শনিবার, ১৮ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

মোদি না রাহুল কে হবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মোদি না রাহুল কে হবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী

ভারতের সাত দফায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ছয় দফা ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ১৯ মে অনুষ্ঠিত হবে শেষ দফার ভোট। ফলাফল পাওয়া যাবে ২৩ মে। নির্বাচনে কি ফল দাঁড়াবে সেটা নিয়ে শুধু ভারতেই নয়, সারা বিশ্বেই চর্চা হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রচারে সরকারি দল বিজেপি এবং একাধিক আঞ্চলিক দল একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে বৈশাখী গরমের সঙ্গে নির্বাচনী সরগরম আরও বাড়িয়ে তুলেছে। রাজধানী দিল্লির ৭নং রেসকোর্সের বাসিন্দা কে হবে? এ নিয়েও জোর চাপান-উতোর চলছে। হিন্দি বলয়ে কোটি কোটি টাকার জুয়াখেলা হচ্ছে জোটের ফলাফলের বাজি ধরে। শুধু হিন্দি বলয়ে নয়, কলকাতার বড় বাজারে গুজরাটি ব্যবসায়ীরা সাট্টা খেলায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে বলে নির্বাচন কমিশনের কাছে ভূরি ভূরি নালিশ হয়েছে। তাদের বাজি একটাই ৭নং রেসকোর্সের বাসিন্দা নরেন্দ্র মোদি আরও পাঁচ বছর থাকবেন- নাকি অন্য কেউ আসছেন? প্রায় ১০০ দিনের নির্বাচনী প্রচারে নেমে নরেন্দ্র মোদি, বিজেপি সভাপতি অমিতশাহ এবং আরএসএস প্রধান মোহন ভগবত বিরোধী জোটগুলোকে কটাক্ষ করে বলছেন- আপনাদের প্রধানমন্ত্রী কে? আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো নরেন্দ্র মোদি, সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে কংগ্রেস দল তাদের এবং জোটের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে রাহুল গান্ধীর নাম সরকারিভাবে ঘোষণা করেছেন। তাহলে লড়াইটা হচ্ছে রাহুল বনাম মোদি। রাহুল গান্ধীর কাছে ৭নং রেসকোর্স রোড নতুন নয়। তার শৈশব কেটেছে ওই বাড়িতেই, কারণ তার বাবা রাজীব গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ভারতের নির্বাচন তথা ভারত শাসন বলে কথা- কেউ এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ। আর তার ওপরে চলছে জাত-পাত নিয়ে একটা বিভাজন। আর চলছে ব্যাপক মিথ্যাচার। চার দফা নির্বাচন শেষ হতে না হতেই গেরুয়া বাহিনী আবিষ্কার করল কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ভারতের নাগরিক নয়, এ নিয়ে তারা প্রচ ভাবে আসরে নামে। আর যিনি এটা প্রকাশ্যে আনেন তিনি হলেন আরএসএসের বড় মাপের নেতা সুব্রমানিয়ম স্বামী। গান্ধী পরিবারের প্রতি তার একটা ব্যক্তিগত ঈর্ষা আছে।  হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক মোদি যখন ক্ষমতায় আসেন তখন সারা দেশে গো-হত্যার বিরোধিতার নামে মানুষ হত্যা শুরু করলে এটাকে তিনি সমর্থন করে দিল্লির ইংরেজি কাগজে একাধিক প্রবন্ধ লেখেন। তা দেখেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে চাকরিচ্যুত করে। দেশে ফিরে তিনি আরএসএসের কোটায় রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য হন। এরপর তিনি গান্ধী পরিবারের নামে বিনা কারণে ৭-৮টি মামলা করেন। ভারতের শীর্ষ আদালত সবগুলো মামলাই খারিজ করে দেন। মোদি পাঁচ বছর আগে কংগ্রেসমুক্ত ভারত গঠনের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই স্বপ্নের প্রধান প্রচারক ছিলেন ড. সুব্রমানিয়ম স্বামী। তার সর্বশেষ ব্রহ্মাস্ত্র হলো রাহুল ভারতীয় নাগরিক নয়। বস্তুত, এই প্রতিবেদকের অর্থাৎ আমার ঠিক মনে আছে ১৯৭০ সালে ৩০ জুন রাহুল গান্ধী যেদিন জন্ম নিলেন সেদিন তার ঠাকুমা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় নির্বাচনী প্রচারে ছিলেন। নির্বাচনী প্রচার সেরে তিনি সার্কিট হাউসে ঢুকতেই পুরুলিয়ার জেলাশাসক তাকে খরবটা দিতেই তিনি উল্লসিত হয়ে উঠেন। তাকে দেখে তখন মনে হচ্ছিল তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি একজন ভারতীয় ঠাকুমা। পাশে দাঁড়ানো সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়কে বললেন মানু (সিদ্ধার্থর ডাক নাম) তুমি এখনই দুর্গাপুর, আসানসোলের দুটি সভা বাতিল করে দাও। আসামকেও জানিয়ে দাও আমি সন্ধ্যায় আসামে সভা করব না। আমি এখনই দিল্লি ফিরে যাচ্ছি।

সেখানে আমি ছাড়া আরও দুজন রিপোর্টার ছিলেন। আমরা আবদার করে বললাম- আমাদের খাওয়াবেন না? তার জন্য টেবিলে রাখা সন্দেশ, লাড্ডু ও কাজুবাদাম দু’হাত ভরে তুলে আমাদের তিনজনকে দিলেন। ১৯৯১ সালের মে মাসে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে রাহুল গান্ধীর বাবা রাজীব গান্ধী দক্ষিণ ভারতের শ্রীপেরামপুদুরে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর রাহুল গান্ধী ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে যান। ব্রিটিশ নিয়ম অনুযায়ী তৃতীয় বিশ্বের যে সব ছাত্রছাত্রী ইংল্যান্ডে পড়তে যান সপ্তাহে তাদের ৪০ ঘণ্টা করে আংশিক কাজের অনুমতি মেলে। রাহুল গান্ধী সেই ৪০ ঘণ্টা কাজের জন্য যে মজুরি পেতেন তা থেকে তিনি কর দিতেন আর এটাই ব্রিটিশ নিয়ম। এখনো এই নিয়ম বলবত আছে। আর সুব্রমানিয়ম স্বামীর বক্তব্য হলো যেহেতু রাহুল গান্ধী ওই দেশে কর দিয়েছেন তাই তিনি ও দেশের নাগরিক। ২০১৫ সালে তার বিরুদ্ধে এই নালিশ জানানো হয়েছিল সংসদের অ্যাথিক্স কমিটিতে।

অ্যাথিক্স কমিটির বিদায়ী চেয়ারম্যান বিজেপির প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি। আদবানি সব কাগজপত্র পরীক্ষা করে রায় দিয়েছিলেন রাহুল ভারতীয়ই। হঠাৎ চার বছরের মাথায় বিজেপি যখন বুঝতে পারল তাদের ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই তখনই তারা ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভারতের ভোটারদের সামনে প্রচার করার জন্য যে রাহুল বিদেশি নাগরিক। এটা তারা তার মা অর্থাৎ সোনিয়া গান্ধীর ব্যাপারেও করেছিল। এভাবে কি ভারতকে গান্ধী পরিবারমুক্ত করা যাবে? কারণ তাদের এসব অভিযোগ ধোপে টেকেনি। সব শেষে ভারতের সুপ্রিম কোর্টও সুব্রমানিয়মের দাবি নাকচ করে দিয়েছে। কংগ্রেস মুখপাত্র রণদেব সিং সূর্যওয়ালা সাংবাদিকদের ডেকে বলেছেন প্রচারে কংগ্রেস থেকে যে কয়টি প্রশ্ন গেলা হয়েছিল- যেমন রাফেল দুর্নীতি, ভয়াবহ বেকার সমস্যা, চাষী ঋণ মওকুব এসব গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নের জবাব মোদি বা তার গেরুয়া বাহিনী দিচ্ছে না। আমরা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে মোদি ক্ষমতায় এলে দেশ জাত-পাতের ভিত্তিতে ভাগ হবে। নির্বাচনী প্রচারে মুখ মোদি ও অমিতশাহরা ভোটের আচরণবিধি লঙ্ঘন করে চলেছেন। এ ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে শত শত অভিযোগ জমা পড়েছে।

এবার একটু পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকানো যাক। মোদি যখন বুঝতে পেরেছেন হিন্দি বলয়, দক্ষিণ ভারত এবং পশ্চিম ভারতে কোনো মোদি হাওয়া নেই। নেই গেরুয়া বাহিনীর লম্ফঝম্ফ। তাই তার নজর এখন পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা ও উত্তরপূর্ব সীমান্ত রাজ্যে। কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না একদা মমতার হাত ধরেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। তারই স্বীকৃতি স্বরূপ মমতা পাঁচ বছর ধরে গোপনে মোদিকে সন্দেশ, লাড্ডু, কুর্তা পাঠিয়ে চলেছেন। একথা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী জনসভায় এসে মোদি ফাঁস করে দিয়েছেন। এর ফলে মমতা দিদি যারপরনাই ক্ষেপে গিয়ে মোদির বিরুদ্ধে যে ধরনের বাক্যবাণ বর্ষণ করছেন তা যে কোনো বাঙালির কানে অশ্রাব্য ঠেকছে। দিল্লির দাদা ও পশ্চিমবঙ্গের দিদির মুখে সাধারণ মানুষের উন্নতি নিয়ে কোনো কথা নেই। তারা পারস্পরিক তরজায় মেতে আছেন, এমএলএ ও এমপি কেনাবেচার রীতি তারা শুরু করেছেন বাংলার দিদি। ইতিমধ্যে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের ২০ জন বিধায়ক ও কংগ্রেসের একজন সংসদকে কিনেছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এবারের নির্বাচনে দাদা ও দিদির মধ্যে বিধায়ক ও সংসদ সদস্য কেনাবেচার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে।

দিদি প্রধানমন্ত্রী হতে চান, আর দাদাও দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসতে চান, তর্কের খাতিরে ধরা যাক দিদি পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের মধ্যে ৪২টি পেলেন তা হলেও ২৭৪টি না পেলে দিদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন না। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রাজ্য আসামে বিজেপি ৫-৬টি আসন ছাড়া যে পাবে না তা তারা ভালো করে বুঝে গেছে। প্রবীণ সাংবাদিক যাকে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রাজ্যের বিশেষজ্ঞ বলে মনে করা হয় সেই সুবীর ভৌমিক সম্প্রতি ওই রাজ্যগুলো ঘুরে এসে বলেছেন যে, আসামের ৪-৫টি ছাড়া আর কোথাও বিজেপি দাঁত ফোঁটাতে পারবে না।

এর প্রধান কারণ হলো মোদি ও মমতার জাতীয় নাগরিক পুঞ্জ কায়েম করার হুমকি দেওয়া। ভারতের সর্বশেষ নির্বাচন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অনেক নির্বাচন বিশেষজ্ঞ আশা প্রকাশ করেছেন দিল্লির ৭নং রেসকোর্সের বাসিন্দা হতে চলেছেন রাহুল গান্ধী। যদিও সময় আসল কথা বলবে।               

                লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর