সোমবার, ৬ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা

হেনা সুলতানা

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা

রণদা প্রসাদ সাহাকে কেউ বলেছেন মহাপুরুষ, কারও কাছে তিনি মহামানব, কেউবা মহাপ্রাণ ডেকেছেন। কারও কাছে মনে হয়েছে তিনি কিংবদন্তির জীবন্ত নায়ক। কেউ চিনেছেন দানবীর হিসেবে। এর কোনোটাই অসত্য নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি দানবীর হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছেন। সামনে-পেছনে না তাকিয়ে অকাতরে দান করেছেন স্বোপার্জিত অর্থ। অনেকে সমাজে নাম কেনার জন্য দান করেন, কেউবা পরকালে স্বর্গসুখের জন্য। রণদা প্রসাদের ক্ষেত্রে আমরা দেখি দান করে তিনি বীরত্ব দেখিয়েছেন। আমাদের সমাজে বীরের সংখ্যা অতি অল্প, যারা তা দেখাতে পারেন তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জাগে আপনা থেকেই। রণদা প্রসাদের সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন, তার নীতি-আদর্শ, তার অপার মানবিকতা এবং তার সমাজ চেতনা, দেশপ্রেমের কথা স্মরণ করে আজকের যুগে তিনি যে কত বেশি প্রাসঙ্গিক সেটাই বলার বিষয়। আমি শ্রদ্ধেয় রণদা প্রসাদ সাহাকে কখনো চোখে দেখিনি। কর্মসূত্রে তার প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী ভারতেশ্বরী হোমসে যখন এলাম তখন অন্তর থেকে উপলব্ধি করতে লাগলাম একটি বিশ্বাস ও ভালোবাসার নাম রণদা প্রসাদ সাহা! সে বিশ্বাস ও ভালোবাসার ছায়ায় আশ্রয় আছে, আছে স্নেহের পরশ। দৃশ্যতো তিনি আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তার প্রতিষ্ঠানগুলো জানান দেয় তিনি আছেন। কুমুদিনীতে এলে ঘুচে যায় মনের অনেক দীনতা, অনেক বৈকল্য যাকে রণদা প্রসাদ বলেছেন আমার তীর্থস্থান। রণদা প্রসাদ ছিলেন উচ্চতর মূল্যবোধের অধিকারী এক বিস্ময়কর রকম শক্তিমান মানুষ। বিস্ময়কর ছিল তার শ্রমশক্তি ও চিন্তাশক্তি। তিনি তার কীর্তির চেয়েও অনেক বড়। সাধারণ বাঙালি চরিত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত এক অনন্য মানুষ ছিলেন তিনি। পক্ষান্তরে বাঙালি চরিত্রের গুণগুলোয় সমৃদ্ধ ছিলেন অতি সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা এ মানুষটি।

রণদা প্রসাদ সাহা (১৮৯৬)-এর জীবন শুরু হয়ে ছিল জীবনযুদ্ধ দিয়ে। কিশোর বয়সে সে যুদ্ধ ছিল অতিশয় নির্মম। সাফল্য পেয়েছিলেন, যে কোনো বিবেচনায় তা অসামান্য, প্রায় রূপকথার মতোই। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছেলে মায়ের অকাল মৃত্যুর পর যাকে আশ্রয়হীন, ঠিকানাহীন করে তোলে। বাবার অবহেলা সৎ মায়ের যন্ত্রণা, আত্মীয়-স্বজনের স্নেহহীন দৃষ্টি তাকে বহেমিয়ান করে তোলে। লেখাপড়া হলো না। বাড়ি থেকে পালিয়ে সুদূর কলকাতায়। কষ্টসহিষ্ণুতা, সাহস ও কর্মনিষ্ঠাই ছিল পুঁজি। এ নিয়েই এগিয়েছেন। জীবনযুদ্ধ থেকে পৃথিবীর প্রথম মহাযুদ্ধে। সেখানেও অকুতোভয় বীরের পরিচয় দিলেন। যুদ্ধ শেষে রেলওয়ে বিভাগের সামান্য চাকরি। সে চাকরিও ছাড়তে হলো কোনো এক চক্রান্তে পড়ে। কিন্তু ছাড়ার দরুণ সরকারের কাছ থেকে পেলেন কিছু ক্ষতিপূরণ। সেই সামান্য পুঁজি সম্বল করে শুরু করলেন ব্যবসা। প্রথমে বাড়ি বাড়ি পরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এরপর জাহাজে কয়লা সরবরাহ করতে লাগলেন। এরপরের গল্প কেবলই সাফল্যের। প্রতিটি পদক্ষেপে ঝুঁকি ছিল। ব্যর্থ হলে সে গল্প ইতিহাস হতো না। পিছু না হটা এক অদম্য সৈনিক নিছক চরিত্রগুণে সফল হয়েছেন। সম্বলহীন পথকিশোরের এ অবাক করা সফল্য কিংবদন্তির মতোই শোনায়। নারায়ণগঞ্জে রণদা প্রসাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপার্জনের। আর খরচ করেছেন মির্জাপুরে- সেবা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তার জীবনের ছন্দ ছিল এরকম। বিপদে পড়লেও সে ছন্দে কখনো বাধা পড়েনি। রণদা প্রসাদের শিক্ষা ও সেবামূলক দর্শনের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি খুবই প্রণিধানযোগ্য। কালান্তর গ্রন্থের ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘আমরা পরের উপকার করিব মনে করিলেই উপকার করিতে পারি না। উপকার করিবার অধিকার থাকা চাই। যে বড় সে ছোটোর অপকার অতি সহজেই করিতে পারে, কিন্তু ছোটোর উপকার করিতে হইলে কেবল বড় হইলে চলিবে না Ñ ছোটো হইতে হইবে, ছোটোর সমান হইতে হইবে’। রণদা প্রসাদ মানুষকে যা দিয়েছেন তা ভিক্ষারূপে দেননি, ঋণ হিসেবেও দেননি, দিয়েছেন তাদের প্রাপ্য হিসেবে। বিশ্বাস করতেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এ মানব ধর্মে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের লোকহিতের মন্ত্রটিতে নিজের মতো করে দীক্ষিত হয়েছিলেন। যেখানে তিনি বড় হয়েও ছোটর সমান হয়েছেন। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অধিকার অর্জন করেছেন। তাকে কাছ থেকে দেখা মানুষদের আলোচনা থেকে জানা যায় ছোটর জীবনকে সামনে রেখেই তিনি অর্থ উপার্জন করেছেন। আবার সেই অর্থ যখন সর্বসাধারণের জন্য কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট (১৯৪৫) এর মাধ্যমে দান করেছেন তখন কোনো আত্মগরিমা তাকে স্পর্শ করেনি। এ জন্যই রণদা প্রসাদ সাহা রণদা প্রসাদ সাহা হতে পেরেছেন। আর সারা জীবন মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন।

আত্মপ্রচারে উৎসাহী ছিলেন না রণদা প্রসাদ। তিনি জানতেন কাজই তার আত্মপ্রকাশ ও আনন্দ। এখানেই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আশা-জাগিয়েছিলেন। সেসব মানুষই তাকে ভালোবেসেছে। আজ যারা তাকে চোখে দেখিনি তারাও ভালোবেসেছি তার জীবন ও আদর্শের গল্প শুনে, হয়েছি অনুপ্রাণিত। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে ৭ মে তিনি পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে অপহৃত হন পুত্রসহ। যুদ্ধের শুরুতেই স্বজনেরা পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু তিনি পালিয়ে যাওয়ার মানুষ ছিলেন না। তিনি সবাইকে নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিলেন। সারা জীবনের সাহসী সংগ্রামী মানুষটি এখানে এসেই গুপ্ত ঘাতকদের হাতে পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু বরণ করেছেন বীরের মৃত্যুকে। মৃত্যুতে তিনি শেষ হয়ে যাননি, রণদা প্রসাদের কর্মময় জীবন, নীতি ও আদর্শ, অপার মানবিকতা, তার সমাজ চেতনা, দেশপ্রেম আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসুক নতুন দুঃসাহসী মানুষেরা।

লেখক : শিক্ষক, ভারতেশ্বরী হোমস।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর