শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

অসাম্প্রদায়িকতার জয় হোক

নূরে আলম সিদ্দিকী

অসাম্প্রদায়িকতার জয় হোক

শুধু এ উপমহাদেশেই নয়, সারা বিশ্বের বুকে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই তার সযত্ন লালিত্যে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার বা স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন সৃষ্টির উদগ্র প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের পাদপীঠে একটি সুসংহত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তিলে তিলে সহনশীলতার হিমাচল হিসেবে কংগ্রেসকে প্রতিস্থাপিত করা হয়। এটা সৌভাগ্যের দৃষ্টান্তস্বরূপ উদ্ধৃত করা যায়, উমেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি কংগ্রেসের জন্মের ঊষালগ্নে সভাপতির দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন, তিনি ছিলেন এক বঙ্গসন্তান। এ বাংলার উদ্ধত বিবেক, উদ্গত সত্তা, উদ্বেলিত মননের একটি জাগ্রত দৃষ্টান্ত। কংগ্রেস বললেই গান্ধীজি এবং নেহেরু পরিবারের প্রভাবটা এমন বিস্তীর্ণ অবয়বে এসে যায় যেন মনে হয়, কংগ্রেস মানেই মহাত্মা গান্ধী এবং নেহেরু পরিবারের একটি শরিকানা সম্পত্তি। কংগ্রেসে তাদের পরিবারের প্রভাব তাদের সযতেœ লালিত্য প্রখর প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মির মতো আলো ছড়ানো অবদানকে কখনই অস্বীকার করা যাবে না। তবু ভাবতে ভালো লাগে, সূর্যের বিকীর্ণ অগ্নিকণায় হৃদয়টি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, এ কংগ্রেসের মতো গণতান্ত্রিক সংগঠনটি বিনির্মাণের কারিগর ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উমেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, রমেশ চন্দ্র দত্ত, লালমোহন ঘোষের মতো প্রথিতযশা বঙ্গসন্তানরা।

সেই স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন থেকে শুরু করে দীর্ঘকাল ধরে ভারতকে শুধু রাজনৈতিকভাবে শাসনই নয়, অযুত-নিযুত ভারতবাসীর গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক মননশীলতা বিনির্মাণে কংগ্রেস নিরলস কারিগরের মতো কাজ করে গেছে। কংগ্রেস মানেই গান্ধী ও নেহেরু পরিবারের এজমালি সম্পত্তি নয়, বরং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, মতিলাল নেহেরু, জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাসবিহারী ঘোষ, দাদাভাই নওরোজি, মাহমুদ আলী, শওকত আলী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখের সযত্ন লালিত্যে ও নেতৃত্বে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার দাবির পাশাপাশি সর্বভারতে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে নিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসেবেই শুধু নয়, একটি প্রতিষ্ঠানরূপে গড়ে ওঠে কংগ্রেস। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের যে কোনো ছাত্র স্বীকার করতে বাধ্য যে, কংগ্রেস শুধু একটি রাজনৈতিক সংগঠনই নয়, একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান (political institution)। ১৮৮৫ সালে জন্মগ্রহণ থেকে পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনা পর্যন্ত ৬২ জন গণতান্ত্রিক মহিরুহ কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তারা সবাই বরেণ্য রাজনীতিবিদ ছিলেন। তা সত্ত্বেও তারা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেসের মহাবিদ্যালয়ের বা বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকজন মহান শিক্ষক। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তো বটেই, সারা ভারতের মহামানবের সাগরতীরে দাঁড়িয়ে তারা মানুষের গণতান্ত্রিক মনন সৃষ্টির যে সূক্ষ্ম কারিগরের অভাবনীয় ভূমিকা পালন করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া ভার।

দলের মধ্যে যেমন ঐক্য ছিল প্রচ-, তেমনি আদর্শগত মতানৈক্যও ছিল প্রবল ডান-বাম, গণতন্ত্র এবং বিপ্লবী মতাবলম্বীদের সমন্বয়ে কংগ্রেস ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের অভিন্ন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়। স্বাধীনতার পাদপীঠ বিনির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে তদানীন্তন ভারতবর্ষের বিশাল জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক মনন সৃষ্টিতে কংগ্রেস নেতৃত্বকে নিরলস অধ্যবসায়ের সঙ্গে কাজ করে এগিয়ে যেতে হয়। দাদাভাই নওরোজি, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী; অন্যদিকে করমচাঁদ গান্ধী, মতিলাল নেহেরু, জওহরলাল নেহেরু, উমেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু।

এদের রাজনৈতিক মননে, চিন্তায় ও আদর্শে সুস্পষ্ট বিরোধ থাকলেও পরাধীন ভারতে কংগ্রেস সব মতকে একটি বক্ষে লালন করেই দৃপ্ত পদক্ষেপে স্বাধীনতার সুদীর্ঘ পথে এগিয়ে গেছে এবং ব্রিটিশকে তাড়িয়ে স্বরাজ অর্জন করেছে।

এখন ভারতের বিশাল নির্বাচন-যজ্ঞ চলছে। আবারও বললে অত্যুক্তি হবে না, সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় নির্বাচন-যজ্ঞ এবং স্বাধীনতার পর ভারতের ২০তম জাতীয় নির্বাচন। বলার কোনো অবকাশই রাখে না, ভারতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বিপ্লবী সংগঠনের কোনো অভাব নেই। তারা মনে করেন, বন্দুকের নলই ক্ষমতার একমাত্র উৎস। চারু মজুমদার, কানু সান্যালদের মতো বিপ্লবী নেতারা নকশালবাড়ী সামন্তবাদীদের হত্যা করে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে গিয়ে শুধু নিদারুণভাবে ব্যর্থই হননি, বরং বাম রাজনীতির কবর রচনা করেছেন। জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা সিপিএমের মাধ্যমে দীর্ঘ ৩৫ বছর পশ্চিমবঙ্গ শাসন করার পরও শুধু পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতা থেকে অপসারিতই হননি, সংগঠনের অস্তিত্বই বিপন্ন করে ফেলেছেন। সিপিএমকে হটিয়ে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস আজ প্রচ- প্রতাপে দুর্দমনীয়ভাবে পশ্চিমবঙ্গের শাসনই শুধু পরিচালনা করছে না, বরং পারিপার্শ্বিকতার ঘোরপ্যাঁচে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, জোট গঠনের প্রক্রিয়াটা ঠিকমতো পরিসমাপ্ত করতে পারলে মমতা ব্যানার্জি দিল্লির মসনদ দখল করে ফেলতে পারেন। এবং সেই স্বপ্নে যে মমতা ব্যানার্জি বিভোর তা বলারই অপেক্ষা রাখে না। পরিবেশটা একটু ঘোলাটে হয়ে উঠেছে, মূল কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাহুল গান্ধী যখন মমতা ব্যানার্জির ও তদীয় ভ্রাতুষ্পুত্রের দুর্নীতির প্রশ্নে সরাসরি আক্রমণ করে বসেছেন। যদিও মোদি হটানোর রাজনৈতিক কর্মকৌশলে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে মমতা ব্যানার্জির এ বিভাজন ও বিভেদ আদৌ কাম্য নয়, বরং কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক পান্ডা গুজরাটের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার খলনায়ক মোদিকেই শক্তিশালী করবে- এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। পশ্চিমবঙ্গের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে নরখাদক মোদি যাতে দাঁত বসাতে না পারেন সে লক্ষ্যেই রাহুল গান্ধীকে পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জিকে ব্ল্যাংক চেক দিতে হবে। মোদি পশ্চিমবঙ্গের যে কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে আসন গেড়ে বসলে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপি আরও আগ্রাসী হয়ে উঠবে। ঠিক তেমনিভাবে দিল্লিতেও রাহুল গান্ধীকে আম-আদমি পার্টির কেজরিওয়ালকে অনেকটা ছাড় দিয়ে হলেও সঙ্গে রাখতে হবে। এ ছাড়া বিহারের নীতিশ কুমার, উত্তর প্রদেশের মায়াবতী, অখিলেশের সঙ্গে সমঝোতা তৈরিতে রাহুল গান্ধীকে অনেকটা সংবেদনশীল মানসিকতা নিয়েই অগ্রসর হতে হবে।

অসাম্প্রদায়িক ভারতবর্ষকে সাম্প্রদায়িক হিন্দুস্তানে রূপান্তরিত করার মোদির যে অশুভ পাঁয়তারা, তাকে রুখতে হলে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রয়োজন। বিশাল গণতান্ত্রিক ভারতের ‘প্লেগ প্রেতাত্মা’ হিসেবেই মোদির আবির্ভাব। শুধু গুজরাটের তিন হাজারের বেশি মুসলিম নিধনের খলনায়কই নন, প্রচ- সাম্প্রদায়িক এই ভদ্রলোক অত্যন্ত কুশলী রাজনীতিক, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। একজন চা-বিক্রেতার একই জীবনে বিশাল ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। সারা বিশ্বকে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তার সাংগঠনিক শৌর্য-বীর্য প্রভাব-প্রতিপত্তির ক্ষেত্রে জওহরলাল নেহেরু ও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার তুলনা করা যেতে পারে। তা সত্ত্বেও এবারের নির্বাচনে তাকে রুখে দেওয়ার একটা প্রচ- সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সম্ভাবনার সিংহদুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীকে তার মা সোনিয়া গান্ধী প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন। রায়বেরেলি আসন থেকে লোকসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সোনিয়া গান্ধী ভারতবাসীকে স্পষ্ট জানান দিয়েছেন ভারতের চলমান রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় থাকবেন এবং সন্তান রাহুল গান্ধীকে অব্যাহতভাবে সব পৃষ্ঠপোষকতা জুগিয়ে যাবেন।

ভারতীয় রাজনীতিতে নেহেরু পরিবারের নিরবচ্ছিন্ন প্রভাবের প্রধান কারণ তাদের পারিবারিক সমঝোতা ও সহযোগিতা। কেবল ইন্দিরা গান্ধীর কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় গান্ধী, যিনি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত, তার স্ত্রী মানেকার রাজনীতি ক্ষমতাশ্রয়ী বলেই তিনি বিজেপি সরকারের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। ইন্দিরা গান্ধীর দুই পুত্রবধূ মানেকা ও সোনিয়া গান্ধীর অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণটির অন্তর্নিহিত রহস্য ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হয়নি। তবে ইন্দিরা গান্ধীর সমর্থন ও আন্তরিকতা যে সোনিয়া গান্ধীর দিকে ছিল তা খুবই স্পষ্ট। অন্যদিকে নেহেরু পরিবারের একজন পুত্রবধূর বিজেপির সঙ্গে সক্রিয় সংশ্লিষ্টতা বিশাল ভারতে পরিবারটির মর্যাদা ক্ষুণœ করেছে- এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এবারের নির্বাচনে ‘সাম্প্রদায়িক ও খুনি মোদিকে ঠেকাও’- এটিই ভারতের প্রগতিশীল রাজনীতির একমাত্র স্লোগান হওয়া উচিত। প্রসঙ্গক্রমে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদিকে আবারও ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখার যে অভিলাষ ব্যক্ত করেছেন এ অভিলাষটি ভারতের মুসলিম ভোটারদের ওপর আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা আমি জানি না। তবে আমি ইমরান খানকে এ মন্তব্যের জন্য ধিক্কার জানাই ও ঘৃণা প্রকাশ করি। মুসলিম নিধনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মোদির প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ ভূরি ভূরি। সারা ভারতের মুসলমানরা মোদির সাম্প্রদায়িক মানসিকতার জন্য আতঙ্কগ্রস্ত। যে কোনো মূল্যে তারা মোদি থেকে পরিত্রাণ পেতে চান। অথচ কার মনঃতুষ্টির জন্য ইমরান খান মোদিতুষ্টির এহেন মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করলেন সেটি এক প্রশ্ন বটে। এর মধ্য দিয়ে তিনি পৃথিবীর আরেক মুসলিমবিদ্বেষী ডোনাল্ড ট্রাম্পের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করলেন কিনা, ভাববার বিষয়।

ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক সম্পর্ক অহি-নকুল। এটি সন্দেহাতীতভাবে সুখকর নয়। কারও কাম্যও নয়। এ নেতিবাচক সম্পর্কটিকে স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টাও চলমান রয়েছে। বিবেকবান ব্যক্তিদের মতো আমিও ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বৈরিতা নয়, বন্ধুত্ব কামনা করি। ইদানীং ভারত-পাকিস্তানের বন্ধুত্ব আমার কাছে অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, দুটি দেশই আজকে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। তাদের মধ্যে মতানৈক্য যুদ্ধের কারণ সৃষ্টি করলে উভয় দেশই শেষ রক্ষাকবচ হিসেবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে; যা এ উপমহাদেশের জন্য আশঙ্কাজনক এবং সবসময়ের জন্যই পরিত্যাজ্য। যে কোনো সাম্প্রদায়িক উসকানিতে মোদি নাটের গুরু বা নারদের ভূমিকা পালন করতে পারেন- এটা অনেকেরই মনের আশঙ্কা। সেখানে তিনি স্বয়ং পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক বা অধিকর্তা হলে ঝুঁকিটা স্বাভাবিকভাবেই আরও বেড়ে যায়।

১১ এপ্রিল ভারতের জাতীয় নির্বাচন শুরু হয়েছে। মোট সাতটি ধাপে এ ভোট গ্রহণ করা হবে। এরই মধ্যে তিন দফা সম্পন্ন হয়েছে। ১৯ মে পর্যন্ত নির্বাচন অব্যাহত থাকবে এবং অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ব্যালট বাক্স সংরক্ষিত রেখেই ২৩ মে সব ভোট গণনা করে ফলাফল ঘোষণা করা হবে। এটিও নির্বাচনের একটি বিস্ময়কর উদ্ভাবন এবং অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। আমাদের দেশের সঙ্গে এ অভাবনীয় দৃষ্টান্তের তুলনা করতে লজ্জা হয় এ কারণে যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক মননে- কী রাজনীতিবিদ, কী প্রশাসনে এ ধরনের স্থিরতা বিশ্বাস, নির্ভরতা, যোগ্যতা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। সম্প্রতি জাতীয় সংসদের অলৌকিক নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, তাতে পৃথিবীর গণতান্ত্রিক সংবাদমাধ্যম, গণতান্ত্রিক দেশগুলো এমনকি জাতিসংঘও উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

গত ৩০ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু ২৯ ডিসেম্বর রাতেই সিল মেরে ব্যালটবাক্স ভর্তি করার হীনমন্যতা প্রদর্শন করা হয়েছে। আরও দুঃখের বিষয়, এ অপকর্মটি জায়েজ করার জন্য নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রশাসন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই নাকি এ অপকর্মটি করেছে বলে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন আছে।

সে যাই হোক, শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে এ অপকর্মটি করা সম্ভব হতো না। নির্বাচনের দিন উন্মুক্ত স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স সব প্রার্থী বা প্রার্থীর মনোনীত প্রতিনিধির সামনে প্রদর্শন করতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে এবং তারপর ভোট গ্রহণ শুরু হয়। কিন্তু এবারের সংসদ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বিএনপি প্রার্থী দিলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিএনপিসহ বিরোধী দলের কোনো এজেন্টই ছিল না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটি সত্য, সরকারি দল বল প্রয়োগ করে বিরোধী দলের এজেন্টদের থাকতে দেয়নি- এ কথাটি বিরোধী দল প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে শেখ হাসিনার কলাকৌশল ষোলকলাই পূর্ণ হয়েছে। বিরোধী দল দুর্বল, ম্রিয়মাণ এবং অনেকটা রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকেই রাজনৈতিক কর্মকান্ডের প্রশ্নে অদৃশ্য। এটি শেখ হাসিনার জন্য পোয়াবারো। কিন্তু দেশের সার্বিক রাজনীতির প্রশ্নে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, বরং অশনিসংকেত।

দলের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থে এ অশনিসংকেতের গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা নেওয়ার দায়িত্ব অবস্থাদৃষ্টে শেখ হাসিনার কাঁধেই অর্পিত হয়েছে। তিনি এটি বুঝতে ব্যর্থ হলে শুধু নির্বাচনব্যবস্থাই নয়, গোটা রাজনীতিই যে ল-ভ- হয়ে যাবে- এটিই অনেকের আশঙ্কা। জাতি তার অস্তিত্ব, গণতন্ত্র ও তার পাদপীঠকে সুসংহত করার প্রয়োজনেই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় আনার প্রচ- তাগিদ অনুভব করছে। এর কোনোরকমের ব্যত্যয় হলে দেশ বিশৃঙ্খলতার আবর্তে তো নিপতিত হবেই, ভ্রান্ত বাম ও রাজনীতিতে সুযোগসন্ধানীরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে উদ্গ্রীব হয়ে উঠবে। এটি মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর