বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

নদীর ইলিশ সাঁতার কাটে, আইনের কোনো ধার ধারে না

এম জে আকবর

নদীর ইলিশ সাঁতার কাটে, আইনের কোনো ধার ধারে না

পেট্রাপোলে কোনো উত্তেজনা দেখলাম না। আমরা একটা রেখায় দাঁড়িয়ে আছি। ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার সিরিল র‌্যাডক্লিফ ১৯৪৭ সালে এই রেখা এঁকে দেন। তার আঁকা দাগের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় ভারত; ভাগ হয়ে গেছে বাংলা প্রদেশও। ওই ঘটনার সাত দশক পরে, ইছামতি নদীর পাড়ের ছোট্ট শহর পেট্রাপোল এলাম। ওদিকে বাংলাদেশের বেনাপোল।

বাস, তিন চাকার স্কুটার, ট্যাক্সি চেপে মানুষ আসছে। নামছে। খোশগল্প করতে করতে তারা এগিয়ে যাচ্ছে সীমান্তের দিকে। কার হাঁকিয়েও আসছে নরনারী। এদের গন্তব্য বেনাপোল। আমি আর আমার সঙ্গী ইতস্তত হাঁটি আর দেখি। বিএসএফের এক জওয়ান এগিয়ে আসছে দেখে আমরাও তার দিকে এগোই। ‘আপনারা এখানে কী করছেন?’ জানতে চায় জওয়ান। সহাস্যে জবাব দিই, ‘বর্ডার ট্যুরিজম করছি।’ বিএসএফ সদস্য বলে, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’

জানতে চাওয়ায় সে জানায়, ‘কাস্টমস আর ইমিগ্রেশন চেকিংয়ে আধঘণ্টারও কম সময় লাগে। এরপর ওপারে যাও। আরও এগোও। বেনাপোলেও কাস্টমস ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে নাও ঝটপট। ব্যস্, ঢুকে গেলে বাংলাদেশে। খুবই স্বস্তিদায়ক, হালকা চালের ভ্রমণ!’

ওয়াগা সীমান্তের অবস্থা পেট্রাপোলের উল্টো। ওয়াগা হচ্ছে ভারত থেকে স্থলপথে পাকিস্তানে ঢোকার একমাত্র পয়েন্ট। ওয়াগা শুষ্ক একটা জায়গা, গাছপালা বিরল। সেখানে পরিবেশ থমথমে, গম্ভীর। ২২০০ কিলোমিটার পশ্চিমে পাকিস্তানের মূল এলাকায় পৌঁছানোর আকুলতা-উদ্বেগ ফুটে থাকে নরনারীর চেহারায়। পেট্রাপোলে সেই উদ্বেগ-আকুলতা নেই। এখানে দুই দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বের বাতাবরণ অভিন্ন সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।

কলকাতা থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে যশোর রোডে আমরা। বেনাপোলে ঢোকার জন্য রপ্তানির পণ্যভর্তি ট্রাকবহর অপেক্ষা করছে। কাগজপত্রে ‘আপত্তি নেই’ সিলমোহর মারা হলেই তারা ছুটবে। ট্রাকের ড্রাইভাররা রাস্তার পাশের হোটেল-রেস্তোরাঁয় আড্ডা দিচ্ছে। খানাপিনা সারছে। লাল নিয়নবাতি সজ্জিত একটি সাইনবোর্ড বলছে- ‘এখানে বিশেষ কায়দায় রান্না করা সুস্বাদু ইলিশ পাওয়া যায়।’ যুক্তিবিচারে দেখলে এ ধরনের খাবারের দোকান বাংলাদেশে হলেই মানায় ভালো। বাংলাদেশের নদীতে জন্ম নেওয়া ইলিশের স্বাদ আর পশ্চিমবঙ্গীয় নদীর ইলিশের স্বাদে বিস্তর ফারাক। আমাদের ইলিশের তুলনায় বাংলাদেশের ইলিশ অনেক অনেক মজাদার হওয়ার কারণ শুধু আল্লাহ মালুম। এই যে রঙিন বিজ্ঞাপনদাতা হোটেল, আমি নিঃসন্দেহে বলি, এখান থেকে দশ গজ দূরে অবস্থিত বাংলাদেশ থেকে আসা ইলিশই এরা রান্না করেছে। নদীর ইলিশ সাঁতার কাটে, আইনের কোনো ধার সে ধারে না।

পেট্রাপোলের পাশে গাইঘাটা। এখানে বাহারি বিপণি কেন্দ্র আছে কতগুলো; এক ‘কার বাজার’ও দেখলাম। এর পূর্বদিকে গেলে ‘ইতালাকা’ পাথর কেনা যাবে বটে। তবে আওয়াজে যেমন তেমনটা খাঁটি ইতালীয় নয় এই স্টোন। হাবড়ায় বিক্রি হয় তদুরি চা। এর স্বাদ সম্পর্কে যা শোনা যায় তাতে অতিরঞ্জন নেই। এসব এলাকা ইদানীং নাগরিক হলেও গ্রামীণ গন্ধটা এখনো আছে। টগটবে তরুণদের নিয়ে গড়া ফুটবল দলের অনুরাগীদের মুগ্ধ করার জন্যই জানান দিচ্ছে একটি ক্লাব, যার নাম ‘ইস্ট বেঙ্গল একস্ট্রিমিস্টস। দারুণই বটে! আমরা যে জায়গায় এলাম, সেটা পশ্চিমবঙ্গের একেবারে পূর্বপ্রান্তে (মানে একস্ট্রিম ইস্টার্নে)। এ জায়গাটি লোকসভার বনগাঁ আসন এলাকায়। বিজেপির বিশ্বাস, তারা এবার এ আসনটিতে জয়ী হবে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি এখানে কোনো পাত্তাই পায়নি। কিন্তু এবার গুঞ্জন চলছে, ‘চুপিচুপি ঘটাব/আপদ যত সরাব।’ বিজেপির জোর প্রচারণাটা টের পাওয়া গেল। আদতে যা অপেক্ষা করছে তা দৃশ্যমান হবে ২৩ মে (ভোট গণনার পর)।

হাবড়ায় এক রেস্তোরাঁয় আমরা দুপুরের খাবার খেলাম। স্থানীয় এক তরুণ আমাদের জন্য চমৎকার মুরগির গোশত আর সবজির ব্যবস্থা করেছিলেন। খেতে খেতে আলাপ চলছিল। এ কথা-সে কথার পর এসে গেল ভোট প্রসঙ্গ। তরুণ বললেন, ‘মমতা ব্যানার্জি গ্রাম থেকে উঠে এসেছিলেন। কিন্তু কালক্রমে তিনি কলকাতার এয়ারকন্ডিশনের মধ্যে হারিয়ে গেছেন। গ্রাম যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। গ্রামের মানুষ এর প্রতিশোধ নেবেই।’

চন্দননগর মহকুমার সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির ন্যানো গাড়ি কারখানা বসানোর প্রকল্প ভ ুল করে দিয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি। ব্যাপারটি মনে করিয়ে দিয়ে এই তরুণ বলেন, ‘৯৯৭ একর কৃষিজমিতে কারখানাটি বসার পর ২০০৮ সালে উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা। তখন পশ্চিমবঙ্গে মার্কসবাদীরা ক্ষমতায়, পুঁজিবাদী ওই প্রকল্পের প্রতি তাদের ছিল পূর্ণ সমর্থন। জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন মমতা। এ আন্দোলনই মার্কসবাদীদের দুর্গে ফাটল ধরিয়েছিল। সিঙ্গুরের কৃষিজীবী মানুষ জিতে গিয়েছিল।’

তরুণটি আমাদের বলেন, ‘গ্রামের মানুষ এখন বলছে সিঙ্গুরের ওই বিজয়টা আসলে ছিল ফাঁকা বিজয়।’ অন্যান্য এলাকায়ও জনমনে একই ধরনের ক্ষোভ। জানতে চাইলাম, ‘তোমার আসানসোলের খবর কী?’ (তরুণের বাড়ি আসানসোল)। তিনি জানান, ‘সেখানেও তৃণমূলের জন্য সুখবর নেই।’ বিজেপি কত আসনে জিতবে? তিনি বলেন, ‘অ-নে-ক।’

ফ্রয়েডের সহকর্মী জুং বলতেন, বর্তমান অবস্থায় কীভাবে উপনীত হলো, এটা যে জানতে পারে তার পক্ষেই ধারণা করা সম্ভব যে ভবিষ্যতে তার কী ঘটতে চলেছে। তুঙ্গ-জনপ্রিয়তার দ্বারা সবার হয়ে ওঠা দিদি (মমতা) ক্রমাগত অজনপ্রিয় হতে হতে বর্তমান অবস্থায় এলেন কংগ্রেসের করা ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে করতেই। সেগুলো হলো : ক্ষমতার রাজনীতিতে ‘বিভক্ত করে বশে রাখো’ নীতি অনুসরণ, বংশ পোষণ আর দুর্নীতিকে প্রশ্রয়।

হাওয়াই চপ্পল পরা দিদির সন্তান নেই, তাই বিত্তলালসাও নেই, এ রকম ধারণা ছড়িয়ে পড়ার মধ্যেই লোকে দেখছে, তিনি তার ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জিকে কলকাতায় উত্তরাধিকারী বানানোয় সচেষ্ট। গদি ত্যাগের মানসিকতা থেকে এটা করছেন না। করছেন দিল্লির বর্ণিল প্রান্তরে নিজের ঠাঁই পোক্ত করার স্বপ্ন থেকে। ভাতিজা অভিষেক কলকাতা নগরীর অভিজাত অঞ্চলে প্রাসাদোপম বাড়ি খাড়া করে ফেলেছেন। লোকে বাড়িটা দেখে আর বিহ্বল হয়ে বিড়বিড় করে, ‘ঘটনা কী! হঠাৎ এত টাকা কোথা থেকে এলো?’

লেখক : ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

সাবেক কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী

সর্বশেষ খবর