রবিবার, ৫ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

যেসব দুর্ঘটনা সহজে প্রতিরোধ করা যায়

ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই রব্বানী

যেসব দুর্ঘটনা সহজে প্রতিরোধ করা যায়

জীবনে পায়ে পায়ে বিপদ জড়িয়ে থাকে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই আমরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তার নিরাপত্তার বিষয়গুলোও আয়ত্ত করে ফেলি। পুকুর বা নদীর পাশে কীভাবে চলতে হবে তা গ্রামের একটি শিশুও জানে। তার পরও দুর্ঘটনা ঘটে, তবে তার সংখ্যা খুবই কম। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পণ্যগুলো আমাদের সভ্যতার জন্য নতুন, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে। তা ছাড়া এগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান জনসাধারণের মধ্যে আমরা ছড়িয়ে দিতে পারিনি। তাই এ প্রযুক্তিগুলোর নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা সত্যিকারে সচেতন হয়ে উঠতে পারিনি। দেশের সিংহভাগ মানুষ তো নয়ই, শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও যথেষ্ট সচেতন নয়। ফলে প্রতিনিয়তই আমরা অনেক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর খবর পাই যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জ্ঞানের মাধ্যমে এড়ানো সম্ভব হতো। সহজে এড়ানো যায় এ রকম কয়েকটি দুর্ঘটনার কারণ ও তার প্রতিকার নিয়ে এখানে আলোচনা করব।

১। লিক করা গ্যাসে বিস্ফোরণ : দরজা-জানালা বন্ধ অবস্থায় রান্নাঘরে লিক হয়ে গ্যাস জমে গেলে যেই না কেউ বাতির একটি সুইচ অন করতে যায়, অথবা দেশলাই বা লাইটার দিয়ে চুলা জ্বালাতে যায়, সঙ্গে সঙ্গে ঘরভরা গ্যাসে আগুন ধরে তার আয়তন ও চাপ বহুগুণে বেড়ে যায় ও ফলে বিশাল বিস্ফোরণের সৃষ্টি হয়। বিদ্যুতের বাল্ব, ফ্যান বা অন্যান্য যে কোনো যন্ত্রপাতির সুইচ অন-অফ করলে সেখানে ছোট ছোট স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয় যা অনেক সময় দেখা যায় না। কিন্তু জমে থাকা গ্যাসে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য তা যথেষ্ট। প্রাকৃতিক গ্যাসে কোনো গন্ধ নেই। তাই ঘরে গ্যাস আছে কিনা টের পাওয়া যায় না। এজন্য পাশ্চাত্যে প্রায় দেড় শ বছর আগে থেকেই বিশেষ গন্ধ মেশানো হয়, যেন ঘরে গ্যাস লিক হলে মানুষ বুঝতে পারে ও সাবধান হতে পারে। আমাদের দেশে গ্যাস সরবরাহ যখন শুরু হয় তখনো কিন্তু গ্যাসে এ ধরনের গন্ধ মেশানো হতো, যা আমাদের অনেকেরই মনে পড়বে। কিন্তু কবে কখন থেকে তা বন্ধ করা হয়েছে তা মনে পড়ছে না। হয়তো অতি হিসাবি কোনো কর্মকর্তা সরকারের খরচ বাঁচানোর জন্য গন্ধ মেশানো বন্ধ করে দেন। কিন্তু এর ফলে যে কী ঘটতে পারে তার সম্পর্কে তারা সচেতন ছিলেন না, এখনো নন। তাই গ্যাস কোম্পানিগুলোর উচিত হবে যত শিগগির সম্ভব এ গন্ধ মেশানোর কাজটি আবার শুরু করা। গ্যাস সরবরাহ যেহেতু সরকারই নিয়ন্ত্রণ করে, তাই সরকারেরও এ ব্যাপারে দায়িত্ব রয়েছে। এলপিজি বা সিএনজি কোম্পানিগুলোকেও একই রকম ব্যবস্থা নিতে হবে। সামান্য এ বাড়তি ব্যবস্থা কত মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারত। উল্টিয়ে বললে বলা যায়, গ্যাস সরবরাহকারীদের অজ্ঞানতা, অসচেতনতা ও উদাসীনতার কারণেই বহু দুর্ঘটনা ঘটছে, অনেক প্রাণহানি হচ্ছে। মিডিয়া ও ভোক্তা অধিকার সমিতিগুলোকেও এজন্য সরব হতে হবে।

এ ছাড়া যে ব্যবস্থাগুলো আমরা নিজেরা নিতে পারি, তা হলো, রান্নাঘরের সব দরজা-জানালা যেন সম্পূর্ণ বন্ধ না থাকে তার দিকে খেয়াল রাখা। বাড়ির দরজা-জানালা আটকিয়ে অনেক দিন ছুটি কাটিয়ে ফিরলে আগেই কোনো সুইচ অন করা উচিত হবে না। আর দেশলাই বা সিগারেটের লাইটারের আগুন জ্বালানোর তো কোনো প্রশ্নই আসে না। তবে মোবাইল ফোনের লাইটটি অন করা যেতে পারে, কারণ তার সুইচটি ইলেকট্রনিক, এতে কোনো স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয় না। তাই প্রথমে ঘরে ঢুকে আগেই দরজা-জানালাগুলো খুলে দিয়ে গ্যাস বের হয়ে যাওয়ার জন্য সময় দিয়ে কিছুক্ষণ পর লাইট, ফ্যান অন করা উচিত।

আজকাল বাজারে কিছু গ্যাস-অ্যালার্ম পাওয়া যায়। চাইলে সেগুলোও লাগানো যেতে পারে। তবে এদের গুণাগুণ দেখে নিতে হবে। আবার এদের সেন্সরটি রান্নাঘরের চুলার সাপেক্ষে কোনো জায়গায় লাগাতে হবে তার জন্যও সঙ্গে দেওয়া নিয়মাবলি পড়ে নিতে হবে অথবা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। আমাদের দেশের সাধারণ বৈদ্যুতিক মিস্ত্রিরা বেশির ভাগই অল্প শিক্ষিত। দেখে দেখে তারা কাজ শেখে এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভালো কাজ করে। কিন্তু নতুন যন্ত্রপাতি লাগানোর ব্যাপারে যে নিরাপত্তার বিষয়গুলো জানা দরকার তা তাদের থাকে না।

২। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের আগুন :  বিদ্যুৎ লাইনের ‘লাইভ’ ও ‘নিউট্রাল’ তার দুটি কোনোভাবে একসঙ্গে লেগে গেলে তাকে শর্টসার্কিট বলা হয়। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ প্রবাহে তেমন কোনো বাধা থাকে না বিধায় মাত্রাতিরিক্ত কারেন্ট প্রবাহিত হয়, যার ফলে ঘরের বিদ্যুতের তারগুলো অতিরিক্ত গরম হয়ে হিটারের তারের মতো লাল হয়ে যায়। প্রথমেই তারের প্লাস্টিকের খোলস বা ইনসুলেশনে আগুন ধরে যায়, আর আশপাশে দাহ্য পদার্থ থাকলে তাতেও ছড়িয়ে যায়। একসঙ্গে সারা বাড়ির অনেক তারে আগুন ধরে যায় বলে মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থা যেন না ঘটতে পারে সেজন্য যে স্থানে বিদ্যুৎ লাইন ঘরে ঢোকে সেখানে একটি ‘কাট-আউট’ বা ‘ফিউজ’ লাগানো হয়। ফিউজের ভিতরে ছোট একটি তার লাগানো থাকে। এ তারটি কতটুকু মোটা হবে বা চিকন হবে সেটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তারের পুরুত্ব হিসাব করে এমনভাবে বেছে নেওয়া হয় যেন ঘরের লাইনের তার সর্বোচ্চ যতটুকু কারেন্ট নিরাপদভাবে নিতে পারে তার থেকে কম কারেন্টেই ফিউজের ভিতরের তারটি গরম হয়ে গলে যায় ও বিদ্যুৎ লাইনটি কেটে দেয়। এভাবে বিদ্যুতের কারেন্ট বন্ধ হয়ে ঘরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। চীনামাটি দিয়ে ফিউজের শরীর তৈরি করা হয় বিধায় তাতে আগুন লাগে না। প্রশ্ন হলো, এ ধরনের নিরাপত্তা থাকার পরও শর্টসার্কিট হওয়ার পর ফিউজ কাটে না কেন বা আগুন ধরে কেন? এর মূল কারণ রয়ে গেছে প্রাচীন প্রবাদে, ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী’। অনেক সময় কোনো যন্ত্রপাতিতে ত্রুটি থাকলে বা শর্টসার্কিট থাকলে তা অন করলেই ফিউজ কেটে যায়। তখন খুঁজে বের করা দরকার, ত্রুটিটি কোথায়, আর কেবল তা ঠিক করার পরই ফিউজের তার লাগানো উচিত। কিন্তু দুঃসাহসী অল্প শিক্ষিত বিদ্যুৎ মিস্ত্রি অথবা অনেক ব্যবহারকারী নিজেই ফিউজে অনেক মোটা তার লাগিয়ে দেন যেন তা কেটে না যায়। আর যেহেতু যন্ত্রে শর্টসার্কিট হয়েই আছে, ফিউজ আর কাটে না। তখন অতিরিক্ত কারেন্টের কারণে লাইনের তারে আগুন ধরে যায়। আর তার পরের ঘটনা আমাদের সবার জানা। তাই একে দুর্ঘটনা বলাটা ঠিক নয়। বরং একে বলতে পারি নির্বুদ্ধিতা ও দায়িত্বহীনতা। এ অবস্থা থেকে বাঁচার প্রথম উপায় হলো বিদ্যুৎ মিস্ত্রি, ব্যবহারকারী, সবাইকে ফিউজের বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া ও সচেতন করে তোলা। এজন্য আমার এ লেখাটির মতো লেখা বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে মাঝে মাঝেই আসা উচিত। দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে ঘরের লাইনে এমন তার ব্যবহার করা যেগুলোর প্লাস্টিক ইনসুলেশনে আগুন ধরে না। এদের বলা হয় ‘নন-ইনফ্ল্যামেব্ল’ ইনসুলেশন। একটু দাম বেশি হলেও ঝুঁকি কমে যায়। এ ছাড়া ঘরের যেসব জায়গায় বিদ্যুতের লাইন গেছে তার আশপাশে যেন কোনো দাহ্য জিনিস না থাকে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

আগুন থেকে বাঁচার জন্য আর একটি নতুন ধারণা আমি দিতে চাই। তা হলো প্রতিটি বাড়ি, কলকারখানা ইত্যাদিতে বিদ্যুৎ লাইন ঢোকার জায়গায় দুটি বাক্সে দুই সেট কাট-আউট বা ফিউজ পরপর বা সিরিজে লাগানো। এর প্রথম বাক্সটির ফিউজের তার নিরাপদ সীমার জন্য হিসাব করে লাগানো থাকবে এবং এটিকে তালা দিয়ে চাবিটি শীর্ষস্থানীয় কারও একজনের কাছে রাখা থাকবে, যার ফিউজ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রয়েছে এবং দায়িত্ববোধ আছে। দ্বিতীয় বাক্সটিতে তালা থাকবে না এবং তাতে প্রথম বাক্সের ফিউজের তারের তুলনায় একটু চিকন তারের ফিউজ থাকবে। যদি কোনো যন্ত্রপাতির সাময়িক ত্রুটির কারণে ফিউজ কাটে, তবে দ্বিতীয় বাক্সেরটির কাটবে, প্রথমটির নয়। আর বাক্সের ভিতরে কোথাও এ মাপের ফিউজের তার রাখা থাকবে যেন কেউ তা সহজেও খুঁজে পায়। ব্যবহারকারী তখন তাড়াতাড়ি এ ফিউজটিকে পাল্টিয়ে ফেলে আবার বিদ্যুৎ চালু করতে পারবেন। কিন্তু তারা যদি দুঃসাহস করে অনেক মোটা তার ফিউজে লাগান, তবে শর্টসার্কিট হলে প্রথম বাক্সের ফিউজ কেটে যাবে, যেটি তালা দেয়া। তখন দায়িত্বশীল ব্যক্তির উপস্থিতি ছাড়া বিদ্যুৎ চালু করা যাবে না। আগুন লাগার চেয়ে কিছুক্ষণ সব কাজকর্ম বন্ধ থাকাই ভালো।

একটি বিষয় সবার জানা দরকার। সার্কিট ব্রেকার নামে এক ধরনের কাট-আউট এখন বহুল প্রচলিত, যার সামনে সুইচের মতো একটি হাতল আছে। অতিরিক্ত কারেন্ট প্রবাহিত হলে এ যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুইচ অফ করে দেয় ও হাতলটি নেমে যায়। ব্যবহারকারী পরক্ষণেই হাতলটি উল্টিয়ে বিদ্যুৎ চালু করতে পারেন। ব্যবহার করতে সহজ বিধায় অনেকেই এটি ব্যবহার করছেন।

তবে মনে রাখতে হবে, কখনো কখনো অতিরিক্ত কারেন্টের ফলে এর সুইচের কন্টাক্টগুলো অতিরিক্ত গরম হয়ে গলে লেগে যেতে পারে (ওয়েল্ডেড)। এর ভিতরের প্রযুক্তিগত স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা তখন আর কাজ করতে পারে না। অর্থাৎ, যত কারেন্টই যাক না কেন, সুইচ কখনই অফ হবে না। এজন্য বাড়ি বা অফিস-কারখানার ছোট ছোট অংশের বিতরণে এ ধরনের সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করা যেতে পারে, যার পেছনে প্রতিরোধের জন্য আরও সার্কিট ব্রেকার বা কাট-আউট আছে। প্রয়োজনে সেগুলো সুরক্ষা দিতে পারবে। কিন্তু সেটিও যদি স্বয়ংক্রিয় সার্কিট ব্রেকার হয় এবং তার কন্ট্যাক্টও যদি ওয়েল্ড হয়ে যায়? তাই স্বয়ংক্রিয় সার্কিট ব্রেকারের ওপর কখনো সম্পূর্ণ ভরসা করা যাবে না। বিদ্যুৎ লাইন ঢোকার জায়গায় প্রধান যে প্রতিরোধের জায়গা, সেখানে পুরনো প্রযুক্তির তার লাগানো কাট-আউট বা ফিউজই লাগাতে হবে, স্বয়ংক্রিয় সার্কিট ব্রেকার নয়।

আশা করি আমরা সবাই সচেতন হব, যেসব প্রযুক্তি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করছি সে সম্পর্কে পড়াশোনা করে জানব। তাতে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আমরা নিরাপদে ব্যবহার করে জীবনকে উন্নত করতে পারব। আর তা না করলে যা মূলত দুর্ঘটনা নয়, অজ্ঞানতা ও অবহেলার কারণে ঘটা মৃত্যু, তা ঘটতেই থাকবে। আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কী চাই।

 

লেখক : অনারারি প্রফেসর, বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর