বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

জিয়ার সঙ্গে শেষ দেখা

মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন

জিয়ার সঙ্গে শেষ দেখা

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী আজ ৩০ মে। ৩০ মে এলেই শোকার্ত হই। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এভাবে ঘাতকরা একজন রাষ্ট্রনায়ককে নির্দয়, নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে। এখনো ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ কানে বাজলেই কোটি মানুষের শরীর-মন শিহরিত হয়। এখনো চট্টগ্রামে তার সঙ্গে শেষ দেখার দৃশ্য মনে পড়লেই রোমাঞ্চ লাগে। আবেগতাড়িত হই। সেদিন একজন বহুদলীয় গণতন্ত্রের রূপকারকেই হত্যা করা হয়নি, সেদিন একজন সিপাহি-জনতার ভালোবাসার নায়ককেই হত্যা করা হয়নি, সেদিন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ঐক্যের প্রতীক গ্রাম-গঞ্জ-নগর-শহরের মানুষকে উৎপাদনের রাজনীতির স্লোগান জাগিয়ে তোলার এক বংশীবাদককেই হত্যা করা হয়েছে। একটি স্বপ্নের করুণ মৃত্যু সেদিন দেশটাকে কতটা পিছিয়ে দিয়েছে তা এখন জাতি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করে। তার শাহাদাতের পর জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে শোক প্রস্তাব পাস হয়। ১৯৮১ সালের ৩ জুন তৎকালীন স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজের সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশন আরম্ভ হয়। শোক প্রস্তাবে বলা হয়, তিনি সেই শহীদ রাষ্ট্রপ্রতি জিয়া যিনি ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল নজির স্থাপন করেন। সামরিক অফিসার হয়েও গণতন্ত্রের প্রতি ছিল তার গভীর আস্থা। রাষ্ট্রপতি জিয়ার বড় কৃতিত্ব ছিল তিনি শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় মার্শাল ল থেকে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করেন। শহীদ জিয়ার শাহাদাতবরণের পর সংসদের ওই সময়কার বিরোধীদলীয় নেতা আসাদুজ্জামান খান যে বক্তব্য দেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। তিনি জিয়ার তিরোধানে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমাকে বক্তব্য রাখতে হচ্ছে। বক্তৃতার এক পর্যায়ে অকপটে বলেছিলেন-  ‘তিনি (শহীদ জিয়া) একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। জাতি সেটা স্মরণ করবে।’ একজন সামরিক কর্মকর্তা হয়েও একটি জাতির ক্রান্তিকালে কান্ডারির ভূমিকা পালন করে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। সেদিক থেকে তিনি বড়ই ভাগ্যবান।

১ জুন, ১৯৮১ সালের নিউইয়র্ক টাইমস তার মন্তব্যে লিখেছিল - The word incorruptible can only be used before the name of Zia Ur Rahman , একজন রাষ্ট্রনায়কের এর চেয়ে বেশি কী চাওয়ার আছে? তার জীবনের সবচেয়ে বেশি সফলতা হচ্ছে তিনি জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের প্রতীক হিসেবে যে দলটি (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আজকে সেটি বাংলাদেশের একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। যে দলটি বা তার নেতৃত্বের কোনো দিন মৃত্যু হবে না। কেননা তার হাতে গণতন্ত্র পর্যুদস্ত হয়নি। তাই এ দেশের দেশপ্রেমিক জনগণের বিশ্বস্ত আশ্রয়স্থল হচ্ছে বিএনপি। আর শহীদ জিয়া এ দলের প্রতিষ্ঠাতা। এদিক থেকে তিনি একজন সফল রাজনীতিবিদ ও সফল রাষ্ট্রনায়ক।

১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের সপ্তাহখানেক আগে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য চট্টগ্রামের প্রথিতযশা চিকিৎসক ডা. এ এফ এম ইউসুফ আমাকে তার চেম্বারে ডাকেন। বলেন, ২৯ তারিখ রাষ্ট্রপতি জিয়া চট্টগ্রাম আসবেন এবং বিকাল ৪টায় বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে সার্কিট হাউসে মতবিনিময় করবেন। রাষ্ট্রপতি এ সভার দায়িত্ব তাকে দিয়েছেন। কাদের দাওয়াত করা যায় তা নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে পরামর্শ করলেন। ৩০ জনের তালিকা তৈরি করে তিনি আমাকে নিয়ে তার গাড়িতেই দাওয়াত দিতে বের হলেন। ডা. ইউসুফ জানালেন, এ মতবিনিময় শেষে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চট্টগ্রামের দলীয় বিরোধ মেটাতে বিবদমান গ্রুপের নেতাদের সঙ্গে মিলিত হবেন। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি (অব.) জেলা জজ আবু আহমেদ থেকে চট্টগ্রাম ভার্সিটির ভিসি ড. আবদুল আজিজসহ বিভিন্ন মতের ৩০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের তালিকা তৈরি করা হলো। মতবিনিময় সভায় আমিই ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। শ্রদ্ধেয় ডা. ইউসুফ তার হৃদয়ের বিশালতা নিয়ে ঢাকা থেকে আগত বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়ার ডান পাশের চেয়ারে ডা. বি চৌধুরী, বাঁয়ে ডা. ইউসুফ, পেছনের সারিতে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, অধ্যাপক একরামুল হক, আমেনা বেগমসহ অন্যরা বসলেন। ডা. ইউসুফ আমাকে তার পাশের একটু পেছনের চেয়ারটিতে বসালেন। রাষ্ট্রনায়কের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকা অতিথিরা টেবিলের দুই পাশে বসলেন। উত্তর পাশের অতিথিরা বসলেন রাষ্ট্রপতির মুখোমুখি। সবার কি অপেক্ষা। এখনো মনে পড়ে, কি উত্তেজনা, কি চাঞ্চল্যই না ছিল সবার মাঝে। যদিও আগে তিনবার আমি তার মুখোমুখি হয়েছি তবু আগ্রহের প্রবল উত্তেজনায় কাটছিল সময়। ঘড়ির কাঁটার সময়মতোই রাষ্ট্রপতি প্রবেশ করলেন। ফুলস্লিভ সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট পরনে রাষ্ট্রপ্রতিকে দারুণ সুদর্শন দেখাচ্ছিল। চেহারায় উজ্জ্বলতা ছিল। শান্ত-ধীর স্নিগ্ধতায় দারুণ লাগছিল রাষ্ট্রনায়ককে। চেয়ারে বসেই বললেন, ‘আগে আমি বলব নাকি আপনারা বলবেন। আমি আপনাদের কাছ থেকেই শুনতে এসেছি।’ সুধীজনরা বললেন, ‘আপনি শোনার জন্য ডেকেছেন তাই ধন্যবাদ। আমরা বলব, তার আগে আপনার মুখে কিছু শুনব।’ রাষ্ট্রপতি শুরুতেই বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আপনারা মেধায় সমৃদ্ধ। মেধা দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করলে পরামর্শ গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করব। দেশকে উন্নয়ন-সমৃদ্ধির অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারব ইনশা আল্লাহ। তালপট্টি আমাদের হবে। কয়েকদিনের মধ্যে দেখবেন আমাদের প্রতি মুসলিম বিশ্বের অকুন্ডণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা।’ তিনি ভারতের সঙ্গে পানিসহ দ্বিপক্ষীয় সমস্যার সম্মানজনক সমাধানে পরামর্শ চান। তিনি যখন বলেন তখন পিনপতন নীরবতা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছেন শ্রোতারা। মাগরিবের আজান হওয়ায় সার্কিট হাউসের বাইরে জাতীয় পতাকা নামানো হয়। এ সময় ভিতরে সামরিক বাহিনীর বুট জুতার আওয়াজ এলে তিনি বললেন, ‘আগে ওদের পায়ে ছিল ক্যামবিসের জুতা। আমি বুট জুতা দিয়েছি।’ দেশের স্বাধীনতা-সার্ভভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী সামরিক বাহিনীকে তিনি যুগোপযোগী, অত্যাধুনিক বাহিনীতে পরিণত করতে চান বলে জানান। বলেন, ‘ওরা যেন শত্রুর মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়।’ সবাই চোখমুখে উজ্জ্বলতা এনে গভীর মনোযোগে শুনছিলেন একজন দেশপ্রেমিক গর্বিত সৈনিক ও রাষ্ট্রনায়কের মুখে তার দেশকে নিয়ে বুকভরা স্বপ্নের গল্প। এই প্রাণবন্ত মিলনমলোয় জিয়ার উজ্জীবিত করা বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অ্যাডভোকেট বদিউল আলম বলেন, ‘দাওয়াতে না এলে রাষ্ট্রপতি জিয়ার মেধা, রাষ্ট্রনায়কোচিত রূপ ও একজন জাতীয়তাবাদী নেতাকে চিনতে পারতাম না।’ চায়ের ফাঁকে রাষ্ট্রপতি সবার সঙ্গে গভীর হৃদ্যতা নিয়ে গল্প করতে লাগলেন। একসময় ডা. ইউসুফ আমাকে রাষ্ট্রপতি জিয়ার সামনে নিয়ে বললেন, ‘স্যার! এ অনুষ্ঠান সফল করতে নাছির খুব সাহায্য করেছে।’ রাষ্ট্রনায়ক জিয়া তার মিষ্টি হাসি দিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘কি জজগিরি ভালো না রাজনীতি ভালো? কোনটা উপভোগ করলেন বেশি?’ আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। উপপ্রধানমন্ত্রী জামালউদ্দিনের উপস্থিতিতে জজগিরি ছেড়ে রাজনীতিতে নামার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেটা এখনো কত উজ্জ্বল। চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে চায়ের সঙ্গে মেন্যু বাড়াতে চাইলে ডা. ইউসুফ বললেন, রাষ্ট্রপতি নারাজ হবেন। তাই শুধু নোনতা বিস্কিট রাখা। রাষ্ট্রপতি জিয়া আবার স্মিত ভুবন ভুলানো সেই হাসিটি দিলেন। কিছুই বললেন না। তখন বুঝতে পারিনি সেই ভুবন ভুলানো হাসিটি হবে জীবনের শেষ হাসি। কেউ বুঝতে পারেননি এমন অন্তরঙ্গ পরিবেশে এমন প্রাণবন্ত মিলনমেলাই হবে জীবনের শেষ মেলা। কি উজ্জ্বল চোখভরা স্বপ্ন, দেশকে নিয়ে বহুদূর যাওয়ার ভাবনা, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব সব রাতেই শেষ করে দেওয়া হবে। কেউ টেরই পায়নি। তার জীবন রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্নেল মাহফুজ সতর্কতার সঙ্গে বিছানার চাদর ঠিক করে দিয়েছিলেন। কে জানত তিনিই কয়েক ঘণ্টা পর কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করতে যাচ্ছেন। অভিশপ্ত করে দেবেন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস। যিনি সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন, দেশকে সমৃদ্ধি-উন্নয়নের দিকে নিয়ে চলেছেন সেই রাষ্ট্রনায়ককে এভাবে হত্যা করা হবে? গভীর রাতে প্রচ- ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল। সকাল ৮টায় ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে দেখি চারদিক ফাঁকা, নির্জন। ডিসি হিলের উত্তরে মোমিন রোডের বাসায় থাকতাম। নিচ থেকে দু-একজন এসে বলল, ‘স্যার! রাতে সার্কিট হাউসে অনেক গোলাগুলি হয়েছে। শুনেছি রাষ্ট্রপতি জিয়াকে হত্যা করা হয়েছে।’ আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম। বুকটা ধক করে উঠল। তারা আরও বলল, ‘সামরিক বাহিনী চট্টগ্রামের দায়িত্ব নিয়েছে। জেনারেল মঞ্জুর জিয়াকে হত্যা করেছে।’ আমার চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করল। কিন্তু যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। শরীর কাঁপছে। আমার স্ত্রী ডালিয়াও অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছেন। ফোন করলাম আমাদের আপনজন জাগদলের প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির বর্ষীয়ান নেতা অ্যাডভোকেট এ কে এম শামসুল হককে। কাঁপা গলায় তিনি বার লাইব্রেরিতে যেতে বললেন। সেখানে গিয়ে দেখি দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু সালেহ চৌধুরীকে কান্নায় ভেঙে পড়তে। আইনজীবী সমিতির সভাপতি এলেন। বললাম, দেখুন, কালই দেখা করলেন, আর রাতেই ঘাতকরা রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করল! তিনি  তড়িঘড়ি চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বললেন, কাল যে তিনি রাষ্ট্রপতির মতবিনিময় সভায় গিয়েছিলেন সেটা যেন কাউকে না বলি। বোকার মতো তাকালাম। তবে সাবেক সভাপতি আবু আহমেদ মানিক শুনে ব্যথিত হলেন। বললেন, ‘জাতির এক শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ককে হত্যা করে ওরা অপূরণীয় ক্ষতি করল।’ অ্যাডভোকেট হুদা ভাইয়ের প্রস্তাবে আবু সালেহ চৌধুরী, ব্যারিস্টার মিল্কি ও শফিকুন্ডর রহমানকে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে গেলাম আমাদের নেতার লাশ গ্রহণ করতে। তখন সকাল প্রায় সাড়ে ১০টা হবে। কোর্ট এলাকা ফাঁকা। ৩০ মিনিট অপেক্ষা করেও জেলা প্রশাসক এম জিয়াউদ্দিনের সাক্ষাৎ পেলাম না। রাতের বীভৎস হত্যাকান্ডের ঘটনায় নগর তখন মৃত। নীরব-নিথর, জনমানবশূন্য।

আমরা কোর্টবিল্ডিংয়ের পাহাড় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে যখন এলাম তখন হুদা ভাই হঠাৎ আমাদের থামতে বললেন এবং আবার জেলা প্রশাসকের কাছে গিয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার লাশ দাবি করার জন্য মত প্রকাশ করলেন। আমি তার লাশ গ্রহণের প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে বললাম, সবাই চলুন। বলেই আবার আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে থেকে হেঁটে কোর্টবিল্ডিং পাহাড়ে জেলা প্রশাসকের দফতরের সামনে হাজির হলাম। এরই মধ্যে আমরা এক অনাকাক্সিক্ষত আতঙ্কে ভুগছিলাম সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের কয়েকটি গাড়ি কোর্টবিল্ডিংয়ের সামনে জড়ো হওয়া দেখে। এবারও আগের মতো আমাদের নাম লিখে সাক্ষাৎপ্রাপ্তির জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে স্লিপ পাঠালাম। সঙ্গে সঙ্গে জেলা প্রশাসক এম জিয়াউদ্দিন সাহেব আমাদের সবাইকে ডাকলেন। আমরা তার অফিস চেম্বারে ঢুকেই চেয়ারে বসার আগেই হুদা ভাই জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার লাশ কোথায়, কীভাবে আছে, কোন কর্তৃপক্ষের কাছে আছে জানতে চাইলেন এবং এও বললেন, ‘আমরা সবাই এসেছি আমাদের প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়ার লাশ গ্রহণ করতে।’ এই বলে আমরা সবাই জেলা প্রশাসকের কাছে আমাদের বাসার ঠিকানা ও ফোন নম্বর একটি সাদা কাগজে লিখে তার সামনে দিলাম। সারাক্ষণ জেলা প্রশাসক মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটিবারও মাথা উঁচু করে আমাদের মুখোমুখি হলেন না। বললেন, ‘আপনারা কি আমার অবস্থা বুঝতে পারছেন না। লাশ আমার দায়িত্বে হস্তান্তর হলে আমি নিশ্চয়ই আপনাদের জানাব। আপনারা দ্রুত চলে যান।’ আমরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে যার যার বাসার দিকে চলে যাচ্ছিলাম। হুদা ভাই তার স্নেহভরা কণ্ঠে আমাকে বললেন, ‘নাছির! আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব। একা ছেড়ে দিতে পারি না, কারণ আমার বোন ডালিয়া তোমার কিছু হলে আমাকে দায়ী করবে।’ তিনি আমাকে মোমিন রোডের বাসায় পৌঁছে দিয়ে হেঁটে তার চন্দনপুরা বাসভবন ‘রিটাকোটে’ চলে গেলেন। আমি বাসায় গিয়ে ডালিয়াকে অত্যন্ত আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় দেখি। শুনি আমার ঘরের টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ কারণে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এরই মধ্যে আমার এক রাজনৈতিক সহকর্মী এসে আমাকে বাসা ছেড়ে আত্মগোপনে যেতে বললে, বাসা থেকে নেমে কোথায় যাব ভাবছি। দেখি সন্ধ্যা নেমে আসতেই গোটা চট্টগ্রাম ভুতুড়ে নগরে পরিণত হয়েছে। ডালিয়াকে পাঠিয়ে দিলাম শ্বশুরের বাসায়। আমি হেঁটে রওনা দিলাম হুদা ভাইয়ের বাসার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়ার সঙ্গে আমার দুর্লভ স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলে পিতৃহারা শিশুর মতো কান্না এলো।

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও ভাইস চেয়ারম্যান জাতীয়তাবাদী দলÑবিএনপি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর