শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

কৃষক বাঁচাতে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে

জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু

কৃষক বাঁচাতে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে

শরণাতীত কাল থেকেই বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। বর্তমান শতাব্দীতে প্রযুক্তির বহু উন্নতি হয়েছে। আমাদের কৃষকরাও কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে আজ বাংলাদেশ চালসহ অন্যান্য প্রায় সব কৃষিপণ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত উৎপাদন করছে। এই কৃতিত্ব এ দেশের কৃষকের। গ্রামে যেখানে শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষ বাস করে, কোনো কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে বা কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হলে আমাদের খাদ্য সংকট মোকাবিলায় আমদানির ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। আমরা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছি। কিন্তু গত কয়েকদিনের পত্রিকা খুললে কী দেখতে পাই? যে কৃষক সাড়ে ষোলো কোটি মানুষের অন্ন যোগায়, যে কৃষক ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রামে আশ্রয় দিয়েছিল। যাদের সহযোগিতা ছাড়া স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে পারতাম না। সেই কৃষক আজ তাদের উৎপাদিত পণ্য ধান না কেটে অনেক জায়গায় জমিতে পুড়িয়ে দিচ্ছেন। মানুষ কখন তার উৎপাদিত দ্রব্য বা সৃষ্টিকে ধ্বংস করে? যখন মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে। মানুষের বাঁচার সংগ্রামে পরাস্ত হতে যায় তখনই যখন সে নিজের সৃষ্টিকে ধ্বংস করে। এটাই বাস্তবতা। এই ধরনের প্রচুর ঘটনা ইতিহাসে ঘটেছে।

স্বাধীনতার পর আমাদের প্রচুর খাদ্য আমদানি করতে হতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পি এল ৪৮০ কর্মসূচির অধীনে আমরা খাদ্য সাহায্য পেতাম। কিন্তু এখন স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরের মাথায় আমরা কেবল কৃষিপণ্যে উদ্বৃত্তই নয়, বরং অনেক কৃষিজাত দ্রব্য রপ্তানি করছি। আমরা এমনকি সুগন্ধি চালও রপ্তানি করছি। এবার আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি কৃষকরা বোরো ধানের বাম্পার ফলন ফলিয়েছে। কিন্তু এতে কি কৃষকের ঘরে স্বস্তি এসেছে? এক মণ ধান উৎপাদন করতে কৃষকের খরচ হয় ৯০৬ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ কৃষক এক মণ ধান বিক্রি করে পাচ্ছে ৫০০ টাকা। একজন মজুরকে দিনে দিতে হয় ৮৫০ টাকা। তাহলে কৃষক কীভাবে বাঁচবে? কীভাবে তার পরিবারের ভরণপোষণ করবে? কীভাবে আমাদের মুখে অন্ন তুলে দিবে যার নিজের পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা নেই? কৃষকরা হরতাল করে না। কৃষকরা অবরোধ করে না। অগ্নি সন্ত্রাস করে না। রাজনীতির ডামাডোলে মাথা ঘামায় না। দেশের যে কোনো রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিবেশে কৃষক ধানসহ কৃষিপণ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখে। যার ফলে কোনো রাজনৈতিক বৈরী অবস্থায় কৃষক উৎপাদন বন্ধ করে না। এটি হচ্ছে আমাদের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। যা নিয়ে আমরা গর্ব করি। কিন্তু যারা এই দেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে তারা আজ ধানের খেতে আহাজারি করছে উদ্বৃত্ত ফলন নিয়ে। এটা কি তাদের অপরাধ? এখানে কি সরকারের কোনো দায়িত্ব নেই? মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে সরকার ধান সংগ্রহ করছে। অথচ কৃষকরা কেবলই প্রতারিত হচ্ছে। এই কৃষকদের যদি আমরা এই কঠিন সংকট থেকে পরিত্রাণ করতে না পারি তাহলে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।

ইউরোপ-আমেরিকায় সরকারগুলো ভর্তুকি দিয়ে উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপাদন কিনে নিয়ে কৃষকের পাশে দাঁড়ায়। দেশকাল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অন্ন-বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা-স্বাস্থ্য মানবজীবনের প্রধান মৌলিক চাহিদা। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান চাহিদা হচ্ছে অন্ন। সেই অন্নের জোগানদাতা হচ্ছে আমাদের সরলপ্রাণ দেশপ্রেমিক কৃষক সমাজ। বাংলাদেশ এখনো কৃষি প্রধান দেশ। পাশ্চাত্য দেশগুলো শিল্পোন্নত দেশ। কিন্তু তারপরও তারা কৃষি এবং কৃষকের স্বার্থক সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়। আমাদের এখনো অনেক জায়গায় নুন কিনতে পান্তা ফুরায়। তাই আমাদের প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান জোগানদাতা কৃষককে যদি বাঁচাতে না পারি তাহলে মধ্যআয়ের দেশ গড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।

আমরা কৃষিবান্ধব সরকার চাই। আমরা উৎপাদনের সহায়ক সরকার চাই। কৃষকদের ফসল এখনো মাঠে। কৃষকের মাঠের ফসলে আগুন দেওয়া সরকারের জন্য অশনিসংকেত। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। আমাদের দেশে অতীতে অর্থনৈতিক সংকট হয়েছে। দুর্ভিক্ষ হয়েছে। তার মূল কারণ খাদ্যের স্বল্পতা। খাদ্য সংকট দেশকে অস্থিতিশীল করে ফেলে এবং দেশের প্রতিটি মানুষকে বিচলিত করে। আমরা সবাই পরিশ্রম করি পরিবার পরিজন নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার জন্য। এই মুহূর্তে আমাদের কৃষকের যে অবস্থা তারা যদি ভবিষ্যতে ধানসহ অন্যান্য কৃষি উৎপাদন কমিয়ে দেয় তাহলে আমাদের অর্থনীতি কঠিন সংকটের সম্মুখীন হবে। আমাদের খাদ্য আমদানি বেড়ে যাবে। কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশ খাদ্য আমদানিতে চলে যাবে। ফলে দেশের সব উন্নয়ন কর্মকা  ব্যাহত হবে। কৃষিতে যেমন বিনিয়োগ কমবে তেমনি শিল্পেও বিনিয়োগ কমবে। যার ফলে কর্মসংস্থান আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। তাই কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়া মানেই একটা সর্বগ্রাসী সংকটের দিকে ধাবিত হওয়া। এজন্য সময় থাকতেই এই প্রকট সমস্যার সমাধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর তনয়া এদেশের গ্রামের মানুষ। তিনি এদেশের কর্মঠ ও দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা কৃষকদের দেখেছেন। তাই তার প্রতি সনির্বদ্ধ অনুরোধ থাকবে অবিলম্বে আমাদের দেশের প্রাণশক্তি কৃষককে বাঁচানোর জন্য মধ্যস্বত্বভোগীর বিলোপ ঘটিয়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে প্রয়োজনে বেশি দামে ধান কিনে কৃষককে বাঁচান। এই কৃষকই আমাদেরকে স্বস্তি দেবে। শান্তি দেবে। সমৃদ্ধি দেবে। প্রবৃদ্ধি দেবে আগামীতে। জরুরি ভিত্তিতেই এই কাজটি করা দরকার। এটি সময়ের দাবি। এটি বাস্তবতার দাবি। আসুন সবাই মিলে কৃষককে বাঁচানোর জন্য এককাতারে দাঁড়াই।

                লেখক : প্রাক্তন মন্ত্রী, প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাতীয় পার্টি।

সর্বশেষ খবর