রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

নুসরাতের ললাট লিখন

আফরোজা পারভীন

নুসরাত এ দেশের ১৬-১৭ কোটি মানুষের একজন, একজন মেয়ে। পরিচয় দেওয়ার মতো কিছু নেই ওর। না ধনী কন্যা, না কোনো অভিজাত কন্যা। নিতান্তই সাধারণ এক গ্রাম্য মেয়ে। এমন কত শত গ্রাম্য মেয়ে এ দেশের অসংখ্য গ্রামে ছড়িয়ে আছে। তাদের আমরা চিনি না। নুসরাত তাদের একজন।

তাহলে কেন নুসরাতকে নিয়ে এত কথা, এত আহাজারি, এত ক্রন্দন! সোশ্যাল মিডিয়ায় কেন এত বেদনার ভার! কারণ নুসরাত সাহসী, প্রতিবাদী। যে সাহস থাকা মেয়েদের জন্য শোভন নয়, দোষের। অন্তত এ সমাজ, এ সংসার সেটাই শিখিয়েছে। যে মেয়ে মুখ বুজে সব মেনে নেয় সে সতী সাবিত্রী বিনয়ী লক্ষ্মী পয়মন্ত। সে যদি মুখ বুজে ধর্ষিত হয় আর তা চেপে যায়, কেউ জানতে না পারে, তাহলে সে সতী। জেনে গেলেই সমস্যা। সে হয় কুলটা। কাজেই চেপে যাও, চেপে যাও, মেনে নাও। তাতেই শান্তি, তাতেই স্বস্তি। কিন্তু নুসরাত নামের বেয়াড়া মেয়েটা চেপে গেল না। মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা তার সম্ভ্রমহানি করতে চাইল, সহজ বাংলায় যাকে বলে ধর্ষণ, সেটাই করতে চাইল। ও ধর্ষিত হলো না মুখ বুজে। বরং অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে একটা মামলা করে বসল। কত বড় সাহস মেয়ের! কত বড়! অধ্যক্ষ গ্রেফতার হলো। মামলা তোলার জন্য উপর্যুপরি চাপ চলল নুসরাতের ওপর। কিন্তু নুসরাত বড়ই বেয়াড়া, একদম অনড়। তার পরই মঞ্চস্থ হলো একটা নাটক। নুসরাতের বন্ধুকে ছাদে ফেলে মারছে- এ সংবাদ পরিবেশিত হলো নুসরাতের কানে বিশ্বাসযোগ্য করে। ছুটে গেল নুসরাত। আর সেখানে ছিল বোরকা ঢাকা চারজন, হতে পারে পুরুষ, হতে পারে নারী, তবে পশু যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওরা হাত-মুখ বেঁধে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দিয়ে মত্ত উল্লাসে বলল, ‘পালা’। নুসরাতের শরীরের ৮৫ ভাগ দগ্ধ হলো। ও পানি খেতে চেয়েছিল, পায়নি। পানি পেলেই কি আর ও খেতে পারত! খাবার অবস্থা ওর ছিল না। গালের ভিতরের পুরোটাই ছিল পোড়া। হাতের ব্যান্ডেজ খুলে দিতে বলেছিল দেয়নি, দেওয়ার অবস্থা ছিল না। মৃত্যুর সঙ্গে ধুঁকল চার দিন। সারা দেশ থমকে রইল, তার জন্য প্রার্থনা করল।

আর হ্যাঁ, এ দেশে কিছু মানুষরূপী পশু আছে যারা অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করল, মিছিল করল। যে বাংলার মাটিতে স্বাধীনতার পতাকা ওড়ে সেই মাটিতে ওরা একজন ধর্ষকের জন্য মিছিল করল বিনা বাধায়, বিনা প্রতিবাদে। এত সাহস ওরা পায় কোথায়, কে জোগায় এ সাহস? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নুসরাতকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠাতে চেয়েছিলেন। ও বড় বিবেচক। রাষ্ট্রের টাকা খরচ না করেই চলে গেল। সারাটা দেশ যেন প্রচণ্ড নাড়া খেল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বিচারের দাবি তুলে কোনো লাভ নেই। কবে হবে বিচার, কত বছরে কত যুগে, কত শতকে? আর এ বিচার তো ফাঁসির দড়িতে হয় না, এ বিচার হতে হয় মানুষের আদালতে। ঠিক যেভাবে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে একইভাবে। কিন্তু হবে কি? কবে হবে? এখন আর আমরা প্রশ্নও করি না, বিচারের প্রতীক্ষাও করি না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি মেনে নিতে নিতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বিচার হয় না বলে তেমন কোনো ক্ষোভও হয় না আমাদের। ভাবি, এটাই স্বাভাবিক, এটাই নিয়ম। অগুনতি মেয়ের মৃত্যুর মিছিলে নুসরাত একজন। মিছিলের আগে যারা রয়েছে ওদের মৃত্যুরও বিচার হয়নি, নুসরাতের হবে কী করে?

কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে, এ দেশেই যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে। বাঘা বাঘা যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়েছে। যা হবে না বলে অনেকেই সন্দিহান ছিল। অনেকে বলত বিচারের নামে প্রহসন চলছে। কিন্তু সব সন্দেহ মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে স্বাধীনতার ৪৭-৪৮ বছরে যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়েছে নির্বিঘ্নে। ওদের যদি ফাঁসি হতে পারে তাহলে এ ধর্ষকদের ফাঁসি হওয়া, আগুনে পোড়ানো বা পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা কি এতই কঠিন? একদমই কঠিন নয়। প্রয়োজন সদিচ্ছা আর কঠিন কঠোর প্রতিজ্ঞা। আমাদের সরকার পারে সেটা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে দেখিয়েছে। তাহলে এ চুনোপুঁটি ধর্ষকদের, খুনিদের, বিশ্বাসভঙ্গকারীদের বিচার হবে না কেন?

একটা বিষয় ভেবে বিস্মিত হতে হয়, ধর্ষকের পক্ষে এত মানুষ! এরা কারা! মিছিলে অনেক নারীও ছিল। ওদের খুঁজে বের করা, চিহ্নিত করা কি এতই কঠিন। ন্যায়-অন্যায় না দেখে যে কোনো একটা ইস্যু পেলেই মিছিল করা যাবে এ কেমন কথা? ধর্ষকের পক্ষে, হত্যাকারীদের পক্ষে মিছিল হলো আর প্রশাসন বসে বসে দেখল, আনন্দও পেল বোধহয়!

মাদ্রাসা শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। নুসরাতের ঘটনার মাঝেই এক মাদ্রাসার সুপার দুজন বালককে ঘরে ডেকে বলাৎকার করেছে। ওদের কুকীর্তির শেষ নেই। ধর্ষণ, বলাৎকার সম্ভ্রমহানিতে একশ্রেণির মাদ্রাসা শিক্ষক যে চ্যাম্পিয়ন তা প্রমাণিত হয়ে গেছে। যে শিক্ষাধারাটি নিয়ে এত বিতর্ক, এত অভিযোগ, এত সমস্যা তাকে জিইয়ে রাখা কি এতটাই জরুরি? মাদ্রাসা শিক্ষা আমাদের এমন কী দিচ্ছে যা প্রচলিত ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা দিতে অপারগ? আমি বলছি না যে, বাংলা বা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের কেন্দ্র করে এমন কোনো ঘটনা ঘটে না। ঘটে তবে তুলানামূলকভাবে সংখ্যা অনেক কম। আর নীতিবোধ বা ধর্মীয় শিক্ষার জন্য যদি মাদ্রাসাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তবে আমি বলব, পরিবারের চেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর নেই। আমরা নীতিবোধ আর ধর্মীয় শিক্ষা বাড়িতেই পেয়েছি। সেটা অনুসরণ করেই চলেছি। আমার ধারণা, এখনো যে কোনো পরিবারেই কমবেশি নীতি-আদর্শ আর ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। সেজন্য আলাদা একটা শিক্ষাধারা চালু রাখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তার পরও কেন আপনার সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়াতে হবে, সে ছেলে হোক বা মেয়ে? অভিভাবকরা, আপনারা কবে সচেতন হবেন। আর কতজন নুসরাত মারা গেলে আপনাদের নিদ্রাচ্যুতি ঘটবে? নুসরাত তো ধর্মীয় অনুশাসন মানত, হিজাব পরত, কেন ওকে বাঁচাতে পারলেন না?

রাষ্ট্রের কাজ পুরুষ-নারী নির্বিশেষে নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু রাষ্ট্র কতটা নিরাপত্তা দিতে পারছে! তনু, মিতু, রিসা নিরাপত্তা পায়নি। পায়নি নিহার বানু, রুনি, শারমিন রিমা। ভবিষ্যতেও পাবে না। ওরা নিরাপত্তা পায়নি, অনেকের হত্যার বিচারও হয়নি। আমরা কি জানি মিতুর সন্তান দুটো, রুনির ছেলেটা কেমন আছে, কোথায় আছে?

নারীর প্রতি সহিংসতা অবিচার রন্ধ্র্রে রন্ধ্রে। তার শারীরিক অংশটা আমরা দেখি। কিন্তু মানসিক সহিংসতা আমরা দেখি না, দেখা যায় না। আমাদের মেয়েদের ওরা পুড়িয়ে মারে, গলা টিপে মারে, গুলি করে মারে, ফ্যানে ঝুলিয়ে মারে, পিটিয়ে মারে, বিষ খাইয়ে মারে। আমাদের মেয়েদের ওরা মারে প্রতারণা করে, বিশ্বাসভঙ্গ করে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। ওরা সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। ওরা কেউ লুঙ্গি পরে, কেউ পায়জামা, কেউ প্যান্ট, কেউ স্যুট-টাই, পকেটে লাল রুমাল গোঁজে। ওরা বড় বড় খুনি, বড় বড় লুটেরা, বড় বড় অভিনেতা। নিজের চারপাশটা রঙ্গমঞ্চ বানিয়ে ওরা সারাক্ষণ হাসে-কাঁদে। ওরা সর্বদলীয়, সর্বধর্মীয়। ওরা একবার বঙ্গবন্ধুর জন্য, একবার খালেদার জন্য কাঁদে, একবার কাঁদে এরশাদের জন্য। একবার ওরা নাস্তিকতার বুলি কপচায় আর একবার হজ করে বকধার্মিক হয়। ওরা রিকশাওয়ালা, মুটে, মজুর, চাকরিজীবী, পেশাজীবী, ওরা সাংবিধানিক পদেও আসীন। ওদের বিরুদ্ধে কে কথা বলবে, কীভাবে কথা বলবে। কার এত সাহস। ওদের টাকা, ক্ষমতা, নোংরামি আর নৃশংসতার ভয়ে মেয়েরা কাঁপে। আমরা কাঁপি। তাই আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় দু-চারটি স্ট্যাটাস লিখি বড়জোর, তাও ভয়ে ভয়ে । তারপর চুপসে যাই কী জানি কী হয়। কে কোথায় রাগ করে, বিচারের আওতায় পড়ি কিনা। নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমরা আস্তে পেছনে সরে যাই। বুকে কষ্ট পুষি, রাগ পুষি। বলতে পারি না ভয়ে।

এভাবেই আস্তে আস্তে চাপা পড়ে যায় নুসরাতের কথা, রিসার কথা মিতুর কথা। আমরা ওদের ভুলে যাই। ভুলে যাব। এটি আমাদের মেয়েদের ললাটের লিখন।       

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর