শনিবার, ২৫ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

ধানের আগুন প্রাণে লেগেছে

শাইখ সিরাজ

ধানের আগুন প্রাণে লেগেছে

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যাওয়া একটা খবর হচ্ছে ‘কৃষক ধানের দর না পেয়ে খেতে আগুন দিয়েছে’। আমি ব্যক্তিগতভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় এত অ্যাক্টিভ নই। তবে আমার ফেসবুকে একটা ভ্যারিফাইড পেইজ আছে, সেখানেও ইউটিউবে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর টিভি কন্টেন্টগুলো আপলোড করি দর্শকদের সুবিধার্থে। কয়েক দিন ধরেই ফেসবুকের মেসেঞ্জারে, পোস্টের নিচে কমেন্টে অনেকেই বলছিলেন কৃষক ধানের দর পাচ্ছেন না।  কিন্তু ধান খেতে আগুন দেওয়ার খবরটি মানুষকে ব্যথিত করেছে বেশি। চ্যানেল আইয়ের টাঙ্গাইল প্রতিনিধি মুসলিম উদ্দিন যখন খবরটি আমাকে জানান তখন আমিও বেশ ব্যথিত হই। কালিহাতী উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের বানকিনা গ্রামের কৃষক আবদুল মালেক সিকদার এক দাগের ৫৬ শতাংশ জমির ধান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলছেন, বাজারে এক মণ ধান বিক্রি করলে পায় ৫০০ টাকা। এদিকে ধান কাটানোতে শ্রমিককে দিতে হচ্ছে এক হাজার টাকা। ধান কেটে এনে শ্রমিকের টাকাই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর অন্য খরচ তো রয়েই গেছে। লোকসানের কথা ভেবে রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে মালেক সিকদার আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছেন ফসলের খেত। কৃষকের এই অভিমান, ফলানো ফসল নষ্ট করে প্রতিবাদ করা নতুন কিছু নয়। আমরা এর আগেও দেখেছি সিলেটে টমেটোর দর না পেয়ে বস্তা বস্তা টমেটো রাস্তায় ফেলে নষ্ট করেছে কৃষক। আরও আগে ময়মনসিংহে বেগুনের দর না পেয়ে কৃষক মণকে মণ বেগুন নষ্ট করে দিয়েছে। কৃষকের এই অভিমানে, এই প্রতিবাদে আমরা ব্যথিত হই বটে কিন্তু এ সমস্যা সমাধানে আমরা আসলে কতটা তৎপর?

গত মার্চ-এপ্রিলে দেশের পাঁচ জেলায় আসন্ন ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ প্রাক বাজেট আলোচনায় বার বার ধানের মূল্য নিয়ে কৃষকের হতাশার বিষয়টি উঠে এসেছে। সে সময় আমন মৌসুমের ধান বাজারে ছিল। কৃষক আশঙ্কা করছিল বোরো মৌসুমে এমন হলে তারা মারা পড়বে। হলোও তাই। মনে পড়ছে নাটোরে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সামনে এক কৃষক বলছিলেন, ‘কী আর বলব! এবার ধানের ফলন বেশ ভালো হয়েছে, ঘরে ৭০০ থেকে ৮০০ মণ ধান। ধান রাখার জায়গা নেই। কিন্তু এই ধান দিয়ে আমি কী করব? ধানের তো দাম নাই। ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা মণ ধান বিক্রি করলে তো খরচের অর্ধেকও আসে না।’

আমি ৮/১০ দিন ধরেই দেশের বিভিন্ন স্থানের ধানের বাজার দর সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি। ফোনে কথা বলেছি বিভিন্ন কৃষকের সঙ্গে। তাদের অনেকের দাবি, গত ১০ বছরে ধানের এত কম দাম তারা দেখেনি। দিনাজপুরের বিরুল উপজেলার কৃষক মতিউর রহমান জানিয়েছেন, তার এলাকায় ব্রি ২৮ ধান প্রতি বস্তা (কাঁচা ধান ৭৬ কেজিতে এক বস্তা) বিক্রি করতে হচ্ছে ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকা দরে। অথচ প্রতি বস্তা ধানের উৎপাদন খরচ ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা।

ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বওলা গ্রামের কৃষক আবু হেলাল খান জানিয়েছেন, ধানের দর ৫০০-৫৫০ টাকা। এই দরে ধান বিক্রি করলে খরচই উঠবে না। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয় না করায় ন্যায্যমূল্য থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।

সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্বরপুরের আমিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি ৮ বিঘা জমিতে ব্রি ২৮ ও ব্রি ২৯ জাতের ধান চাষ করেছেন। বিঘাপ্রতি ফলন পেয়েছেন ১০-১২ মণ। প্রতি বিঘায় ধান ফলনে খরচ হয়েছে ৫ হাজার টাকা। অথচ ধান বিক্রি করে পাচ্ছেন ৫ হাজার ৫০০ টাকা। তিনি প্রশ্ন রাখেন, এই দরে ধান বিক্রি করে তিনি কীভাবে সংসার চালাবেন?

নেত্রকোনার কৃষক বিকাশ কুমার জানিয়েছেন, তার এলাকায় কাঠাপ্রতি জমিতে ৫ মণ ধান হয়েছে। প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকায়। অথচ এক কাঠা জমিতে ধানের আবাদ, কাটা ও মাড়াই পর্যন্ত ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা খরচ হয়।

বরিশাল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পটুয়াখালী, রাজশাহী, বগুড়া সব এলাকার কৃষকের এক কথা ধানের দর নেই। আমি কৃষকের কাছে জানতে চেয়েছি, ‘এই যে বলেন ধানের দর নেই, তাহলে ধান চাষ কেন করেন? অন্য কিছু চাষ করেন।’ কিন্তু ধান চাষ এ দেশের কৃষকের রক্তের ভিতর। তারা জানান, ‘ধান না করে করব কী? অন্য কোনো ফসল করার সঙ্গতি আমাদের নেই।’ ধানের একটা কৃষকবান্ধব বাজার তৈরির বিকল্প নেই। সরকার বলছে ১ হাজার ৪০ টাকা মণ ধরে তারা ধান কিনবে। তবে সরকারের ধান কেনার প্রস্তুতি সময়টা একটু দীর্ঘ। এর ভিতর একশ্রেণির সিন্ডিকেটভুক্ত ফড়িয়া সুবিধা নেওয়ার জন্য নানারকম গুজব ছড়িয়ে কম দামে ধান কিনে সংরক্ষণ করছে। আবার আমরা যদি খাদ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান দেখি তাহলে দেখব চলতি আমন ও গত বোরো মৌসুমে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে যথাক্রমে ৭ লাখ ৯৯ হাজার ৯৬৬ টন ও ১৩ লাখ ৯৫ হাজার ৪২৬ টন চাল ক্রয় করেছে। যা মৌসুমভিত্তিক মোট উৎপাদনের ৫ দশমিক ৭ ও ৭ দশমিক ১ শতাংশ। সরকার আমন ও বোরোর ধান-চাল ক্রয়ের মূল্য নির্ধারণ করলেও আউশের ক্রয়মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারণ হয় না। ফলে তিন মৌসুমে উৎপাদিত ধান-চালের আনুমানিক ৯৫ শতাংশই থেকে যাচ্ছে সরকারের ক্রয় কার্যক্রমের বাইরে। আর তা থেকে যাচ্ছে খোলাবাজারে। খোলাবাজারের সিন্ডিকেটের সঙ্গে কোনো এক কারণে সরকারও পেরে উঠছে না। ফলে কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণÑ এই কথাটা ভাবতে ভালো লাগে, শুনেও গর্ব হয়। এ কথা সত্যি সরকারের বহুমুখী প্রচেষ্টায় কৃষির উত্তরণ হয়েছে। সরকার কৃষিতে নানারকম ভর্তুকি বা প্রণোদনা দিয়ে কৃষির অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করেছে। কৃষি সাফল্যে সরকারের কৃষি কৌশলের যেমন অবদান আছে, তেমনই অবদান রেখেছে গবেষকদের গবেষণাও। কিন্তু এসব কিছুর পর কৃষক যদি তার উৎপাদিত পণ্যের দাম না পায়, লাভের গুড় নিয়ে যায় মধ্যস্বত্বভোগীরা, তাহলে সব প- হবে। কৃষক আর দাঁড়াতে পারবে না। সরকারইবা আর কত ভর্তুকি দেবে! আবার কৃষকই আর কত লস দিয়ে ধানের আবাদ করবে!

 

এ সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন দুটি কারণে। প্রথমত খাদ্যের জন্য আমদানিনির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসার জন্য। দ্বিতীয়ত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন। সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে ধানসহ সব বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা যাতে মধ্যসত্বভোগীদের হাতে সাধারণ কৃষক ও জনসাধারণ জিম্মি হয়ে না পড়ে। সরকারের ধান প্রক্রিয়াটি আরও আগে থেকে শুরু হলে ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কৃষক যেন তা বিক্রি করতে পারে সে বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কারণ কৃষক সাধারণত সার, তেল, বীজ, সেচের জন্য দোকান থেকে বাকি নেয় কিংবা ঋণ নিয়ে এই ব্যয় বহন করে। তাই ধান ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ঋণ পরিশোধের জন্য অর্ধেকের বেশি ধান বিক্রি করে দিতে হয়। এ সময়টায় তার পক্ষে ধান সংরক্ষণ করে রাখার মতো সুবিধা থাকে না। অন্যদিকে মহাজন বা দোকানের ঋণ পরিশোধ না করতে পারলে পরের ফসলের প্রস্তুতিও সে নিতে পারবে না।

কৃষি শ্রমিকের সমস্যা নিরসনে যান্ত্রিক কৃষির বিকল্প নেই। মাঝারি কৃষক থেকে ক্ষুদ্র কৃষক সবাই যেন যান্ত্রিক কৃষির সুফল পেতে পারে সরকারকে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর দাম বেড়েছে এবং বাড়ছে। বেড়েছে আমাদের ক্রয়ক্ষমতাও। কৃষি ও কৃষককে টিকিয়ে রাখতে হলে আর সব পণ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষিপণ্যের দাম বাড়াতেই হবে। চালের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমরা শুধু ভাত, চিঁড়া, মুড়িতেই সীমাবদ্ধ। আর উৎসব পার্বণে পিঠাপুলি। কিন্তু চীনে দেখেছি চাল থেকে নানা খাদ্যদ্রব্য তৈরি করছে তারা। চালের তৈরি কেক, বিস্কিট দেদার বিক্রি করছে সেখানে। প্রতিবছরই আমরা বিপুল পরিমাণ গম আমদানি করি। অথচ বিকল্প হিসেবে চাল ব্যবহার করলে গম আমদানির প্রয়োজন থাকত না।

মনে রাখা প্রয়োজন, অনেক কৃষকই ধান আবাদ থেকে ইতিমধ্যে সরে গেছে। এ সংখ্যা যদি বাড়তে থাকে তবে ধান আবাদের জমির পরিমাণও কমবে। সেই সঙ্গে আমাদের মূল খাদ্যের সংকট সৃষ্টি হবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও সংকটাপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ভৌগোলিকভাবেই এ অঞ্চল ধান চাষের জন্য উপযোগী। আর ঐতিহ্যগতভাবে এ দেশের কৃষক ধান আবাদের সঙ্গে যুক্ত। ধানকে কেন্দ্রে রেখেই কৃষিকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। ভাবতে হবে আমাদের কৃষকের স্বার্থের কথা।  আমরা সবাই কৃষকের সন্তান।  কৃষিই আমাদের পরিচয়।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর