মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

দুর্নীতি প্রতিরোধ : মানুষ শুদ্ধ না হলে কাঠামো পরিবর্তন বৃথা

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী

দুর্নীতি প্রতিরোধ : মানুষ শুদ্ধ না হলে কাঠামো পরিবর্তন বৃথা

আগামী প্রজন্ম নিয়ে দুদকের অনেক স্বপ্ন। সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এক পরামর্শমূলক সভার আয়োজন করে দুদক। তরুণ ছাত্রছাত্রীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছিল। তারা নিঃশঙ্কচিত্তে দুর্নীতি প্রতিরোধে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করেছে। তাদের একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রিফাত আরা বৃষ্টি। তীক্ষèতার সঙ্গে বৃষ্টি বলেছিল ‘কীভাবে মানুষের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী চেতনা তৈরি করা যায়, সে বিষয়ের ওপরে জোর দিতে হবে। বৃষ্টি অফিসগুলোর কাঠামোগত পরিবর্তনের ওপর আলোকপাত করে বলে, এমন কাঠামো তৈরি করতে হবে, যার কারণে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারবে না। বৃষ্টি, তোমার প্রস্তাবিত কাঠামোগত পরিবর্তন কিংবা সিস্টেম পরিবর্তনের পরও তার সুফল পাওয়া এত সহজ নয়। কারণ সিস্টেমের পশ্চাতে থাকে যে মানুষ, সে মানুষটি সৎ ও শুদ্ধ না হলে সিস্টেম অকার্যকর হয়ে যায়। বহু প্রতিষ্ঠানে এভাবে পদ্ধতিগত সংস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু যে মানুষগুলো এসব সংস্কার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ছিল তারা হয় অদক্ষতায় ব্যর্থ হয়েছে অথবা দুর্নীতির সঙ্গে অভিযাজিত হয়েছে। ফলে দুর্নীতিমুক্ত চেতনা সৃষ্টির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে আমরা পৌঁছতে পারছি না। একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরি। ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ সেক্টরে ডেসা নামক এক বিশাল প্রতিষ্ঠান ছিল, যার মূল দায়িত্ব ছিল সমগ্র ঢাকা শহরে বিদ্যুৎ বিতরণ করা। ওই প্রতিষ্ঠানে বল্গাহীন দুর্নীতি বন্ধে একটি পরিবর্তন আনা হয়েছিল, যার নাম ছিল কাঠামোগত সংস্কার। এর আওতায় সরকারি প্রতিষ্ঠান ডেসা ভেঙে সৃষ্টি করা হলো কোম্পানির আদলে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। বিশ্ব ব্যাংকের Structural Adjustment Program (SAP) এর আওতায় এটি ছিল বিদ্যুৎ সেক্টরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, ফলে এসব কোম্পানিতে সুশাসনের ঢেউ লেগেছিল। কোম্পানির বেতন ভাতা হয়ে গেল দ্বিগুণ-তিনগুণ। করপোরেট স্টাইলে অফিস সুসজ্জিত হলো, আইএসও সনদ পেল। কিন্তু এরপর সৃষ্টি হলো দুর্নীতির ডালপালা। সুতরাং, কাঠামোগত পরিবর্তন হলেই দুর্নীতি বন্ধ হয় না। কাঠামোর ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বপ্রাপ্তরাই কাঠামো অকার্যকর করে দেয়। আরও দৃষ্টান্ত দেখ। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর লক্ষ্যে চালু হলো অটো সিগন্যাল সিস্টেম। কিন্তু তা আবার ম্যানুয়েলে ফিরে গেছে। কারণ অটো সিগন্যাল বহাল রেখে ১০ মিনিটের জন্য ঢাকা শহর থেকে ট্রাফিক পুলিশ রাস্তা থেকে তুলে নিলে দেখা যাবে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই একযোগে প্রতিযোগিতামূলকভাবে আইন ভেঙে সড়কে ভয়ঙ্কর এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ তৈরি করে ফেলবে। একই চিত্র কয়েকটি সেবা সংস্থার, যেখানে অনলাইনে আবেদন গ্রহণ থেকে সার্ভিস ডেলিভারি পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াই Automated. কিন্তু মাঝ পথে Interruption হচ্ছে, Serial ভেঙে কেউ কেউ সুবিধা নিচ্ছে। আরও বিচিত্র গল্প বিদ্যুৎ সেক্টরে। বিদ্যুতের চুরি কমাতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ডিজিটাল মিটার চালু হয়। কিন্তু এরপর শুরু হয় শিল্প কারখানা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানে ‘সেন্সর’ বসিয়ে অদ্ভুত কৌশলে দুর্নীতি। নতুন প্রযুক্তিতে কারচুপির আশ্রয় নিয়ে মিটার থেকে মুছে ফেলা হয় বিশাল অঙ্কের বিদ্যুৎ ইউনিট। এমনকি Software-এ logical meter পরিবর্তন দেখিয়ে লাখ লাখ বিদ্যুৎ ইউনিট গায়েব করে ফেলা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ১ লাখ ইউনিট বাস্তব রিডিং থাকা সত্ত্বেও ২০ হাজার ইউনিট Consumption দেখানো হয়েছে। এমনকি প্রিপেইড মিটারেও অনৈতিক হস্তক্ষেপ ঘটেছে। হার্ডওয়্যার এবং ডাটা পরিবর্তন করা হয়েছে। একইভাবে মহাসড়কে ভারী যানবাহনের ওভারলোডিং রোধে ওজন মাপার যন্ত্র বসানো হয়েছিল, কিন্তু কেউ মানতে চায় না। এটাও এক ধ্বংসাত্মক দুর্নীতি। কারণ ওভারলোডিং-এর দুর্নীতির পরিণতিতে দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে সড়ক-মহাসড়ক। এভাবে আঙ্গুল ফুলে বটগাছে পরিণত হয়েছে বিচিত্র এসব দুর্নীতির সুফলভোগীরা। দেখ, বিশ্বজুড়ে অটোমেশনের জয়জয়কার, অথচ এর সমান্তরালে চলছে প্রযুক্তির অপব্যবহার। ঘটছে বড় বড় আর্থিক দুর্নীতি। অনলাইনে অভিনব কায়দায় ভারতের সিটি ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে দুই মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেওয়া হয়। সাইবার আক্রমণে কত হাজার ব্যাংক আক্রান্ত হয়েছে, তার হিসাব নেই। ই-মেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে বড় বড় দুর্নীতি ঘটার দৃষ্টান্তও আছে অজস্র। প্রযুক্তির শক্তিও দুর্নীতির থাবা স্তব্ধ করতে পারছে না। অন্তরের সুপ্তে বাস করা এবং রক্ত-মজ্জায় মিশে যাওয়া এ এক কঠিন ব্যাধি, যার নাম দুর্নীতি। মানুষের সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই দুর্নীতি নামক এ রসায়নের উৎপত্তি। সেই রসায়নের গভীরতা এখন এত বেশি, প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মতো সৎ লোক খুঁজে বের করে আনতে হয়। তাহলে দুর্নীতি বন্ধের উপায় কী? একমাত্র পথ সততায় উজ্জীবিত ও দেশপ্রেমে আলোকিত মানুষ। আমরা নিখুঁত সততার বীজ রোপণ করতে চাই তোমাদের অন্তরে। সঞ্চারিত করতে চাই সততার চেতনা তোমাদের মস্তিষ্কে, রক্তে এবং নিউরণে। তোমরাই ভবিষ্যতের জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, প্রকৌশলী এবং সৎ ও সুনাগরিক। বৃষ্টি, এ প্রজন্মের তরুণদের একটা অংশ এখন চাকরিতে বা পেশায় প্রবেশ করেই অর্থ, ক্যারিয়ার এবং ঐশ্বর্যে ভরা জীবনের অমোঘ আকর্ষণে অসহিষ্ণু হয়ে ছুটে বেড়াও। এমনকি বেতন ভাতা বাড়িয়েও অনেকের দুর্নীতির চিরায়ত অভ্যাসে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আবার অনেক করপোরেট সেক্টরেও দুর্নীতি ঘটছে অবলীলায়। মেধাবীরাও অনৈতিক অর্থের প্রতিযোগিতায় ছুটছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কয়জন কমিটেড হও? ব্যক্তি লাভ, ব্যক্তি অর্জন ও ব্যক্তি অভিলাসের স্রোতে চাপা পড়ে যায় রাষ্ট্রস্বার্থ, জনস্বার্থ এবং বৃহৎস্বার্থ। তারুণ্য মানে অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ সত্তা, অপরিমেয় শক্তির আধার একজোড়া ডানা। কিন্তু সে তারুণ্য যদি বস্তুবাদিতা, ভোগবাদিতা আর বিপথগামিতার এক মোহনায় মিশে যায় তাহলে দুর্নীতির নিকষ অন্ধকারে ধাবিত হওয়া জাতিকে আলোর পথ কে দেখাবে? মরচে পড়া সততাকে কে শাণিত করবে? তোমাদের মতো তরুণদের বুঝিয়ে সততা শিক্ষা দেওয়া যায়, কিন্তু বড়দের সততার বোধোদয় জাগাতে হয় ভয় দেখিয়ে, শাস্তি দিয়ে। মানুষের সততার বীজ অঙ্কুরিত হয় পরিবারে এবং বিকশিত হয় স্কুল জীবনে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ঝুসনরড়ংরং থেকে পাওয়া সৎ জীবনযাপনের রূপরেখা সারাজীবনের পথচলার দীক্ষা। আমাদের পিতা-মাতার অল্পে তৃপ্ত এবং শিক্ষকদের স্বল্পে তুষ্ট জীবনগুলো আমাদের জন্য অনির্বাণ আদর্শ। শৈশবে ও কৈশোরে সততার যে শিক্ষা, যৌবনে তার চর্চা, প্রৌঢ়ত্বে তার পূর্ণতা। প্রত্যাশা করি, তোমাদের দিয়েই শুরু হবে শুদ্ধ পথে চলা, সরল পথে চলা। কাদায় আটকে যাওয়া চাকাকে তুলতে হবে। দুর্নীতিকে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে তোমরা এগিয়ে এসো, দেশ এগিয়ে যাবে।

                লেখক : মহাপরিচালক বিজ্ঞান জাদুঘর।

 

সর্বশেষ খবর