বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

মোদির প্রতি ইমরান খানের দরদ কেন!

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মোদির প্রতি ইমরান খানের দরদ কেন!

ভারতের গণতন্ত্র উৎসবে সাত দফার মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা শেষ। তিন দফায় ৫৪৩ আসনের মধ্যে --- টির ভোট হয়ে গেছে, জনগণ তাদের ইভিএমের মধ্যে রায় রেখে দিয়েছে। --- টির মধ্যে ১০টি আসন ছিল পশ্চিমবঙ্গের। টিভির পর্দায় যা দেখা গেছে তাতে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, বঙ্গেশ্বরীর দল তৃণমূল কংগ্রেস ২০১৮ সালে যে ধাঁচে পুলিশ ও মস্তানদের ব্যবহার করে গুলি চালিয়ে বুথ দখল করেছিল সে ধাঁচটাই বহাল রেখেছে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরবর্তী ৩২টি আসনেও মমতার ঠ্যাঙারে বাহিনী একই ধাঁচে নির্বাচন করতে চলেছে। মমতার উপদেষ্টা সাবেক ডিজিপি নগরজিৎ মুখার্জি ঠারেঠোরে স্বীকার করেছেন, ভোট কারচুপির নেপথ্যে মমতার যে কমিটি আছে তিনিই তার নায়ক। অবসর নেওয়ার পর অস্বাভাবিকভাবে তাঁর চাকরির মেয়াদ (যা সরকারি চাকরিতে হয় না) ১২ বছর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি জোর গলায় বলেন, দিদি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমারও তো দিদির জন্য কিছু করতে হবে। রাজনৈতিক মহলের প্রশ্নÑ তিনি একটি গণতান্ত্রিক দেশে এ রকম সাহস কী করে পান। তার কর্মকান্ড নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত একাধিক ডিজিপির সঙ্গে কথা বলেছি। তারা অভিযোগ করেন, ‘ন্যাপা যা করছে তা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক আর দিদি তাকে দিয়ে তা-ই করাচ্ছেন।’ নগরজিৎ মুখার্জিকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি একগাল হেসে বলেন, দিদির জন্য এটুকু করতেই হবে। কারণ দিদি তো আমাকে ১২ বছরের এক্সটেনশন দিয়েছেন। নৃপেনবাবু বর্তমানে মানবাধিকার কমিশনের সদস্য। ডান-বাম সব বিরোধী দল ন্যাপার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানিয়েছে।

উত্তরবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে মমতা কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করে বলেন, কংগ্রেস তৃণমূলকে হারানোর জন্য গোপনে আরএসএস ও বিজেপির সঙ্গে আঁতাত করেছে। তার ৩০ মিনিটের মধ্যে উত্তরবঙ্গে নির্বাচনী সফরে এসে রাহুল গান্ধী মমতার অভিযোগের উত্তরে বলেন, ‘বঙ্গাল জানে ভারতবর্ষ জানে মমতা এবং তাঁর তৃণমূল দল বিজেপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে বাজপেয়ির মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। ২০০৪-এ কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় এলো তখন বিজেপির সঙ্গেই সংসদে বসেছিলেন। এর বেশি প্রমাণ আমি দিতে চাই না।’ মমতা তার সভা থেকে আঙ্গুল তুলে অভিযোগ করেন- ‘প্রণবের ছেলে অভিজিৎকে আরএসএস সমর্থন করছে।’ বঙ্গেশ্বরীর বক্তৃতায় প্রণব দাদা, প্রণববাবু বা সাবেক রাষ্ট্রপতি না বলে সরাসরি ‘প্রণব’ বলে উল্লেখ করায় তার প্রতিবাদ করেছেন প্রণবপুত্র অভিজিৎ ও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র। সোমেন মিত্র আরও বলেছেন, বাংলার একটা শিক্ষা ও সংস্কৃতি আছে। অর্ধশিক্ষিত লোকেরা কী বলল না বলল তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে চাই না। প্রণবদা একজন সম্মানীয় রাজনীতিবিদ। মমতার উত্থানের পেছনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য, যা বঙ্গেশ্বরী স্বীকার করেন না।

এদিকে রাজনৈতিক মহলে অভিযোগ উঠেছে, অতিসম্প্রতি বিজেপির একজন প্রথম শ্রেণির ব্যবসায়ী শিশির বাজোরিয়ার দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের অবজারভার বিজয় বর্গীয় ও মমতার ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের (ববি) মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। এ গোপন বৈঠকের খবরটি সিপিএমের দৈনিক গণশক্তিতে প্রকাশ হওয়ার পর গোটা রাজ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। এ গোপন বৈঠকে স্থির হয়েছে, ৪২ আসনেই কংগ্রেস বা বামপন্থিরা শক্তিশালী। যেখানে শক্তিশালী মনে হবে সেখানে বিজেপির ভোট তৃণমূলকে দেবে আর তৃণমূলের ভোট বিজেপিকে দেবে। এই লেখার সময় পর্যন্ত বিজেপি ও তৃণমূল কেউ ওই বৈঠকের কথা স্বীকার করেনি। ভারতের চলতি নির্বাচনী পরিস্থিতি কেমন? মোদি ক্ষমতায় ফিরবেন নাকি রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে জোট ক্ষমতায় ফিরবেÑ এ নিয়ে মিডিয়াগুলো সারা দেশে সোচ্চার। এদিকে ভোটের ‘পরীক্ষা’ শুরুর আগে নরেন্দ্র মোদির সামনে ইমরান খান কঠিন প্রশ্নপত্র তুলে ধরলেন। তাঁর মতে, বায়ুসেনার বালাকোট অভিযান নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তুললেই তাদের ‘পাকিস্তানের বন্ধু’ বলে মোদি দাবিয়ে দিয়েছেন। ঝাঁক ঝাঁক বিদেশি সাংবাদিকের দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাক প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, লোকসভা ভোটে বিজেপি জিতে ফিরলে তবেই ভারত-পাক শান্তি আলোচনার সম্ভাবনা থাকবে। ইমরানের মতে, ভারতের পরবর্তী সরকার যদি কংগ্রেস হয় তবে সে ক্ষেত্রে তারা হয়তো দক্ষিণপন্থিদের প্রতিরোধের ভয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীর নিয়ে কোনো সমঝোতায় যেতে ভয় পাবে। তাই দক্ষিণপন্থি দল বিজেপি ক্ষমতায় এলে কাশ্মীর নিয়ে কোনো একটা সমঝোতায় পৌঁছানো যাবে। নির্বাচনী প্রচারে কৃষি, চাকরির চেয়ে জাতীয়তাবাদকেই মোদি প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু পাক প্রধানমন্ত্রী বিজেপির প্রত্যাবর্তন চাওয়ায় বিজেপি বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে। কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালার টুইট- ‘প্রথমে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে “পেয়ার”, এখন ইমরান খান “ইয়ার”।’ আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল লিখেছেন- ‘পাকিস্তান মে মচা শোর, নরেন্দ্র মোদি ওয়ান্স মোর।’ ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লার কথায়- ‘মোদি সাহেব কিনা বলছিলেন, শুধু পাকিস্তান ও তার সহকর্মীরাই বিজেপির হার চাইছে।’ সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির মন্তব্য- ‘একমাত্র ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, যিনি সেনাঘাঁটিতে আইএসআইকে ডেকে এনেছিলেন এবং বিনা নিমন্ত্রণে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন।’

আকস্মিকভাবে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ওই বিবৃতি দিলেন কেন, এ প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক একাধিক কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মধ্যে সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননও আছেন। তাঁরা মনে করেন, পাকিস্তানের গোয়েন্দা চক্র আইএসআই ও আমেরিকার গোয়েন্দা চক্র সিআইএর একটা গোপন সম্পর্ক আছে, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় থেকে। ট্রাম্প প্রশাসন চাইছে মোদিকে আবার ক্ষমতায় বসাতে। তারা চাইলেও তো হবে না। কূটনীতিবিদরা মনে করেন, এ দেশের ৯৫ কোটি ভোটারই ঠিক করবেন কে ২৩ মে সাউথ ব্লকে বসবেন- মোদি না রাহুল? এদিকে মোদি ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো যেভাবে ধ্বংস করছেন সে ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে মহারাষ্ট্রের স্ট্রং ম্যান শারদ পাওয়ার বলেছেন, মোদি হলেন জাতীয় বিপর্যয়, আর পশ্চিমবঙ্গের মমতা হলেন শ্রেষ্ঠ মিথ্যাচারিণী। একদিকে তিনি রাহুলের আদ্যশ্রাদ্ধ করছেন আর তার মা সোনিয়া গান্ধীর কাছে মাঝে মাঝে দূত পাঠাচ্ছেন- রাহুল যদি সরকার গঠন করেন তাহলে তিনি রাহুলের সঙ্গে সরকার গঠনে সহযোগিতা করতে পারেন। সোনিয়া গান্ধী অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখাননি। সোনিয়া গান্ধী রায়বেরিলিতে নিজের মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে মোদি ও মমতাকে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তা হলো- অটল বিহারি বাজপেয়ির মন্ত্রিসভায় দুজনই বলেছিলেন ২০০৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় ফিরবে। কিন্তু দেশের জনগণ তাদের সেই আশায় জল ঢেলে কংগ্রেসের কোয়ালিশন সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। আর কোয়ালিশন সরকার দীর্ঘ ১০ বছর রাজত্ব করেছে।

            লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর