শুক্রবার, ৩১ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

খানদানি রাজনীতির অধোগতি : নক্ষত্রচূর্ণ থেকে কাষ্ঠচূর্ণ

এম জে আকবর

খানদানি রাজনীতির অধোগতি : নক্ষত্রচূর্ণ থেকে কাষ্ঠচূর্ণ

কোনো বিষয়ে জয়-পরাজয় ঘটার পেছনে কাজ করে যেসব কারণ, ভারতের সাধারণ নির্বাচনের বেলায়ও সেসব ছিল। তবে ব্যাখ্যা করতে গেলে ছোট্ট ঘটনাগুলো নাড়াচাড়া করলে ধেয়ে আসা বড় বড় ঘটনা মনোযোগ কাড়বে।

রাহুল গান্ধীর ক্ষেত্রে চোখ-মারার একটি ঘটনা শেষতক তার নির্বাচনী বিপর্যয় বয়ে এনেছে। তিনি গত বছর লোকসভায় তীব্র-তীক্ষ্ন হুল-ফোটানো ভাষায় অবিশ্বাস্য এক বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর আক্রমণ চালান। বিদেশি পরামর্শকদের বুদ্ধিতে এবং রাজনৈতিকভাবে মুখ অথচ সামাজিকভাবে সর্বগ্রাসী অভিজাত, এমন একটি মহলের প্রভাবে তিনি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনাকাটায় দুর্নীতির জন্য মোদিকে দোষারোপ করলেন সামান্যতম প্রমাণ ছাড়াই। ওই বক্তৃতায় রাহুল উচ্চ নৈতিকতা ধারণের ওপর জ্ঞানদান করে বলেন, তিনি প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোলাকুলি করতেই চেয়েছিলেন। বক্তৃতা শেষে আসন গ্রহণের সময় তিনি গ্যালারিতে থাকা তার অনুরাগীদের (যারা বক্তৃতার সময় হর্ষধ্বনি দিয়েছেন) দিকে তাকিয়ে চোখ মারলেন। দৃশ্যটা ক্যামেরাবন্দী হয়ে গিয়েছিল। এতে করে যে ভাবচ্ছবি ধরা পড়ল তা হচ্ছে- সস্তা নাটুকেপনা, অপরিপক্বতা, হামবড়া চাতুরী ও বালকসুলভ চাপল্য। এই ভাবচ্ছবি বলতে থাকেÑ ‘রাহুল গান্ধী রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার যোগ্য নন’- চলমান রটনা তাহলে মিথ্যা নয়!

২৩ মে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর অবশ্য রাহুল গান্ধী কাউকে চোখ মারতে দেখা গেল না। কিছু কিছু ব্যাপার নিজেই নিজের জানান দেয়। রাহুল একটি আসনেও কংগ্রেস প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে পারেননি। তবে দলীয় নেতাদের একটি প্রজন্মকে অপমানিত করার ব্যাপারটি তিনি নিশ্চিত করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখ্য হলেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া; ইনি হেরেছেন তার পারিবারিক ভিত্তিস্থান গুনা নামক আসন এলাকায়। গঙ্গোত্রী থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগর উপকূলের সাগরমাতা পর্যন্ত এলাকায় কংগ্রেস ১০টিরও কম আসন পেয়েছে। মহারাষ্ট্র ও উড়িষ্যার মধ্যবর্তী এলাকায় ১০টিরও কম আসন পায় কংগ্রেস। এর মাঝে ছয় মাস আগে যে ৩টি রাজ্যে সরকার গঠন করেছিল কংগ্রেস সেসব রাজ্যেও দলের বিশ্বাসযোগ্যতা শেষ করে দিয়েছেন রাহুল। এটাই যেন যথেষ্ট হলো না। তার ধ্বংসাত্মক নেতৃত্ব কর্ণাটকে জোট সরকারকেও খতম করেছে। ভালো ফল বলতে কংগ্রেস যা করল তা শুধু পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু আর কেরালায়।

যেসব আসন এলাকায় কংগ্রেস তালেবর, সেখানে কী দেখা গেল? বেশি দৃষ্টান্ত বাদ দিয়ে ৫টি আসনে তাকানো চলে। ১টি বিহারের কাটিহার, বাকি ৪টি পশ্চিমবঙ্গের মালদা উত্তর, মালদা দক্ষিণ, জঙ্গিপুর ও বর্ধমান। সব আসন এলাকাতেই মুসলিম ভোটারের প্রাধান্য। সব কটিতেই কংগ্রেস হেরেছে। জঙ্গিপুরে ৭৫ শতাংশ ভোটার মুসলমান, এখানে প্রার্থী করা হয়েছিল সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ছেলে অভিজিৎ মুখার্জিকে, তবু কাজ হয়নি। জিতেছে তৃণমূল। বিজেপির মাহফুজা খানম হয়েছেন দ্বিতীয়। মাহফুজা মুসলমানদের ভোট পাননি বলা যাবে?

বর্ধমানে জিতেছেন বিজেপির অদম্য প্রার্থী এস এস আহলুওয়ালিয়া। তিনি দার্জিলিং থেকে দক্ষিণে সরে এসে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। বর্ধমান ছিল কমিউনিস্টদের দুর্গ, তাই এ আসন এলাকাকে বলা হতো স্টালিনগ্রাদ। আসনটি কব্জা করে নিয়েছিল তৃণমূল। সেই থেকে এটা মমতার দুর্গ। বিরুদ্ধপক্ষের দৃষ্টিতে আহলুওয়ালিয়া ছিলেন ফালতু প্রার্থী। তিনি যে তা নন সেটা সবাই দেখল।

মালদার ২টি আসনই ‘অজেয়’ ক্যাটাগরিতে ছিল এত দিন। কারণ এখানে কংগ্রেস নেতা গনি খান চৌধুরী পরিবারের আধিপত্য। ২টি আসনই এবার জিতে নিয়েছে বিজেপি। কাটিহারে কংগ্রেস প্রার্থী ছিলেন তারিক আনোয়ার। ২০১৪ সালে মোদিঝড়ের মধ্যেও শারদ পাওয়ারের দলীয় প্রার্থী হয়ে জিতেছিলেন তিনি। এবারের বিজয়টা আরও গৌরবময় করার আশায় কংগ্রেসে যোগ দিলেন তিনি। ভুল সিদ্ধান্তের ফলও পেয়ে গেলেন।

যে কোনো নির্বাচনে ধাক্কা ও টানা-  এ দুটি বিষয় তাৎপর্যবাহী। গদিতে আসীন দল বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে ছোট ছোট বা বড় বড় ক্ষোভ ধীরে ধীরে জড় হয়ে ভোটারদের ধাক্কা দেয়। এটা আরও বাড়তে থাকে টানতে সক্ষম বিকল্পের কারণে, যেমনটা টেনেছেন নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে। কিন্তু এবার ঘটল উল্টো। গদিতে বসা মোদি টানলেন আর ধাক্কা দিলেন রাহুল।

মোদি যে জিতবেন তার আলামত নানাভাবে পাওয়া যাচ্ছিল। এখানে দুটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। বাঙ্গালোর নগরী, যেখানে কংগ্রেস ক্ষমতায়, দেখা গেছে রাহুলের মোটর শোভাযাত্রা ছুটে যাচ্ছে আর কিছু লোক আওয়াজ দিচ্ছে ‘মোদি মোদি মোদি।’ মোদির কোনো র‌্যালিতেই ‘রাহুল রাহুল রাহুল’ আওয়াজ শোনা গেল না। দলের কৌশল নির্ধারকরা রাহুলের নেতিবাচক দিকটা বিবেচনায় নিয়ে প্রিয়াংকা গান্ধীকে প্রচারাভিযানে নামিয়ে দেন। আমোদজনক ব্যাপার! তিনি নরেন্দ্র মোদির পাল্টা ব্যক্তিত্ব হতে পারলেন না। কংগ্রেসের ক্রমহ্রাসমান অনুগামীদের কাছে প্রিয়াংকা হয়ে উঠলেন রাহুলের বিকল্প।

মহারাষ্ট্রের মেজাজটা ধরা পড়েছিল ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’য় এপ্রিলে প্রকাশিত একটি ছবিতে। নন্দুরবর নামের প্রত্যন্ত জেলায় আট বছর বয়সী প্রিয়াংশু মছলে মুখে কৃত্রিম দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে নরেন্দ্র মোদি সেজেছে। মাথায় পাগড়িও রয়েছে। তাকে ঘিরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে গ্রামীণ নারীরা। কেউ কেউ আঙ্গুলে দেখায় বিজয় চিহ্ন। মোদির প্রতি এই সমর্থন ছিল হৃদয়-ছোঁয়া। রাহুল গান্ধী সেজে কেউ ও রকম ভঙ্গি করেছে, মনে পড়ে না।

আরেকটা আলামতের কথাও বলতে হয়। কংগ্রেসের তুখোড় প্রার্থী সুশীল সিন্ধে তার প্রচারাভিযান তেজস্বী করার জন্য মিছিল-সমাবেশে থাকতে রাহুল গান্ধী বা প্রিয়াংকা গান্ধীকে মিনতি জানাননি। সুশীল সিন্ধে তার সঙ্গে থাকার জন্য জরুরি বার্তা পাঠালেন যার কাছে তার নাম রাজ থ্যাকারেÑ উদীয়মান শিবসেনা নেতা। কংগ্রেস নেতারা জানেন, যে খানদান একটা রাজনীতিতে নক্ষত্রচূর্ণ ছিটিয়ে দিত, দিনে দিনে তার ধার কমতে কমতে সে এখন যা ছিটায় তা হচ্ছে করাতকলের কাঠের গুঁড়ো।

এবারের লোকসভা নির্বাচনে বাই-প্রডাক্ট খানদানি রাজনীতির অধোগতি। নরেন্দ্র মোদি খানদানের ধারণাকে জোঁকের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যে জোঁক দুর্ভাগাদের দাবিয়ে নিজের শোষণকর্মে মগ্ন থাকে। তিনি অন্যকে যা চর্চা করতে বলেন, নিজেও তাই চর্চা করেন। মোদির কোনো উদ্যোগ বা প্রকল্পে স্বতঃসিদ্ধ উত্তরাধিকার বলে কিছু নেই। ভোটাররা এটা উপলব্ধি করেছেন। সেজন্য ২৩ মে দুপুর থেকে আসতে থাকেÑ

‘অশোক জেহলতের পুত্র হেরে যাচ্ছেন। রাজীব গান্ধীর পুত্র হেরে যাচ্ছেন। তরুণ গগৈর পুত্র হেরে যাচ্ছেন। হারছেন অজিত পাওয়ারের পুত্র। হারছেন মুরলী দেওয়ার পুত্র। এইচ ভি কুমার স্বামীর পুত্র ও পিতা হেরে যাচ্ছেন। শুধু একজন পুত্রই জিতছেন তিনি ভূমিপুত্র।’

খবরটা যখন শুনছিলাম ঠিক তখনই দারুণ এক জোক শুনতে পেলাম- ‘রাহুল গান্ধী আগামীকাল রাহুল গান্ধীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। রাহুল পদত্যাগপত্রটি প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে বলবেন, রাহুল যে সমস্যা তৈরি করেছেন রাহুলের পদত্যাগে তার সমাধান নেই। রাহুল তখন কংগ্রেসকে চালানোর জন্য রাহুলকে অনুরোধ জানাবেন এবং সেই অনুরোধ রাহুল গ্রহণ করবেন এবং রাহুলের ওপর আবারও আস্থা স্থাপন করায় রাহুল গান্ধীকে ধন্যবাদ জানাবেন।’

ত্রুটি-বিচ্যুতির পরিণতিতে কংগ্রেস এখন ‘কেরালা প্লাস তামিলনাড়ু পার্টি’ হয়ে পড়েছে। এ দুটি রাজ্যে কংগ্রেস আসন পেয়েছে জোটবদ্ধ হওয়ার কারণে। রাহুল যে ওয়েনাড় আসনে জিতলেন তার কৃতিত্ব মুসলিম লীগের। এ এক করুণ দশা বটে। কংগ্রেসের দীর্ঘকালের ইতিহাসে এবারই প্রথম তার সভাপতি ভোটভিক্ষা করল মুসলিম লীগের দরবারে।

পারিবারিক-আধিপত্যে-জর্জর দলগুলোর অনেকেই এবারের নির্বাচনের ধকলে ন্যুব্জ হয়ে গেছে। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে মমতা ব্যানার্জির দম্ভ। নির্বাচনী প্রচারণায় তার হম্বিতম্বির প্রাবল্য কেন, তা পরিষ্কার করে দিয়েছে ভোটের ফল। এভাবে হুঙ্কার-গর্জন-আস্ফালন যদি চলতে থাকে তাহলে ২০২১ সালে অনুষ্ঠেয় বিধানসভা নির্বাচনে মমতা পরাস্ত হবেন। লোকসভায় তৃণমূলের আসনসংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে একটা গুঞ্জন বাড়ছে। তা হলো- ‘উনিশে হাফ/একুশে সাফ।’

মোদি যে জিতবেন তা স্পষ্ট হয়ে যায় ইংরেজি সাময়িকী ‘ইকোনমিস্ট’-এর কাজকারবারে। পত্রিকাটি মোদির বিরুদ্ধে একপেশে আক্রমণাত্মক ও অতিরঞ্জিত কাহিনি ছাপে। একসময়ের অভিজাত এ পত্রিকাটি নির্বাচনবিষয়ক ভবিষ্যদ্বাণী খুব কমই যথার্থ করতে পেরেছে। বধিরসদৃশ কান আর প্রভুর দৃষ্টিতে দর্শনে সক্ষম এক ব্যক্তিকে তারা তাদের দিল্লি প্রতিনিধি বানিয়েছে। ‘ইকোনমিস্ট’ যেদিন লিখল- ‘মোদির পরাজয় আসন্ন’ সেদিনই সবাই নিশ্চিত হন যে, মোদি জয়ী হচ্ছেন।

লোকসভা নির্বাচনের সূচনাকালে আমি লিখেছিলাম, রাজনৈতিক পরিম-লে একটা ‘ঢেউ’ পাকিয়ে উঠছে। ঢেউয়ের মৌলিক বৈশিষ্ট্য কী, তা কেউই পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেনি। তটে এসে না-লাগা পর্যন্ত ঢেউ কখনো দেখাও যায় না। সুনামি এগিয়ে আসছে এটা যারা মানল না, শুধু তারাই সুনামিতে তলিয়ে গেল।

লেখক : প্রখ্যাত কলামিস্ট, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর