রবিবার, ২৬ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

নদী ও জলকেন্দ্রিক পর্যটন

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

নদী ও জলকেন্দ্রিক পর্যটন

নদী ও মানুষের সম্পর্ক সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই। সভ্যতার শুরু থেকেই দেখা যায় যেখানে নদী, সেখানেই মানুষ বসতি গড়ে তোলে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নদী যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, একইভাবে পর্যটন-শিল্পের উন্নয়নেও নদীর ভূমিকা অপরিসীম। পর্যটন-শিল্প সমগ্র বিশ্বের নদী ও পানির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত। নদী যেমন মানব জীবনের জন্য সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনি পর্যটন-শিল্পের উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সমগ্র ভূখ-ে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, হ্রদ, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-দিঘি আর জলাশয়। কোনো একসময় এ দেশে ১ হাজার ৩৬০টি ছোট-বড় নদ-নদী, খাল-বিল ছিল। দিনে দিনে তা কমে বর্তমানে ৫৬০টিতে পৌঁছেছে। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যুক্ত করতে খাল কেটে নদী ও সাগরের পানি শহরের ভিতর নিয়ে আসা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নদ-নদী কাজে লাগিয়ে আকর্ষণ করছে হাজার হাজার পর্যটক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় লন্ডন শহরের টেমস নদীর কথা। যেই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটা শহরের সব ধরনের কর্মকা-। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন নদীবিধৌত ভূখ- নেই। এখনো আমাদের বাংলাদেশে যে পরিমাণ নদ-নদী, খাল-বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড়, হ্রদ, পুকুর, দিঘি ইত্যাদি রয়েছে তাও কম নয়; যে কারণে এ দেশে রিভার ট্যুরিজম বা নৌপর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। রিভার ট্যুরিজম আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠতে পারে। এটা আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভিন্নমাত্রা এনে দিতে পারে। বাংলাদেশের পর্যটন-শিল্পের জন্য যা সমৃদ্ধির নতুন সোপান সৃষ্টি করবে সন্দেহ নেই। এর মাধ্যমে বিদেশি পর্যটকদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে বাংলাদেশের নদী, হাওর, বিল, ঝিল ও হ্রদকেন্দ্রিক পর্যটন স্পটগুলো। কাপ্তাই, রাঙামাটি, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ভৈরব, খুলনা, বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালীতে নৌ পর্যটন-শিল্প গড়ে তোলার যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। তবে শুধু সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এ ৭ জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত; যা পর্যটনের আরেক অপার সম্ভাবনার কথা বলে। রিভার ট্যুরিজমের একটি বিরাট সুবিধা হলো, এখানে নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশের স্বাদ গ্রহণের চমৎকার সুযোগ রয়েছে; যা অন্যান্য পর্যটন উদ্যোগে পাওয়া যায় না। আজকাল যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশ আমাদের চারপাশের পরিবেশকে দূষিত করে তুলছে, সে ক্ষেত্রে নৌ পর্যটন পর্যটকদের জন্য প্রশান্তির ছোঁয়া দিতে পারে। এর মাধ্যমে পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মীদের সঙ্গে কয়েক দিনের জন্য নির্মল প্রকৃতির আস্বাদ গ্রহণের অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হবে।

আমাদের পাশের দেশ ভারত তাদের এই নদ-নদী ও জলাশয় ভিত্তিক পর্যটনের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে। মূলত ভারতের কেরালা, কাশ্মীরে এর প্রচলন খুব বেশি দেখা যায়। সেখানে জলাশয়ের বুকে ভেসে ভেসে একজন পর্যটক প্রকৃতি ও চারপাশের মানুষের জীবন অবলোকন করতে পারে। আর তার জন্য বিশেষ ধরনের জলযান ব্যবহার করা হয় যাতে পাঁচ তারকা মানের হোটেলের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকে। পাশাপাশি পর্যটকের জন্য স্থানীয় শিল্প-সংস্কৃতি উপভোগ করার ব্যবস্থা থাকে। এতে প্রচুর বিদেশি পর্যটক প্রতি বছর কেরালা ভ্রমণ করে। আমাদের দেশেও এ রকম সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা গেলে হাওরকেন্দ্রিক পর্যটনের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে।

আমাদের নদ-নদীভিত্তিক পর্যটন নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা করা গেলে রাজধানী ঢাকাকেও পর্যটনবান্ধব ও বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলা যাবে। ৪০০ বছর আগে ঢাকাকে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন শহরের সঙ্গে তুলনা করা হতো। লন্ডন টেমস নদীর তীরে অবস্থিত আর ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। ওই সময় ঢাকা নদ-নদীবিধৌত অঞ্চল ছিল। এখন সে অবস্থা নেই আর। ঢাকার চারপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি নদ-নদী। এসব নদ-নদীকে লন্ডনেন টেমস নদীর আদলে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া ঢাকার চারপাশের কয়েকটি জেলা নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও চাঁদপুর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে রিভার ট্যুরিজমের নানা উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এতে প্রচুর পর্যটক আসবে। অতিসাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় পর্যটকবাহী নৌবিহার চালু হয়েছে; যা রিভার ট্যুরিজমের জন্য মাইলফলক। এভাবে প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের সঙ্গে নৈপথে পর্যটন বিস্তার করা যেতে পারে। বর্তমানে একটি বেসরকারি ট্যুর অপারেটর কোম্পানি নিজ উদ্যোগে বিদেশি ট্যুরিস্টদের নিয়ে বেশ কয়েকটি ট্যুর অপারেশন পরিচালনা করেছে। তবে এর ব্যাপকতা আরও বাড়াতে হবে। তবে বাংলাদেশে নদ-নদীভিত্তিক পর্যটনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নদীদূষণ ও দখল। যদিও নদী দখলমুক্ত করতে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি নদীর দূষণ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পানি, হাওর ও জলাভূমি বাংলাদেশের পর্যটন উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। সরকার যদি এ খাতের উন্নয়নে একটি জোরালো উদ্যোগ নেয় এবং কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করে তাহলে রিভার ট্যুরিজম থেকে প্রচুর উপার্জন সম্ভব। এজন্য সরকারের সঠিক পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়ন দরকার। পাশাপাশি সমাজের সব মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে নদী ও জলাভূমি রক্ষার আন্দোলনে।

লেখক : চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর