শনিবার, ৪ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

ব্যাংকঋণ-নির্ভরতা কমাতে হবে

তপন কুমার ঘোষ

ব্যাংকঋণ-নির্ভরতা কমাতে হবে

বাংলাদেশে শিল্প প্রকল্প অর্থায়নের প্রধান উৎস ব্যাংক খাত। কিন্তু বিশ্বের কোথাও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা নেই। অন্যান্য দেশে এ অর্থায়ন হয় পুঁজিবাজার থেকে। আমাদের দেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিকল্প উৎসের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। ব্যাংকনির্ভরতা কমাতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উৎস হতে হবে পুঁজিবাজার। আর পুঁজিবাজার উন্নয়নের জন্য বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন দরকার। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন এসব কথা বলেন। সেমিনারে বক্তারা বলেন, ব্যাংকের স্বল্পমেয়াদি আমানত শিল্প প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদে খাটানো অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতেও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকনির্ভরতা কমানোর কথা বলা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের পুঁজিবাজারকে পুঁজি সংগ্রহের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। করপোরেট ঋণগ্রহীতারা এখনো ব্যাংকমুখী। ব্যাংকঋণ কয়েকটি বড় গ্রুপের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। ‘সব ডিম এক ঝুড়িতে রেখো না’- এই মূল্যবান পরামর্শে কান না দেওয়ার ফল ভোগ করছে বড় কয়েকটি ব্যাংক।

শেয়ার মার্কেট : দেশের শেয়ার মার্কেট বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো অনেকেরই জানা। শেয়ারবাজারের গভীরতা কম। খুব কমসংখ্যক কোম্পানি স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। বাজারে প্রয়োজনের তুলনায় ভালো কোম্পানির সংখ্যা কম। পুঁজিবাজারের বাইরে অনেক ভালো কোম্পানি রয়েছে যেগুলো নানা কারণে শেয়ারবাজারমুখী হচ্ছে না। শেয়ারবাজারে কারসাজির অভিযোগ তো আছেই। শেয়ারবাজার নিয়ে নানা বিশ্লেষণ, মতামত ও সুপারিশমালা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজটি হচ্ছে না। বেশ কিছুদিন দেশের শেয়ারবাজারের অবস্থা নাজুক। শেয়ারবাজার খেয়ালি আচরণ করছে। আতঙ্কিত লগ্নিকারীরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন। আলটিমেটাম দিয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ১৮ এপ্রিল এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিনে। শেয়ারবাজারে টানা দরপতনের পেছনে তারল্য সংকটকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি থাকায় মানুষ শেয়ারবাজারবিমুখ হয়ে পড়ছে বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশের অভিমত। বাজারে ভালো কোম্পানি না আসায় স্বল্প মূলধনী কোম্পানিগুলো মাঝেমধ্যে চোখ রাঙাচ্ছে। কোনো সংগত কারণ ছাড়াই দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে। এসব কোম্পানির শেয়ার সংখ্যা কম থাকায় কারসাজির সুযোগ আছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব প্রকট হওয়ায় বাজারে ক্রেতার তুলনায় বিক্রেতা বেশি। সব মিলিয়ে বাজারের এই হাল।

বন্ড মার্কেট : আমাদের দেশে বন্ডের প্রচলন তেমন একটা নেই। তাই দেশে কার্যকর কোনো বন্ড মার্কেট এখনো গড়ে ওঠেনি। বন্ড মার্কেট সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ভালো ধারণা নেই। শেয়ারের মতো বন্ড কেনাবেচার জন্য অনেক দেশেই প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি মার্কেট আছে। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যংকে (বাংলাদেশ ব্যাংক) ট্রেজারি বন্ডের নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। প্রাইমারি ডিলাররা এতে অংশ নেন। সেকেন্ডারি মার্কেটে ট্রেজারি বন্ডের বেচাকেনা নেই। সম্প্রতি ব্যাংক ও অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অন্য কিছু প্রতিষ্ঠান বাজারে বন্ড ছেড়ে তহবিল সংগ্রহ করেছে। পুঁজিবাজারে কিছু বন্ড তালিকাভুক্ত থাকলেও সেগুলোর লেনদেন হয় না বললেই চলে।  বৃহৎ প্রকল্প, বিশেষ করে অবকাঠামো প্রকল্প, বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি তহবিল দরকার। শুধু ব্যাংকঋণের মাধ্যমে এই চাহিদা পূরণ করা যাবে না। আর ব্যাংকের স্বল্পমেয়াদি তহবিল দীর্ঘমেয়াদে খাটানো ঝুঁকিপূর্ণও বটে। ‘ম্যাচুরিটি মিসম্যাচ’ মাত্রাতিরিক্ত হলে ব্যাংক তারল্য ঝুঁকিতে পড়ে।

বন্ডের টুকিটাকি : সরকার বা সরকারি কোনো সংস্থা বা বেসরকারি কোনো কোম্পানি বন্ড ইস্যু করে বাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করতে পারে। বন্ডের ক্রেতা হচ্ছেন ঋণদাতা। আর বন্ড ইস্যুকারী হচ্ছেন ঋণগ্রহীতা। সরকার যে বন্ড বাজারে ছাড়ে তাকে সরকারি বন্ড বলে। কোম্পানি বা সংস্থা ইস্যু করে করপোরেট বন্ড। দেশের বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রায় সভরেন বন্ড ইস্যু করা হয়। করমুক্ত বন্ডের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত সুদের ওপর কর দিতে হয় না। কনভার্টিবল বন্ড নির্দিষ্ট সময় পর শেয়ারে রূপান্তরিত হয়। ইস্যুর শর্ত মোতাবেক কনভার্টিবল বন্ড আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে রূপান্তরযোগ্য হতে পারে। পরিশোধের দিক থেকে সাব-অর্ডিনেটেড বন্ডধারীদের অবস্থান কোম্পানির ঋণদাতাদের মধ্যে সবার নিচে।

বন্ডের সুদ : বন্ডের ফেস ভ্যালুর ওপর নির্দিষ্ট হারে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সুদ পাওয়া যায়। সাধারণত ছয় মাস অন্তর বন্ডের সুদ দেওয়া হয়। কিন্তু কিউমুলেটিভ বন্ডের ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে চক্রবৃদ্ধি সুদসহ আসল টাকা একবারে প্রদান করা হয়। জিরো কুপন বন্ডে কোনো সুদ দেওয়া হয় না। ফেস ভ্যালুর কম মূল্যে বন্ড কেনেন বিনিয়োগকারী। মেয়াদ শেষে তিনি ফেস ভ্যালু ফেরত পান। একে ডিসকাউন্ট বন্ডও বলে।

বন্ডের মেয়াদ : অধিকাংশ বন্ডের নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে। সাধারণত বন্ড দীর্ঘমেয়াদের হয়। কিছু বন্ড আছে যার মেয়াদ নির্দিষ্ট নয়। একে ‘পারপিচুয়াল বন্ড’ বলে। এ বন্ডের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় পরপর সুদহারের পরিবর্তন হয়।

বন্ডের ঝুঁকি : বন্ড ঝুঁকিশূন্য নয়। সেকেন্ডারি মার্কেটে বন্ডের বাজারদর ওঠানামা করে। বাজারে সুদহার বাড়লে পুরাতন বন্ডের চাহিদা ও বাজারদর কমে। আর বাজারে সুদহার কমলে ঘটে ঠিক এর উল্টোটা। আমাদের পুঁজিবাজার বলতে মূলত শেয়ারবাজারকে বোঝায়। এখানে শেয়ার কেনাবেচা হয় মাত্র। পুঁজিবাজারকে বিকশিত করতে হলে নতুন আর্থিক প্রোডাক্ট বাজারে ছাড়তে হবে। বন্ড মার্কেট নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে, এটা পুঁজিবাজারের জন্য সুখবরই বলতে হবে। সময়ের চাহিদা মাথায় রেখে পুঁজিবাজারকে বিকশিত করার লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।

লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

 

সর্বশেষ খবর