শুক্রবার, ৩ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

পানি নিয়ে প্যানপ্যানানি

মেজর নাসির উদ্দিন আহম্মেদ (অব.) পিএইচডি

এপ্রিলের শেষ সপ্তাহটি ইতিহাসের পাতায় উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে পানিপথের যুদ্ধের কারণে। ১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিল সম্রাট জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর দিল্লির শাসক ইবরাহিম লোদিকে পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত করে ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন ঘটান। এ যুদ্ধে ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো কামান ব্যবহার করেন সম্রাট বাবর। মজার ব্যাপার হলো, পানিপথের যুদ্ধের সঙ্গে মূলত পানির কোনো সম্পর্ক নেই। কেননা পানিপথ ছিল দিল্লি থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার উত্তরে একটি শহর এলাকা, যেখানে মূলত যুদ্ধটি হয়েছিল। অথচ চাকরির জন্য পানিপথের যুদ্ধ কোথায় হয়েছিল জিজ্ঞাসা করলে অনেকেই পানি ঘোলা করে ফেলেন।

এ বছর ১৭ এপ্রিল হঠাৎ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কথা আর তথ্যের কামান দাগল ঢাকা ওয়াসার পানি নিয়ে। পুলিশের জলকামান নয়, মানুষের নিত্যপ্রয়োজনে যে পানি ওয়াসা সরবরাহ করে, তা মানুষের পানের জন্য যথাযথ নয় বলে অভিমত টিআইবির। মূলত এখান থেকেই পানি নিয়ে যুদ্ধের শুরু। টিআইবির মতে এ পানি রাজধানীবাসীকে ফুটিয়ে পান করতে হয়। এতে যে গ্যাস খরচ হয় তার মূল্য ৩৩২ কোটি টাকা। ওয়াসা যদি তার প্রতিশ্রুতিমতো বিশুদ্ধ খাবার পানি দিতে পারত তবে হয়তো এ অর্থ ও সময় ব্যয় থেকে রেহাই পেত রাজধানীবাসী। এমন আক্রমণের পর মুখে পানি নিয়ে বসে থাকার পাত্র নন ওয়াসার কর্তাবক্তিরা। ২০ এপ্রিল ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম আহাম্মেদ খান দাবি করলেন, ওয়াসার পানি ১০০ ভাগ সুপেয়। তিনি বাসায় ফুটানো পানি, বাইরে ওয়াসার বোতলজাত পানি ‘শান্তি’ এবং কখনো কখনো ট্যাপের পানি পান করেন বলে দাবি করেন। ১০০ ভাগ সুপেয় পানি কেন ফুটাতে হবে আর ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাস পোড়াতে হবে! তার যথাযথ ব্যাখ্যা আসেনি তার বক্তব্যে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ২৮ মার্চ ওয়াসার পানি কিছুটা ফুটিয়ে (আনুমানিক ১০ মিনিট) পান করার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্বয়ং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয়। পানি নিয়ে যুদ্ধটা এখানে শেষ হলেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তু তা হয়নি। এর দুই দিন পর রাজধানীর জুরাইন এলাকার একদল অধিবাসী ওয়াসার পানি, লেবু আর চিনি নিয়ে হাজির খোদ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অফিসে। জনৈক মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে আসা দলটির আবদার ওয়াসার সুপেয় (?) পানি দিয়ে বানানো শরবত পান করতে হবে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। কিন্তু তিনি তা করেননি। তবে তার দাবি মিজানুর রহমানসহ জুরাইন এলাকাবাসীকে সরবরাহ করা পানির মান যথাযথ। পরবর্তীতে মিজানুর রহমান অভিযোগ করেন, তার সঙ্গে ওয়াসা কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বাড়িতে এসে অসদাচরণ করেছেন। ওয়াসার পানি নিয়ে যুদ্ধটা আপাতত এখানেই থেমে আছে। আসন্ন বর্ষায় রাস্তায় পানি জমে গেলে শুরু হবে ‘পানি তুমি কার?’ নামের আরেক বাগ্যুদ্ধ।

রাজধানীর হাতিরঝিলের পানি নিয়ে যুদ্ধের সম্ভাব্য শেষ পর্ব শুরু হয় ১২ এপ্রিল। অবৈধভাবে হাতিরঝিলের ওপর তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর নিজস্ব ভবন পানিপ্রবাহে বাধা দিচ্ছে বলে প্রমাণিত হওয়ায় তা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এ উদ্দেশ্যে ১১ এপ্রিল ছিল ভবনটি খালি করার শেষ সময়। কিছুটা দেরি হলেও ভবন ছেড়ে দিয়েছে বিজিএমইএ এবং তা বুঝে নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এবার আদালতের নির্দেশ মোতাবেক তা ভাঙার পালা। আধুনিক পদ্ধতিতে তা ভাঙতে হলে প্রয়োজন প্রায় ২ কোটি টাকা। রাজউক আশা করছে এ অর্থের প্রায় পুরোটাই পাওয়া যাবে ভবনের ধ্বংসস্তূপ বিক্রির আয় থেকে। আর যদি ঘাটতি থাকে, তা আদালতের আদেশ মোতাবেক বিজিএমইএ পরিশোধ করবে। এখানে উল্লেখ্য, সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের পরও পা হারানো রাসেল সরকারকে ক্ষতি পূরণের ৫০ লাখ টাকার মধ্যে মাত্র ৫ লাখ প্রদান করে গ্রিনলাইন বাস কর্তৃপক্ষ। সুতরাং কবে ভাঙবে বিজিএমইএ ভবন, কবে ভবন ভাঙার টাকা উদ্ধার হবে এবং আর কত পানি গড়ালে হাতিরঝিলের পানি অবাধে বইবে, তা দেখার অপেক্ষায় আপাতত- পানি পানের বিরতি।

ওয়াসার পানি আর হাতিরঝিলের পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তুরাগ নদের পানিও শিরোনাম হয়েছে এপ্রিলের ১৮ তারিখ। তুরাগের পানিকে অবৈধ দখল থেকে মুক্ত এবং যথাযথভাবে বহমান রাখার প্রয়াসে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এ অভিযান চালাতে গিয়ে রাজধানীর নিকটবর্তী কামারপাড়ায় অবস্থিত বর্তমান সেতুর পাশে নতুন আরেকটি সেতুর জন্য নির্মিত দুটি পিলার ভেঙে ফেলা হয়। কর্তৃপক্ষের দাবি, এত কম উচ্চতায় সেতু নির্মিত হলে তা নৌ চলাচলে ব্যাঘাত ঘটাবে। এ সেতু নির্মাণের জন্য নিষেধ করেছিল বিআইডব্লিউটিএ; কিন্তু তা মানা হয়নি। এমনকি এ ধরনের কম উচ্চতার ১৩টি সেতু ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। সরকারি টাকায় তৈরি নতুন সেতুর দুটি পিলার কিংবা বর্তমান ১৩টি পিলার সরকারের টাকাই ভাঙা হচ্ছে বা হবে। এ ক্ষেত্রে হয়তো বলতে হবে ‘সরকারি মাল, তুরাগের পানিতে ঢাল।’ সরকারি মাল যে কেবল দরিয়ার পানি নয়, ডাঙায়ও ফেলা যায় তার নজির স্থাপন করেছে নাটোরের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। ১১ এপ্রিল প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নাটোর সদরে ২৪টি ও নলডাঙ্গা উপজেলায় ১৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২১টি ব্রিজ নির্মাণ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। এসব ব্রিজের নিচে প্রবহমান পানি আর দুই পাশে সংযোগ সড়ক থাকার কথা ছিল। কিন্তু সরেজমিন দেখা যায় এসব ব্রিজের ১৪টির দুই দিকে কোনো সংযোগ সড়ক নেই। ৮টি ব্রিজ নির্মিত হয়েছে সরু নালার ওপর, যেখানে ছোটখাটো কালভার্টই যথেষ্ট ছিল। গুটিকয় পরিবারের জন্য নির্মিত হয়েছে ৩টি ব্রিজ আর ১টি ব্রিজের অন্য প্রান্তে আছে গ্রাম্য জঙ্গল। নাটোর সদর উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের ৩ কিলোমিটার রাস্তায় আগেই নির্মিত ছিল ৬টি ব্রিজ। একই রাস্তায় নির্মিত হয়েছে আরও ৬টি ব্রিজ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সততা-জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতার এই দুর্যোগ দেখে হয়তো কুমিরের চোখে পানি ঝরবে, কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে দায়ী ব্যক্তিরা। কারণ তারা তো গভীর পানির রাঘব-বোয়াল।

খালবিল, নদীনালা পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় ১২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্যাস সরবরাহের কাজ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালে। এ প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগের আমলে। ১৭ এপ্রিলের খবরে প্রকাশ, ‘পুরো টাকাই পানিতে গেছে’। কারণ এসব অঞ্চলে বিগত প্রায় চার বছরে গ্যাস সরবরাহ হয়নি এমনকি অচিরে সরবরাহের সম্ভাবনাও নেই। তাহলে কেন এত টাকা ব্যয়ে এই গ্যাস সরবরাহ লাইনসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মিত হলো- এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আর বুড়িগঙ্গার দূষিত পানিতে মাছ খোঁজার একই অর্থ। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলমের মতে, ‘জনগণের ১২০০ কোটি টাকা পানিতে গেছে অথচ এর জন্য কাউকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি।’

দুধে পানি মেশানোর বিষয়টি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে হয়তো কোনো বিষয় নয়। কিন্তু কয়লায় পানি? এও কি সম্ভব? এ অসম্ভবই সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের বড়পুকুরিয়ায়। ২৫ এপ্রিলের খবরে প্রকাশ, কয়লায় আর্দ্রতা বেশি থাকায় অর্থাৎ পানির পরিমাণ অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি হওয়ায় ‘পানিতে লোকসান ১৫.১৪ কোটি টাকা’। এ লোকসান মাত্র তিন মাসের হিসাবে। অথচ দীর্ঘ ১৩ বছর কয়লা কেনা হয়েছে আর্দ্রতা পরিমাপ ছাড়াই। অথচ আর্দ্রতা মাপার জন্য আধুনিক পরীক্ষাগার, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সবই ছিল। অথচ কয়লার দামে পানি কেনা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষতির বিষয়টি কেউ কেন খেয়াল করলেন না- তার উত্তর নেই কারও কাছে। পানি অধিক তাপে বাষ্প হয়ে উবে যায়, কিন্তু কয়লা? কয়লা কি হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে? হ্যাঁ পারে। বাংলাদেশেই গত বছর প্রায় দেড় লাখ টন কয়লার হিসাব মিলছে না বলে খবরে প্রকাশ। তদন্তের পর কী হয়েছে বা হবে তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে। কারণ অনেক তদন্ত বা তদন্ত রিপোর্টও বাষ্প হয়ে উবে যাওয়ার নজিরও রয়েছে এ দেশে। পানি থেকে বাষ্প হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার এই তালিকায় আরও আছে দিনাজপুরের মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানির কঠিন শিলা বা পাথর।

গত বছরে কয়লা গায়েবের রেশ কাটতে না কাটতেই ৩ লাখ ৬০ হাজার টন পাথর গায়েব বা পানির বাষ্পের মতো উবে যাওয়ার খবরে হতবাক হয়েছিল গোটা দেশবাসী। পানির বিচিত্র ব্যাখ্যা বর্ণনা করে সুকুমার রায় ‘অবাক জলপান’ নাটক লিখেছিলেন। বেঁচে থাকলে এ দেশে বর্তমানে পানি নিয়ে পানি মিশ্রিত কাদা ছোড়াছুড়ির দৃশ্য দেখে তিনি কী লিখতেন জানি না, তবে মাথায় ওয়াসার সুপেয় (?) পানি ঢালতেন- তা নিশ্চিত। তাই কথা না বাড়িয়ে এই দাবদাহ থেকে বাঁচার জন্য আসুন সবাই বলি ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দেরে তুই’।

                লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর