শনিবার, ২৫ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

নারী ও শিশু নির্যাতন

তপন কুমার ঘোষ

নারী ও শিশু নির্যাতন

একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা উঠে আসছে সংবাদের শিরোনামে। কোনোভাবেই যেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মে মাসের প্রথম আট দিনে সারা দেশে ৪১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছে তিনটি মেয়ে শিশু। এ হিসাব দিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’। চলতি বছরের প্রথম সাড়ে চার মাসে এক হাজার ৪৯০ শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৪৭০ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম আয়োজিত এক সেমিনারে এ তথ্য জানানো হয়। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে শিশু নির্যাতনের এ চিত্র পাওয়া যায়।

বছর দুয়েক আগের ঘটনা। টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে একটি যাত্রীবাহী বাসের চালক ও তার সহকারী কলেজছাত্রী রূপাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ রাস্তার পাশে ফেলে পালিয়ে যায়। ওই নির্মম ঘটনার স্মৃতি এখনো আমাদের মন থেকে মুছে যায়নি। ফের একই ঘটনা ঘটেছে। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের নার্স শাহিনুর আক্তার ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন।

ধর্ষণের ঘটনা বরাবরই ছিল। আগে ঘটনাগুলো প্রকাশ্যে তেমন একটা আসেনি। যৌন হেনস্তার ঘটনা চেপে রাখার প্রবণতা ছিল। এখনো অনেকে এসব ঘটনা প্রকাশ্যে আনতে চান না। মিডিয়ার কল্যাণে খবরগুলো বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়ছে। কোনো বাছবিচার নেই। গরিব ঘরের নাবালিকা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, এমনকি তিন-চার বছর বয়সী শিশুকন্যার ওপরও ‘পাশবিক’ যৌন অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছে। একটা কথা বারবার মনে হচ্ছে, পশুরা এমন ঘটনা ঘটায় কখনো? খামাকা পশুর সঙ্গে তুলনা করা হয়। সৎ বাবার দ্বারা মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে। ছি! সমাজে মানুষরূপী জানোয়ারের সংখ্যা বাড়ছে, এটা উৎকণ্ঠার বিষয়। জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞতা ও বাস্তববোধের অভাবে অপরিণত বয়সের মেয়েরা সহজেই প্রতারণার শিকার হচ্ছে। সহজ সরল মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে হোটেলকক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে। আবার ধর্ষণের ভিডিওচিত্র ধারণ করে তা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। নরপশুরা কতটা বেপরোয়া হলে এতটা স্পর্ধা দেখাতে পারে! ধর্ষণের পর ধর্ষিতাকে এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতেও পিছপা হচ্ছে না। এত নিষ্ঠুর হতে পারে মানুষ! নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন গোটা দেশ। উদ্বিগ্ন হওয়ারই কথা। দেশটা তলে তলে নারী ও শিশুদের জন্য এতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি! ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। সময়টা বদলে গেছে। বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তির আগ্রাসনে বিপন্ন হচ্ছে মানবিকতা। চলচ্চিত্রে, টিভির ধারাবাহিকে লোভ ও হিংসার কাহিনি। অবাস্তব গল্প। শেখানো হচ্ছে, কুটনামী-হিংসা-বিদ্বেষ-ষড়যন্ত্র আর পরকীয়া। মানুষের মনের গভীরে প্রেম ও হিংসার পাশাপাশি বসবাস। হিংসাকে উসকে দেওয়া হচ্ছে। ইউটিউবের মাধ্যমে যৌন বিকৃতি ছড়িয়ে পড়ছে। প্রযুক্তির বদৌলতে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরাও পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এসবের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে শুভবোধ। অবশ্য প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েই আসামিদের আটক করা সম্ভব হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। অনেকে বলেন, ধর্ষণের জন্য নারীদের অশালীন পোশাক-আশাক দায়ী। হতে পারে। কিন্তু মাদ্রাসাছাত্রীরাও তো ধর্ষণের শিকার হয়েছে। দুগ্ধপোষ্য শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন করা হয়েছে। বাকপ্রতিবন্ধীও রেহাই পাচ্ছে না। এর কী জবাব আছে? বড় জটিল প্রশ্ন। তালগোল পাকানো। আর কোনটা শালীন, আর কোনটা অশালীন সে তো বরাবরই আপেক্ষিক বিষয়। শুধু কঠোর আইন প্রণয়ন করলেই অপরাধ কমে আসবে, এ ধারণা ভুল। দেশের প্রচলিত আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আইনের বিধান যতই কঠোর হোক না কেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। পদে পদে বাধা। ধর্ষিতা আইনের আশ্রয় নিতে অনেক ক্ষেত্রে ইতস্তত করেন। কারণ সহজেই অনুমেয়। লোকলজ্জা, প্রতিহিংসা ও হয়রানির ভয়। আবার মামলা তদন্ত করতে অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাক্ষী মেলে না। মামলার আলামত নষ্ট হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে। আছে মামলাজট। এসব কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হয়। এ সত্যটা আমরা ক্রমশ উপলব্ধি করতে পারছি যে, কেবল শাস্তি দিয়ে অপরাধ দমন করা যাবে না। সার্বিক সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। হাই কোর্ট বলেছে, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে। আসলে দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টালে কিছুতেই কিছু হবে না। চেতনার জগতে পরিবর্তন আনতে হবে। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। পরিণত বয়সের মানুষ নাকি স্বভাবে খুব একটা বদলায় না। সঠিক জীবনবোধ ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার পাঠ দিতে হবে ছোটবেলা থেকেই। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। এ ব্যাপারে পিতা-মাতার ভূমিকা মুখ্য। এরপরই আসে গৃহশিক্ষক ও স্কুল শিক্ষকের ভূমিকা। সামাজিক পরিবেশের প্রভাব তো আছেই। এসব বহুচর্চিত বিষয়। কিন্তু এত চর্চার পরও কোনো সুফল মিলছে না। কোথাও একটা গলদ রয়েছে। সামাজিক দায়বোধের অভাব সর্বক্ষেত্রে। মুশকিল হলো, বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতিতে চুপ থাকাটাই আমরা শ্রেয় মনে করি। সবাই ‘শান্তিপ্রিয়’ হয়ে যাই। সম্মিলিত প্রতিবাদ চাই। প্রতিবাদ না হলে অপরাধীদের সাহস আরও বেড়ে যাবে। আজ যদি আমরা নিষ্ক্রিয় থাকি তবে আগামীতে আমাদের সন্তানদের রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসবে না। দেশের মানুষ বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার অবসান চান। অপরাধের দ্রুত বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। এদেশ নরপশুদের জন্য ‘অভয়ারণ্য’ হয়ে উঠুক, এটা কেউই  চান না।  

লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা বাংক লিমিটেড।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর