শনিবার, ১৮ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

মাছের ইন্ডাস্ট্রি দিয়েছেন আবুল হাশেম

শাইখ সিরাজ

মাছের ইন্ডাস্ট্রি দিয়েছেন আবুল হাশেম

হাকিম আলীর কথা কি আপনাদের মনে আছে? সেই যে আশির দশকে বিটিভিতে প্রচারিত জনপ্রিয় ফিলার হাকিম আলীর মৎস্য খামার? এই হাকিম আলী ছিলেন এ দেশের হাজার হাজার মৎস্য খামার গড়ে ওঠার অনুপ্রেরণা। এরপর গত দু-তিন দশকে দেশে মাছ চাষের এক বিপ্লব ঘটে গেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা (এফএও)-এর প্রতিবেদনমতে প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে। চাষের মাছে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। প্রাকৃতিক উৎস ও চাষের মাছ মিলিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। প্রাকৃতিক উৎস থেকে বাংলাদেশ ২০১৭ সালে ১০ লাখ ৪৮ হাজার টন মাছ আহরণ করেছে। প্রাণিজ আমিষের ৫৮ শতাংশ মাছ দিয়ে মিটিয়ে শীর্ষস্থানীয় দেশের কাতারে এখন বাংলাদেশ। এর পেছনে রয়েছে সরাসরি দেশের কমবেশি ১৩ লাখ মৎস্যজীবীর অবদান। আর মৎস্য খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এখন যুক্ত রয়েছে দেশের দেড় কোটি মানুষ। এই বিশাল সাফল্যের পেছনে যারা কাজ করে তারা ব্যক্তিজীবনে একেকজন ভাগ্যোন্নয়নের কারিগর। চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ এবং বিটিভির ‘কৃষি দিবানিশি’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আপনাদের এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকার মাছ চাষিদের সাফল্যের চিত্র দেখিয়েছি। আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরব আরেকজন খামারির সাফল্যের গল্প। নরসিংদীর পলাশ উপজেলার বরাব গ্রামটি বাংলাদেশের চিরায়ত গ্রামের মতোই সবুজ-শ্যামল। একসময় এখানকার মাঠজুড়ে চাষ হতো ধান আর ধান। তবে গত দেড় দশকে এই এলাকার আর্থ-সামাজিক চিত্র পাল্টে গেছে মাছ চাষের কল্যাণে। গড়ে উঠেছে পুকুরের পর পুকুর। চাষ হচ্ছে ভিয়েতনামি কই, দেশি শিং, মাগুর, কার্পসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এই পরিবর্তনের নায়ক একসময়ের অতি সাধারণ এক মৎস্যজীবী। একসময় যার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। সম্পদ বলতে কিছুই ছিল না। শ্রমে-ঘামে তিনিই বনে গেছেন ওই এলাকার চেঞ্জ মেকার। নাম তার আবুল হাশেম। আগেই বলেছি আবুল হাশেম ছিলেন গরিব এক মৎস্যজীবী, বলা যেতে পারে মৎস্যশ্রমিক। জীবন সংগ্রামের একপর্যায়ে এসে ২০০৭ সালে মাত্র এক বিঘা জমির একটি পুকুর লিজ নিয়েই শুরু করেন মাছ চাষ। এখান থেকেই শুরু হয় জীবনের নতুন গল্প। এরপর একেকটি সাফল্য আর ধাপে ধাপে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া। বাড়তে থাকে জল আয়তন, মাছ চাষের পরিধি আর সমৃদ্ধি। এই খ্যাতির ওপর ভর করে এখন নিজের ২৩ বিঘা আর লিজ নেওয়াসহ প্রায় ২০০ একরের ওপর মাছ চাষ প্রকল্প। যেখানে বেশির ভাগেই উৎপাদন হচ্ছে থাই কই আর মনোসেক্স তেলাপিয়া। ছোট-বড় সব মিলিয়ে ৪০-৫০টি পুকুরে বছরে ৪০০ থেকে ৪৫০ টন মাছ উৎপাদন হচ্ছে; যার বাজার মূল্য ৫-৬ কোটি টাকার মতো। বছরে এখন লাভের হিসাবও প্রায় কোটি টাকার ওপরে।  মাছই আবুল হাশেমকে দিয়েছে সমৃদ্ধির খোঁজ, উন্নয়নের পথ। সমৃদ্ধি, উন্নতি বা সুখ যা-ই বলি সবকিছুর পেছনে রয়েছে তার নিরলস শ্রম, নিষ্ঠার পাশাপাশি বিনিয়োগের সাহস। আর শক্তি হিসেবে কাজ করেছে অতীতের কষ্টের দিনগুলো। নিজের অতীতকে তিনি ভুলে যাননি। তিনি জানেন মাছ আর শ্রমই তার সচ্ছলতার মূল। এ জন্য মাছ চাষকে তিনি বলেন তার ইন্ডাস্ট্রি। এই ইন্ডাস্ট্রিতে যুক্ত করেছেন পরিবারের সবাইকে। আবুল হাশেমের কথায় মনে পড়ে গেল আরেক আবুল হাশেমের কথা। প্রায় ১৪ বছর আগের কথা। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার মাছ চাষি আবুল হাশেম তার মাছের পুকুর দেখিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘এটাই স্যার আমার ব্যাংক। এখানে জাল ফেললেই টাকা। চেক নিয়ে ব্যাংকে বসে থাকতে হয় না।’ যাই হোক, ফেরা যাক নরসিংদীর আবুল হাশেমের কথায়। সদা হাস্যোজ্জ্বল, সাদাসিধে মৎস্য খামারি আবুল হাশেম নিজের সাফল্যের গল্প বলেন অকপটে। মাছ চাষ করেই একের পর এক পূর্ণ করছেন বৈষয়িক প্রত্যাশাগুলো। একসময় যেখানে ছিল জীর্ণ ছনের ঘর, সেই ভিটেতে এখন পাকা বাড়ি। আগামীতে আরও বড় বাড়ি নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। অথচ এক শতক জমিও ছিল না তার। শূন্য থেকে শিখরে পৌঁছানোর এই কঠিন পথের সহযাত্রী ছিলেন তার স্ত্রী ইয়াসমিন বেগম। ইয়াসমিন বেগমের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আবুল হাশেমের এই অর্থনৈতিক পরিবর্তন সম্পর্কে। তিনি জানান, এ পরিবর্তন কোনো জাদুতে হয়নি। কঠোর পরিশ্রম তাকে এ সাফল্য এনে দিয়েছে। এলাকাবাসীও একই কথা বলেন, আবুল হাশেম শুধু নিজের ভাগ্যই বদলাননি, খুলে দিয়েছেন গ্রামের সবার চোখ। শিখিয়ে দিয়েছেন দিনবদলের সূত্র, সমৃদ্ধির মন্ত্র।

শুরুটা মাছ দিয়ে হলেও মৎস্য খামারের পাশে গড়েছেন ডেইরি ও পোলট্রি খামার। আর বড় বড় পুকুরের প্রশস্ত পাড়ের দুই পাশে পরিকল্পিতভাবে লাগানো হয়েছে পেঁপে, কলা, লাউ, কুমড়াসহ দরকারি শাক-সবজি। এসব থেকেও ভালো লাভ পাচ্ছেন তিনি। মাছ চাষের সাফল্য পুঁজি করে আবুল হাশেম এখন পুরোদস্তুর মাছের খাদ্য ব্যবসায়ীও। আগামীতে এ মাছ চাষ নিয়ে আরও বহুমুখী বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা রয়েছে তার। পরিকল্পনা অনেক দূর যাওয়ার। আজকের দিনে এমন সফল মানুষগুলোই ঘোরাচ্ছে আমাদের কৃষি-অর্থনীতির চাকা। আমরা যে উন্নয়নের হিসাব কষছি সে উন্নয়নের পেছনে রয়েছে আবুল হাশেমের মতো নিষ্ঠাবান মানুষ। এখনো এ মানুষগুলোই অন্যদের কাছে উদাহরণ ও অনুপ্রেরণা। আবুল হাশেমের এ সাফল্যের গল্প, আরও বহু হাশেমকে উজ্জীবিত করুক, দূর হোক বেকারত্বের অভিশাপ। বাংলাদেশের প্রতিবেশব্যবস্থা মিঠাপানির মাছ চাষের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। বাংলাদেশ সরকারের ভিশন-২০২১-এ দেশে মাছের উৎপাদন ৪৫ লাখ মেট্রিক টন; যা বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে ১০ লাখ মেট্রিক টন বেশি। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনার পাশাপাশি সামুদ্রিক মাছ আহরণের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সমুদ্রে মাছ আহরণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ২৫তম। মাছ এ দেশের অর্থনীতির এক রুপালি অধ্যায়। এখানে রয়েছে কর্মসংস্থান সৃষ্টির অনুপম সম্ভাবনা। তরুণ প্রজন্ম এ সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে, পাশাপাশি সমৃদ্ধ করতে পারে দেশের অর্থনীতিকেও।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর