শনিবার, ৪ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

সময় এখন সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতির

শাইখ সিরাজ

সময় এখন সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতির

আমি যখন এ লেখাটা লিখছি তখন সমুদ্রে গর্জন তুলে আসছে ঘূর্ণিঝড় ফণী। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় ঘোষণা চলছে সতর্কবার্তার। আবহাওয়া দফতরসহ বিভিন্ন আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ৪ মে দিবাগত রাতে ফণী বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগে এর প্রভাব থাকবে। তারা বলছে ঘূর্ণিঝড়টি ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে সরাসরি রাজশাহীর ওপর পড়বে। তাদের দেওয়া তথ্য ও  চিত্রমতে ঘূর্ণিঝড় রাজশাহীতে আসতে আসতে দুর্বল হয়ে পড়বে। তবুও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের একটা সাধারণ ধারণা ঘূর্ণিঝড় শুধু সমুদ্র তীরববর্তী অঞ্চলেই হয় এবং সে অঞ্চলই ক্ষতির শিকার হয়। এ ধারণা মোটেই ঠিক না। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে এর আগে আইলাতেও রাজশাহী অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এখন বোরোর ফসল উঠছে, আম বাগানে গাছে গাছে ভরা আম, এছাড়াও সবজি, ফল-মূলসহ নানা রকমের ফসল কৃষকের মাঠে। এ ঝড়ে ফসলের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সে বিষয়েও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আশা করছি তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতির শিকার আমরা হব না। শুনছি সরকারের পক্ষ থেকে ফণীকে মোকাবিলা করার সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। এটা আশার কথা। গত সপ্তাহ থেকেই ভাবছিলাম এ সপ্তাহে সমুদ্র নিয়ে লিখব। কারণ, সমুদ্র নিয়ে অন্যরকম এক প্রত্যাশা সেই ২০১৪ সাল থেকে। সমুদ্রসীমা জয়ের পর ব্লু-ইকোনমির একটা বড় সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয় আমাদের জন্য। মনে আছে ২০০৫ সালে আমি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর প্রোগ্রাম ধারণ করার জন্য জাপানে যাই। সেখানে টোকিও সাগরের দীর্ঘ বালুতটজুড়ে সামুদ্রিক শৈবালের চাষ হতে দেখেছি। জাপানের রেস্তোরাঁয় অনেক খাবারেই শৈবালের উপস্থিতি পেয়েছি। ইতিহাস বলে, ১৬৭০ সালে টোকিও সমুদ্রে সর্বপ্রথম শৈবাল চাষ শুরু হয়। ১৯৪০ সালে বাণিজ্যিক রূপ নেয়। তারপর জাপান, চীন, কোরিয়া, ফিলিপিনসসহ বিভিন্ন দেশে শৈবাল হয়ে ওঠে এক অনন্য অর্থকরী সবজি। নানারকম পুষ্টি উপাদান, ভিটামিন, খনিজ ও আয়োডিনের বিশাল আধার এ সামুদ্রিক শৈবাল। জাপান প্রতি বছর দুই বিলিয়ন ডলারের শৈবাল উৎপাদন করে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে সারা বিশ্বে ২৫ হাজার মেট্রিক টন শৈবাল উৎপাদন হয়; যার বাণিজ্যিক মূল্য ৬.৫ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় তটরেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭১০ কিলোমিটার। ১৯টি জেলার ১৪৭টি উপজেলায় মোট ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় শৈবাল চাষ হতে পারে কৃষি তথা ব্লু ইকোনমির নতুন ধারা। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের যৌথ উদ্যোগে কক্সবাজারে শৈবাল চাষের প্রকল্প গত বছর আমি দেখে এসেছিলাম অধ্যাপক আবদুল আজিজ সাহেবের আমন্ত্রণে। পরিকল্পিত উপায়ে শৈবাল চাষ করা গেলে সেটি যেমন আমাদের পরিবেশের জন্য ভালো হবে, তেমনি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় হতে পারে সামুদ্রিক শৈবাল।

বিভিন্ন গবেষণা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটি। এ বিপুল জনগোষ্ঠীর খাবার জোগান দেওয়াটা কঠিন হয়ে যাবে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের সমুদ্রকে ব্যবহার করতে জানতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে ইতিমধ্যেই সমুদ্র অর্থনীতি বিশাল একটা প্রভাব ফেলছে। বছরব্যাপী তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকান্ড সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে। বিশ্ব জনসংখ্যার ১৫ ভাগকে প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। বিশ্বের অনেক দেশেই সমুদ্রনির্ভর ঔষধশিল্পও গড়ে উঠছে।  ব্লু-ইকোনমির আর একটা বড় অধ্যায় সামুদ্রিক মাছ। কাগজে-কলমে আমাদের সামুদ্রিক মাছের প্রজাতির সংখ্যা ৪৭৫ হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন, সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র ২৫০-৩০০টি জাতের অস্তিত্বের কথা বলছে। দিন দিন কমে যাচ্ছে সামুদ্রিক মাছের জাত। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভয়াবহ বিষয় চোখে পড়েছে। গত মার্চে কক্সবাজারের বেশ কিছু সামুদ্রিক মাছের বাজার আমি ঘুরে এসেছি। কক্সবাজার থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে চৌফলদন্ডীতে গিয়ে দেখলাম জেলেদের হাত থেকে একেবারে ছোট থেকে শুরু করে মাঝারি বা বড় কোনো মাছই রক্ষা পাচ্ছে না। জাল এমনভাবে তৈরি করা যাতে ছোট মাছগুলোও আটকে যাচ্ছে। বড় মাছ মানুষের খাবার হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। ছোট ছোট মাছ যেগুলো সামুদ্রিক ময়লা থেকে পৃথক করা যায় না, সেগুলোও মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করে ফেলা হচ্ছে। নির্বিচারে সব ধরনের মাছ ধরে ফেলার কারণে দিন দিন সামুদ্রিক মাছের জাত যেমন হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি হুমকির মুখে আছে সামুদ্রিক প্রাণীকুল। জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম ‘বিন্দি জাল’ নামে এক ধরনের জাল দিয়ে সমুদ্রের সব ধরনের প্রাণীই তারা তুলে আনছে। ২০০৭ সালে থাইল্যান্ডের মেরিন ফিশারিজ মিউজিয়ামে এ জাল আমি দেখে এসেছি। এ ধরনের জাল আর তারা ব্যবহার করে না। জাদুঘরে রেখেছে ইতিহাস ঐতিহ্যের চিহ্ন হিসেবে। আর আমরা এ জাল দিয়ে সমুদ্র থেকে তুলে আনছি নানান প্রাণী, সব প্রজাতির মাছ। ধ্বংস করে দিচ্ছি মাছের প্রজাতি। 

পাঠক, ২০০৭ সালে থাইল্যান্ডের সাউথইস্ট এশিয়ান মেরিন ফিশারিজ ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ঘুরে তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে একটা ধারণা নিয়ে এসেছিলাম। এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে। সাউথইস্ট এশিয়ান মেরিন ফিশারিজ ডেভেলপমেন্ট সেন্টার মাছের প্রজাতি সংরক্ষণ, মাছের বিচরণ ক্ষেত্র থেকে শুরু করে কখন কোন মাছ ধরা যাবে তাও গবেষণা করে নির্ধারণ করে দেয়। অথচ আমরা এখন অবধি জানি না আমাদের সামুদ্রিক মাছের প্রজাতির সংখ্যা কত। শুধু মৎস্যই নয়, প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটারের ‘ব্লু স্পেসের’ খনিজ, জ্বালানি ও ওষুধের উপাদান আহরণ নিয়েও আমাদের তেমন কার্যক্রম নেই। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমার ঠিকই সমুদ্রের সম্পদ আহরণে উঠে-পড়ে লেগেছে। আমরা জানি ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতির সিংহভাগই সমুদ্রনির্ভর। সমুদ্রের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে প্রয়োজন এখনই পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। তার আগে মাছের প্রজাতি রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজন জেলেদের এ বিষয়ে সচেতন করে তোলা। আমরা যেন ক্ষুদ্র লোভের জালে আটকে গিয়ে নষ্ট না করে ফেলি ভবিষ্যতের বিশাল সম্ভাবনা।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

 

 

 

সর্বশেষ খবর