার তাওফিক দান করেন।

সর্বশেষ খবর