বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

সরকারের নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ কম!

ড. শেখ আবদুস সালাম

সরকারের নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ কম!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লাউঞ্জে বসে কয়েকদিন আগে কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আড্ডায় যথারীতি রাজা-উজির মারা থেকে ডাকসু নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, ঢাকা শহরে যত্রযত্র আগুন লাগা, দেশে দুর্ঘটনার হার দিন দিন বেড়ে যাওয়া-  হরেক কিছু নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। এমন সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে পেপার-প্রবন্ধ উপস্থাপন করে অনেক সময় সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যত্যয় বাতলিয়ে করণীয় সম্পর্কেও কথাবার্তা বলেন আমাদের এমন একজন সহকর্মী এসে উপস্থিত হলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের এই সহকর্মীর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সাখাওয়াৎ আনসারী) লেখালেখির একজন নিয়মিত পাঠক। অধ্যাপক আনসারী সম্ভবত তা জানেন। উনি মাঝেমধ্যেই তার লেখালেখির ব্যাপারে অথবা আমিও যৎসামান্য লেখালেখি করি বিধায় আমাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হলে সেসব ব্যাপারেও মতবিনিময় হয়। অধ্যাপক সাখাওয়াৎ বেশ কিছুদিন আগে পত্রপত্রিকায় লেখা তার কিছু প্রবন্ধ নিয়ে রচিত তার একটি বই আমাকে উপহার দিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে দু-একটি বিশেষ লেখা অন্তত যেন আমি পড়ি সে ব্যাপারে অনুরোধ জানিয়েছিলেন (তিনি ঠিকই বোধ হয় জানেন যে, আজকাল কাউকে বই-পুস্তক দেওয়া ওই দেওয়া পর্যন্তই। কতটুকু তিনি পড়বেন বা আদৌ তা উল্টাবেন কিনা সে আশঙ্কা লেখকের থেকেই যায়)।

যাই হোক, আমি অধ্যাপক সাখাওয়াৎ আনসারীর দেওয়া ‘ভাষার কথকতা’ বইটির বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ পড়েছি। এখানে প্রতিটি প্রবন্ধ গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ বইয়ে একাধিক লেখা রয়েছে যা আমাদের দেশ এবং জাতিকে খানিকটা হলেও সরাসরি স্পর্শ করে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। যেমন- বইটিতে একটি লেখা বা প্রবন্ধ রয়েছে ‘জেলার নাম সংশোধন পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব’। লেখাটি ২০১৮ সালে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত হয়েছিল। এ বইয়ে লেখক উল্লেখ করেছেন যে, প্রায় অবিকল এসব তথ্য দিয়ে ২০০৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোয় তিনি ‘জেলাগুলোর কাক্সিক্ষত উচ্চারণ ও বানান’ এই শিরোনামে তার এ-বিষয়ক প্রথম লেখাটি লিখেছিলেন। তার লেখালেখি নিয়ে তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বললেন, এসব লেখা কেবল লেখাই সার, এসব কোনো কাজে আসে বলে মনে হয় না। তার ভাষায়-  এসব লেখায় ‘কাজের কাজ কিছুই হয় না, কে শোনে কার কথা? সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের লোকজন কি এসব লেখা পড়েন? আর পড়লেও তারা কতটুকুই বা কেয়ার করেন? কেউ কোনো দিন ডেকেও জিজ্ঞাসা করেন না বা জানতে চান না যে আসুন, বিষয়টি নিয়ে আমরা একটু তর্ক-বিতর্ক কিংবা কিছু একটা করি।’ আমি অধ্যাপক আনসারীর এই খেদোক্তির সঙ্গে সহমত পোষণ করি। আসলেই এসব লেখালেখি নিয়ে সরকার বা সংশ্লিষ্ট দফতর/পরিদফতরের কেউ কেয়ার করেন বলে মনে হয় না। অতিসম্প্রতি প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসসংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি দেশের পাঁচটি জেলার নামের ইংরেজি বানান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। জেলা পাঁচটি হলো- চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বগুড়া, যশোর ও বরিশাল। এগুলোর পূর্বতন ইংরেজি বানান Chittagong, comilla, Bogra, Jessore Ges Barisal- এর স্থলে নতুন বানান নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে Chattogram, Cumilla, Bogura, Jashore Ges Barishal। জেলাগুলোর ইংরেজি বানান জেলাগুলোর উচ্চারণ ও বাংলা বানানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না বিবেচনায় সমস্যার প্রতিবিধান হিসেবে কমিটি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অধ্যাপক আনসারী তার লেখায় পাঁচটি পরিবর্তিত বানানের মধ্যে Barishal -এর সঙ্গে একমত পোষণ করলেও বাকি চারটি বানান নিয়ে কিছু ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। তার মতে, পরিবর্তিত বানান Chattogram এবং Barishal না হয়ে কাক্সিক্ষত ছিল যথাক্রমে Chattogram এবং Barishal । তিনি বলতে চাইছেন উচ্চারণে ‘চট্টগ্রাম’ এবং ‘বোগুড়া’ বিবেচনায় উভয় ক্ষেত্রে ধ-এর স্থলে ড় ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে মৌলিক প্রশ্নগুলো ইংরেজি বানান উচ্চারণনির্ভর, নাকি বাংলা বানাননির্ভর হবে? তার মতে, নতুন জটিলতা এড়াতে চাইলে এটি বাংলা বানাননির্ভর হওয়াই ভালো। ইংরেজি a -এর উচ্চারণ ‘অ’ ( যেমন : all , উচ্চারণ - অল্) এবং ‘ও’ ( যেমন : Karim উচ্চারণ-কোরিম) দুই-ই হয়। এজন্যই ধ ব্যবহারেই আমরা ‘ও’ উচ্চারণ পেয়ে যাই। এ নিয়মেই Chattagram  এবং Bagura হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ নিয়ম বহুল প্রচলিতও বটে। এ দুটিতে o (ও) ব্যবহার করলে বহু বানানই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে লিখতে হয় : Foridpur, Hobiganj, Potuakhali, Shoriatpur  ইত্যাদি। শ্রেষ্ঠ উদাহরণটি হলো- পরিবর্তিত বানান Borishal  করা হয়নি, করা হয়েছে Borishal । এভাবে আরও কিছু ব্যাকরণগত বিবেচনায় সমস্যা শুধু এ পাঁচ জেলার বানানেই আছে, এমন নয়। সমস্যা আছে আরও বেশ কয়েকটি জেলার বানানেও। অধ্যাপক আনসারী তার লেখায় এভাবে বেশকিছু বিষয়ের অবতারণা করেছেন, যা সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা বিবেচনায় নিতে পারতেন।

অধ্যাপক আনসারীর আরও একটি লেখা- ‘৭ই মার্চের ভাষণ, সংবিধান ও আমাদের দায়’। লেখাটি ৯ মার্চ, ২০১৮ তারিখ দৈনিক সমকালে প্রকাশিত হয়েছিল। এ লেখায় লেখক উল্লেখ করেছেন যে, আমাদের সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি তফসিলভুক্ত (৫ম) করা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মূল ভাষণের সঙ্গে সংবিধানে তফসিলভুক্ত ভাষণের বেশকিছু বৈপরীত্য রয়েছে। যেমন : ভাষণে আছে ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।’ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ভাষণে ‘খুলনা বেমালুম বাদ পড়ে গেছে। ভাষণে আছে : ‘এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।’ সংবিধানে হয়ে গেছে ত্রুটিপূর্ণ ‘অর্থনীতি’ ও ‘রাজনীতি’। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হলেও শ্রদ্ধা পোষণে বঙ্গবন্ধুর ঘাটতি ছিল না বলেই তিনি তার ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন, ‘ইয়াহিয়া খান সাহেব’ এবং ‘ভুট্টো সাহেব’। ভাষণে সাহেব শব্দটি নেই। লেখক আমাকে বলেছেন যে, এমনকি ভাষণের ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদেও নাকি কিছু ভ্রান্তি রয়েছে। আমরা মাঝেমধ্যে দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায় লিখি। বাংলাদেশের গণমাধ্যম তা ছাপেও ঠিকই। কিন্তু প্রধান স্টেকহোল্ডার হিসেবে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা গণমাধ্যমে প্রকাশিত লেখালেখি বিশেষ করে মতামতধর্মী লেখাকে কতটা আমলে নেন তার কোনো স্টাডি এ মুহূর্তে আমার হাতে নেই। তবে সাধারণভাবে অনেক সময় মানুষকে বলতে শুনি টিভিতে ‘বকাউল্লাহরা’ বা সংবাদপত্রের ‘লেখাউল্লাহরা’ তাদের কাজ তারা করেন। আর সরকার বা কর্তৃপক্ষীয় দিক থেকে সরকারের বা কর্তৃপক্ষের যা মনে ধরে, যা তাদের সুবিধা হয় বলে মনে হয় তারা সেভাবেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করেন। ওপরে অধ্যাপক আনসারীর যে দুটো বিষয় নিয়ে লেখা উল্লেখ করেছি তা যেমন খুবই গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সংবেদনশীলও বটে। কিন্তু প্রথম আলো বা সমকালের মতো পত্রিকায় বিষয় দুটি নিয়ে লেখা হলেও এ নিয়ে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কেউ কোনো দিন তার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেননি অথবা বিষয়টি সম্পর্কে কোনো উদ্যোগের কথাও আমাদের জানা নেই। জেলার নামের বানান ব্যাকরণসম্মত এবং শুদ্ধ হওয়াই তো বাঞ্ছনীয়। বঙ্গবন্ধুর মূল ভাষণ থেকে সংবিধানে সংযুক্ত হওয়া ভাষণের মধ্যে ব্যত্যয় থাকবে কেন? যারা এসব ব্যত্যয় ধরিয়ে দেন তাদের লেখা সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা পড়বেনই বা না কেন? প্রয়োজনে এসব লেখকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যথার্থ ব্যবস্থাই বা কেন নেবেন না?

শুধু অধ্যাপক সাখাওয়াতের লেখা নয়। মনোযোগ দিয়ে দেখলে এমন আরও অনেক মতামত ও বিশ্লেষণধর্মী লেখা পাওয়া যাবে। ব্যক্তিগতভাবে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক যেমন : বাংলাদেশ প্রতিদিন, সমকাল, ইত্তেফাক, সংবাদ ইত্যাদিতে আমি শতাধিক লেখা লিখেছি। তার মধ্যে মত-আশ্রিত দুটি লেখার কথা অন্তত আমার মনে আছে। পাঠক, একটু খোঁজ নিয়ে দেখলে জানতে পারবেন, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিস্তম্ভের ফলকে লেখা আছেÑ ‘যতকাল রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান...’ অথচ টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিফলকে লেখা আছে- ‘যতকাল রবে পদ্মা, যমুনা, গৌরী, মেঘনা বহমান...’। অর্থাৎ দুই জায়গায় দুই রকম পাঠ। কিন্তু কেন? গৌরী প্রসন্নের যে কোনো একটি পাঠকে অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর সব স্মৃতিফলকে যেখানে এটি লেখা থাকবে তা এক থাকবে না কেন? ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমি এ বিষষে লিখেছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক কিংবা নীতিনির্ধারক কোনো কোয়ার্টার থেকে এ নিয়ে কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পাইনি। আমার আগে মোহাম্মদ হান্নানও এমন একটি লেখা লিখেছিলেন। এসবের পরও স্মৃতিস্তম্ভগুলোয় আগে যে পাঠ-উদ্ধৃত ছিল এখনো তাই-ই রয়ে গেছে। একইভাবে ২০১৬ সালের ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বিকল্প ভাবনা’ শিরোনামে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অবস্থানগত উপযোগিতা এবং মনোশঙ্কা নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। এ লেখার ওপর পক্ষে-বিপক্ষে মতামত জানিয়ে দেশ-বিদেশ থেকে বহুজনের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি ইমেইল পেয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলো থেকে কেউ কোনো দিন এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন বলে আমার জানা নেই। গণমাধ্যম হচ্ছে সমাজের দর্পণ। দায়িত্বশীল গণমাধ্যমে জাতীয় কোনো ইস্যুতে কিছু প্রকাশিত হলে পাঠক, বুদ্ধিজীবী, শাসক বা সেবক, নীতিনির্ধারক সবার মধ্যে তা আলোচিত হওয়াই উত্তম। এসব ব্যাপারে প্রয়োজনে তারা কখনো কখনো লেখক বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিজ্ঞ মানুষের সঙ্গে কথা বললে ভালো বৈ কোনো ক্ষতি হয় না। দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে সে উদ্যোগ থাকা জরুরি।

লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর