শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

মাটির সুরক্ষায় প্রয়োজন জৈবসার, প্রয়োজন জৈব উদ্যোগ

শাইখ সিরাজ

মাটির সুরক্ষায় প্রয়োজন জৈবসার, প্রয়োজন জৈব উদ্যোগ

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি আমার দেশের মাটি’। সত্যি, আমার দেশের মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি। এ মাটির উর্বরতা বিশে^র বিস্ময় ছিল। নদীবিধৌত পলি জমা উর্বর মাটিতে সহজেই ফলত সোনার ফসল। কিন্তু আমরাই দিন দিন মাটিকে দূষিত করে তুলেছি, নষ্ট করে ফেলেছি এর উর্বরতা। বর্ধিত জনসংখ্যার মুখে খাদ্য তুলে দিতে অধিক ফসল ফলানোর জন্য জমিতে প্রয়োগ করতে হচ্ছে রাসায়নিক সার। অন্যদিকে অধিক কর্ষণে মাটি হারিয়েছে তার উর্বরতা, নষ্ট হয়েছে জৈবগুণ। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে ফসল-বৈচিত্র্য। কিন্তু কোন জমিতে কোন ফসল চাষ করলে কী পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে, সে সম্পর্কে কৃষকের তেমন জানাবোঝা নেই। সত্যি বলতে সরকারের কৃষি বিভাগের লোকজনও এ বিষয়ে সচেতন ছিল না। গত কয়েক বছর ধরেই ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর অনুষ্ঠানগুলোয় আমি কৃষকের কাছে জানতে চেয়েছি তারা মাটি পরীক্ষা করে কিনা। এক শতাংশেরও কম কৃষক বলেছেন তারা মাটি পরীক্ষা করেন। সবচেয়ে হতাশার বিষয়, মাটি পরীক্ষার বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা রাখেন এমন কৃষকের সংখ্যা শতকরা পাঁচজনও পাইনি। অথচ এ মানুষগুলোরই জানা দরকার ছিল জৈব পদার্থই হলো মাটির প্রাণ। শস্য উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা রক্ষার্থে প্রয়োজন মাটিতে শতকরা পাঁচ ভাগ জৈবসার থাকা। এই না জানার কারণে তারা বছরের পর বছর ধরে অতিরিক্ত সার আর কীটনাশক ব্যবহার করেছেন। এতে অধিকাংশ এলাকার মাটির জৈব পদার্থ নেমে এসেছে শতকরা এক ভাগের নিচে, যা ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক বিরাট হুমকিস্বরূপ। আমি আশাবাদী মানুষ, আমি জানি আর সব সংকটের মতো এ সংকট থেকেও আমাদের কৃষক ক্রমে বের হয়ে আসবেন। এর জন্য চাই উদ্যোগ। যারা এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে ভিতরে ভিতরে কাজ করছেন তাদের আমরা ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর নিয়মিত অভিযান গ্রো-গ্রিনে অনেকবার তুলে ধরেছি; যা দেশের বহু কৃষক, কৃষি উদ্যোক্তা, তরুণকে অনুপ্রাণিত করেছে। তাদের বুঝতে শিখিয়েছে, আজকের দিনে উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন কৃষিচর্চার বিকল্প নেই। উপায় নেই মাটিকে বাঁচানোর চিন্তা থেকে দূরে সরে আসার। টেলিভিশনের কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো অনুপ্রাণিত করেছে অসংখ্য তরুণকে। তারা কৃষির পরিবর্তনে নিয়েছে নানা উদ্যোগ।

পাঠক! এমন এক উদ্যোগের কথাই আপনাদের বলতে চাই। উদ্যোক্তার নাম কামরুল হাসান রিপন। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানি গ্রামের শিক্ষিত এ তরুণ নিয়েছেন ব্যতিক্রমধর্মী এক উদ্যোগ। তিনি তার একদল বন্ধুকে নিয়ে একদিকে যেমন কৃষককে সচেতন করছেন মাটি পরীক্ষা করে চাষাবাদের জন্য, অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারে সহায়তা দিয়ে তৈরি করেছেন ভিন্নরকম সংগঠন; যা ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানে। আপনাদের সে গল্পই শোনাতে চাই।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে, নাটোরে কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট অনুষ্ঠান ধারণের পরদিন। নাটোর থেকে ভোরে রওনা হলাম রাজশাহীর দিকে। উদ্দেশ্য, কামরুল হাসান রিপনের গ্রিন লাইট প্রকল্প দেখা। রাস্তায় চলতে চলতে চোখ যাচ্ছিল ফসলের মাঠের দিকে। এ অঞ্চলে এখন নানারকম ফসলের সম্ভার। একদিকে যেমন উচ্চমূল্যের ফল-ফসল ড্রাগন, পেয়ারা, মাল্টা চাষ করছেন কৃষক, অন্যদিকে বিদেশি সবজির পাশাপাশি চাষ করছেন ভুট্টা, ধান, পেঁপে, করলা থেকে শুরু করে লাউ-কুমড়াও। গাছে গাছে কাঁচা আম ঝুলে আছে। আর আছে সুপার ফুড শজনে। এখন শজনের ভর মৌসুম। শুধু গাছেই নয়, পথের ধারের বাজারেও চোখে পড়ল আঁটিবাঁধা শজনের।

আড়ানি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হলো। কিন্তু মেঘলা আকাশ, সূর্যের দেখা নেই। দেখা হলো রিপনের সঙ্গে। সুদর্শন উদ্যমী এক তরুণ। বিস্তারিত জানতে চাই তার কার্যক্রম সম্পর্কে। ফসলের মাঠের আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে শুনছিলাম তার জীবনের গল্প। বলছিলেন, কৃষি নিয়ে কাজ করার বীজ তার ভিতর বপিত হয়েছে সেই বিটিভির মাটি ও মানুষ দেখে। তারপর চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এ সবসময়ই চোখ রেখেছেন, খোঁজ রেখেছেন কৃষিতে কোথায় কী হচ্ছে? নতুন কিছু করার সম্ভাবনাটা কোথায় বোঝার চেষ্টা করেছেন তিনি। বিশ^বিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে চাকরি নেন। চাকরি করতে করতেই চিন্তা করলেন নিজে কিছু করার। কৃষির প্রতি তার টান আশৈশব। চাকরি ছেড়ে ২০১৬ সালে শুরু করেছিলেন সবুজের এক অভিযান। সঙ্গে যুক্ত করেছেন এলাকার আরও কয়েকজন কৃষি-অন্তপ্রাণ শিক্ষিত তরুণকে। যাদের সমন্বিত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে ‘গ্রিন লাইট মৃত্তিকা উন্নয়ন লিমিটেড’ নামে জৈব কৃষি সংগঠন। যারা এখন এলাকার মাটির জৈব উন্নয়নসহ কৃষিকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে।

বর্তমানে তাদের এ কর্মপরিধি বিস্তার লাভ করেছে রাজশাহী জেলার আটটি উপজেলায়। গ্রামে গ্রামে মানুষকে একত্রিত করে ধারণা প্রদান করছেন জৈব কৃষি সম্পর্কে। গ্রামের মানুষকে বোঝাচ্ছেন মাটির সুস্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে হবে; যা করতে দরকারি তথ্য ও কৌশল সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন বায়োস্কোপে ভিডিও প্রদর্শন করে। এভাবেই ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে শুরু করেছে জৈব কৃষির তাগিদ। এলাকার কৃষির চিত্র বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রতিদিন এ তরুণ দল ছুটে চলে গ্রাম থেকে গ্রামে। অল্প টাকার বিনিময়ে আবাদি জমির মাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অধিক ও মানসম্মত ফসল উৎপাদনের প্রেসক্রিপশন দেন তারা। এ দলটিকে নিয়ে যাই কৃষকের মাঠে। কৃষকের কাছ থেকেই জানতে চাই কী ভূমিকা রাখছে ‘গ্রিন লাইট?’ পেয়ারা চাষি আমিনুল ইসলাম বলেন, তিন বিঘা জমি লিজ নিয়ে তিনি পেয়ারা চাষ করছেন তিন বছর ধরে। প্রথম বছর বেশ ভালো ফলন হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বছরে এসে ফলন কমে যায়। গত বছর রিপনের দল এসে মাটি পরীক্ষা করে জৈবসার প্রয়োগ করার পরামর্শ দেয়। জৈবসার ব্যবহার করে এ বছর তার ফলন ভালো হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা তার উৎপাদন খরচ কমে গেছে। পেয়ারার আকারও বড় হয়েছে। আগে একটা পেয়ারার আকার হতো ৩০০-৪০০ গ্রাম। এ বছর পাচ্ছেন ৬০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের পেয়ারা। আমিনুলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘উৎপাদন খরচ কীভাবে কমল?’ উত্তরে জানালেন, জৈবসার ব্যবহার করার ফলে রাসায়নিক সার কম দিতে হয়। জৈবসারের খরচ ৬০০ টাকা হলে টিএসপিতে খরচ হতো ১ হাজার ২০০ টাকা। পাশেই ছিলেন পেয়ারা চাষি আতাউর রহমান। তিনি জানান, সাড়ে চার বিঘা জমিতে এ বছর পেয়ারা উৎপাদনে তিনি খরচ করেছেন ৩ লাখ টাকা, আর পেয়ারা বিক্রি করেছেন ১০ লাখ টাকার। জৈবসার ব্যবহারের ফলেই তার পেয়ারার ফলন এ বছর ভালো হয়েছে। পিয়াজ চাষি হিমেল শোনালেন তার লাভের গল্প। তিনি বলেন, জৈবসার ব্যবহারে রাসায়নিক সার যেমন কম প্রয়োগ করতে হয় তেমনি সেচও কম লাগে। এক বিঘা জমিতে পিয়াজ চাষে গত বছর খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। পিয়াজ পেয়েছিলেন ৭০ মণ। এ বছর জৈবসার ব্যবহারের ফলে খরচ হয়েছে ২২ হাজার টাকা। পিয়াজ পেয়েছেন ১২০ মণ।

কৃষকের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল তারা জানেন, ফলন ঠিক রেখে উৎপাদন ধরে রাখতে হলে দরকার মাটি পরীক্ষা করে মাটিতে দরকারি জৈব উপাদান নিশ্চিত করা। আর বিরাট পরিবর্তনটিই নিয়ে এসেছেন রিপন ও তার দল। তবে তরুণ এই কৃষি সংগঠকদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আর্থিক জোগান ধরে রাখা। তারা বলছিলেন, আর্থিক সহযোগিতা পেলে তারা এ কার্যক্রমটিকে আরও দ্রুত ছড়িয়ে দিতে পারতেন। এগিয়ে যেতে পারতেন স্বপ্ন পূরণে বহুদূর।

এই কামরুল হাসান রিপনের মতো শিক্ষিত ও সৃজনশীল তরুণরাই আগামীতে কৃষির হাল ধরবেন। দেশকে নিয়ে যাবেন আরও উন্নত ও সমৃদ্ধির দিকে। কেননা আগামীর কৃষি মানে উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন কৃষি। সেই সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে মুক্তবাজার অর্থনীতি আর বৈরী জলবায়ুর। আর এজন্যই রিপনদের মতো শিক্ষিত উদ্যোক্তাদের এমন উদ্যোগ আরও বেশি প্রয়োজন। হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে এর আগেও দেশের বহু তরুণকে দেখিয়েছি, যাদের একেকজন কৃষিকে আঁকড়ে নতুন নতুন স্বপ্ন দেখছেন। নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে তারা সাফল্যের দিকে এগিয়ে গেছেন। আমার বিশ্বাস, রিপন ও তার দল তাদের স্বপ্ন নিয়ে আরও বহুদূর অগ্রসর হবেন। সব কৃষক মাটি পরীক্ষা করে ফসল ফলাবেন। আর জৈবসার ব্যবহারে মাটিকে ফিরিয়ে দেবেন তার জৈবগুণ। মাটি পাবে আগের উর্বরতা। কৃষকের কণ্ঠে সুর উঠবে- ‘ও ভাই, খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি আমার দেশের মাটি’।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর