সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

উগ্রবাদের জায়গার সন্ধানে সন্ত্রাসীরা

এম জে আকবর

উগ্রবাদের জায়গার সন্ধানে সন্ত্রাসীরা

সঠিক প্রশ্ন না করলে সঠিক উত্তর তো কখনই পাওয়া যাবে না। প্রকৃত ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় কীভাবে তা না শেখা পর্যন্ত সত্যের তাৎপর্যও বোঝা যাবে না। বিভীষিকার সঙ্গে একটা বিশেষণ জুড়ে দিয়ে আমরা তাকে আড়াল করে রাখতে পারি না। এই সময়ে প্রাসঙ্গিক, এরকম একটা উদাহরণ দিচ্ছি।

প্রায়শই আমরা ‘নির্বোধের কাজ’ বলে অভিহিত করে বর্বরোচিত কাজকে নমনীয় করে ফেলি। খুলেই বলি। শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডের দিন যে বিপর্যয় ঘটানো হলো তা ‘নির্বোধের কাজ’ ছিল না। এটা ছিল অপশক্তি চক্রের কাজ যারা জানত তারা কী করছে। প্রাথমিক খবরে বলা হয়, এর জন্য দায়ী তওহীদ জামাত। প্রার্থনারত খ্রিস্টানদের নৃশংসভাবে হত্যার পরিকল্পনা তারা তৈরি করেছে সযত্নে, সমন্বিত কায়দায়। ওদের সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ হত্যার আকাক্সক্ষা চরিতার্থ করাই ছিল ওদের উদ্দেশ্য। তওহীদ জামাত যাদের অনুমোদিত তারা হচ্ছে মালদ্বীপ, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পরিসীমায় কর্মরত দল জামাত। অত্যন্ত শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং অ-রাষ্ট্রের স্বার্থসেবীদের হাতে অস্ত্রসজ্জা, প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নের নেটওয়ার্কভুক্ত এরা। উগ্রবাদের ঠাঁই তৈরি করার উপায় হিসেবে গণহত্যা চালানোর মতলবে সন্ত্রাসবাদীরা যে দীর্ঘ লড়াইয়ের সূচনা করেছিল তারই একটি অধ্যায় হলো শ্রীলঙ্কায় ঘটানো চরম নিষ্ঠুরতা। তাদের উন্মত্ততায় হতাহত লোকজন আর গির্জাগুলোর ধ্বংসস্তূপ বহন করছে ওদের নৃশংসতার স্বরূপ। ওই নিষ্ঠুরতার বলি হয়েছে তিনজন ভারতীয়। তাদের জন্য কাঁদছে আমাদের অন্তর। একটা প্রশ্ন জাগে মনে। আমাদের মন আমাদের অন্তরের অনুগামী হয় না কেন? মর্মন্তুদ ঘটনায় প্রাণ হারানো মানুষগুলোর সৎকার সাঙ্গ হওয়া মাত্রই কেন আমরা ভাবনা-চিন্তার কাজে ক্ষান্ত দিই?

শ্রীলঙ্কায় যে বিরাট ট্র্যাজেডি ঘটে গেল তাকে খাটো করে না দেখেই একটা ভাবনার কথা উল্লেখ করা যায়। নিঃসন্দেহে ভারতও এই সন্ত্রাসীদের হামলার টার্গেট ছিল। সামনের দিনে, বিশেষত উত্তাল ও দশক-নির্ধারণী সাধারণ নির্বাচনের হাওয়ার মধ্যে, কী ঘটবে আমরা জানি না। আত্মসন্তুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। তবে এটা অবশ্যই প্রতীয়মান যে, ইউপিএ শাসনের জমানায় সন্ত্রাসীরা যা দেখতে অভ্যস্ত ছিল, তারা এখন ভারতকে তাদের খেলার ময়দান ভাবে না। তখন প্রতিটি দীপাবলি উৎসবের সময় আমরা তটস্থ হয়ে পড়তাম। প্রতিটি শহরকেই শঙ্কাগ্রস্ত মনে হতো। ২০০৮ সালে মুম্বাই নগরীতে বিভীষিকার পর ড. মনমোহন সিংয়ের নিষ্ক্রিয়তায় সন্ত্রাসীরা উপলব্ধি করে যে জবাবদিহিতার কোনো বালাই তাদের জন্য নেই। ওসব দিন শেষ হয়ে গেছে। সীমান্ত পার হয়ে আসা সন্ত্রাসবাদের জবাব সীমান্তের ওদিকে গিয়ে দিয়ে দেওয়ার রাজনৈতিক দৃঢ়তা ও সামরিক স্নায়ু রয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। যে ব্যাপারটি খুবই অস্বস্তির তা হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি কংগ্রেসের মনোভঙ্গি। দলটির নির্বাচনী ইশতেহারে দেখা যায়, তারা যেসব পদক্ষেপ নেবে তাতে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও প্রতিরক্ষা বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়বে। ভারতের দার্শনিক ঐতিহ্যের চমৎকার একটি দিক হচ্ছে বহুত্ববাদ ও সম্প্রীতিতে বসবাসের ওপর আমাদের অগাধ আস্থা। তাই, গুটি কয়েক লোকের পাপের জন্য আমরা বহুজনকে শাস্তি দিই না। আমাদের দুশমনদের ধারণা, তাদের নির্মম সন্ত্রাসী কাজকর্ম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দিতে পারবে। ওরকম প্রতিটি পরিস্থিতিতে আমরা ক্রোধের বশবতী না হয়ে আমাদের নীতি-আদর্শ দ্বারাই চালিত হয়েছি।

প্রশ্ন হচ্ছে, বহুজনকে আগলে রাখার নামে কংগ্রেস বারবার কেন গুটি কয়েককে রক্ষা করে? বিষয়টি ভাবতে হবে। এটাও ভাবতে হয় যে, কংগ্রেসের চলতি নেতৃত্ব কী আমাদের দেশটাকে নিরাপদ রাখতে পারবে, তারা কী নিরাপদ করতে সত্যিই চায়? ভাবতে হবেই। কারণ একটা ক্যাম্পাসে যারা ভারতকে টুকরা টুকরা করে ফেলার হুমকি সংবলিত স্লোগান দিয়েছিল কংগ্রেস তাদের উদ্ধার করেছে। অনেক বড় একটি সম্প্রদায়ের অল্প কয়েকজন পরশ্রীকাতর সদস্যের বিদ্বেষপূর্ণ জিহাদ শ্রীলঙ্কাকে তাদের যুদ্ধ অঞ্চলের অংশে পরিণত করেছে। হঠাৎ করে নয়, বেশ ভেবেচিন্তেই তারা কাজটা করেছে। তাদের কৌশলের রয়েছে ধারাবাহিকতা। যেখানে হানবে ভাবাই যায় না সেখানেই তারা আঘাত হানে। তাদের বর্বরতার কোনো সীমানা নেই। স্মৃতি হচ্ছে আত্মসন্তুষ্টির প্রধান শিকার। সে জন্যই আমরা ভুলে যাই যে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের ওপর লাহোরে হামলা করেছিল পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসীরাই। দুর্ভাগ্য হলো, জাতীয় বিপর্যয় ঘটানোর আশঙ্কাযুক্ত ওই ব্যাপারটি নিয়ে কলম্বো উচ্চবাচ্য করল না। এর পেছনে যাকে বলা চলে একমাত্র কারণ, তা হলো তোষণ। পরে ২০১৯ সালে যা ঘটল তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।

সন্ত্রাসবাদীদের দুনিয়ায় জিহাদের সঙ্গে যে থাকে না সেই-ই দুশমন। এমনকি যারা ওদের পৃষ্ঠপোষক, সাবধানী না হলে তারাও পরিত্যক্ত হয়ে যেতে পারে। ভারতের ঐক্য নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি এখন খুনিদের বক্রদৃষ্টির আওতায়। আমরা এমন একটি সংঘাতের মাঝে রয়েছি, যে সংঘাত আমরা চাইনি। সদাসতর্কতা আর পাল্টা আঘাত হানার শক্তির মানে বোঝেন, বিজয় অর্জনের জন্য আমাদের প্রয়োজন তেমনই এক নেতা।

লেখক : ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর