শিরোনাম
শুক্রবার, ৩১ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গারা যেন না হয় চিরকালের শরণার্থী

শিমুল মাহমুদ

রোহিঙ্গারা যেন না হয় চিরকালের শরণার্থী

আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঝেমধ্যেই তাঁর বক্তৃতায় কবি সুকান্তের একটি কবিতার লাইন উচ্চারণ করেন, ‘যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ আগামী প্রজন্মের কাছে একটি বাসযোগ্য বিশ্ব রেখে যাওয়া আমাদের সবারই দায়িত্ব। আমরা সবাই চাই আমাদের চেনা পরিপার্শ্ব যেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আরও বেশি বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের প্রায় ৬ লাখ মানুষ তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাচ্ছেন? মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত প্রায় ১১ লাখ মানুষ তাদের নিজের বসতি এলাকায় ঠাঁই নেওয়ায় স্থানীয়দের জীবনযাত্রা, সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। স্থানীয় শ্রমজীবীদের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে গেছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের কারণে রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রেও তাদের নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। পাহাড়ধস, গাছপালা কেটে ফেলার ফলে এ এলাকায় তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। বহুমাত্রিক সামাজিক সমস্যা মোকাবিলা করছেন স্থানীয়রা।

এদিকে এরই মধ্যে রোহিঙ্গারা আমাদের মূল জনস্রোতে মিশে যেতে শুরু করেছে। কক্সবাজার ছাড়িয়ে তারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায়ও ঠাঁই নিয়েছে। ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। এমনকি দালাল ধরে জাল কাগজপত্রের ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছে। বিমানবন্দরে মাঝেমধ্যেই ধরা পড়ছে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ গত দেড় বছরে প্রায় ২৯ হাজার রোহিঙ্গাকে আটক করে তাদের ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে।

রোহিঙ্গারা যেন ক্যাম্পের বাইরে না যেতে পারে সেজন্য সড়কে নিয়মিত পুলিশ ও সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট রয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো প্রায় সবই অরক্ষিত। সেগুলোর চারপাশে কোনো বেষ্টনী নেই। তাই প্রধান সড়ক এড়িয়ে তারা সহজেই অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ছে। এজন্য ৩১টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সবকটিরই চারপাশে সুরক্ষিত দেয়াল নির্মাণ জরুরি। এক এলাকায় এত বিপুলসংখ্যক জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক থাকার কারণে এলাকার সামাজিক পরিবেশ বিপন্ন হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় খুন-খারাবি এখন নিত্যদিনের ঘটনা। নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে এ পর্যন্ত তাদের প্রায় ৪০ জন খুন হয়েছেন। স্থানীয় বেশ কয়েকজনও তাদের হাতে খুন হয়েছেন। মাদক ব্যবসার কারণে কয়েকজন রোহিঙ্গা ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন। এমনকি অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছেন তাদের কেউ কেউ।

সূত্র জানান, রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মহার অনেক বেশি। তাদের প্রতিটি পরিবারে ন্যূনতম পাঁচ-ছয় জন করে সদস্য। কোনো কোনো পরিবারে ১০-১১ জন করে সদস্য। জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে তাদের চরম অনীহা। কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা চলছে। তবে বিষয়টি এখনো ফলপ্রসূ হচ্ছে না। অন্যদিকে গত দেড় বছরে প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয়। এখনো গর্ভবতী আছেন কয়েক হাজার নারী। এসব শিশুর জাতীয় পরিচয় কী হবে তা অমীমাংসিত প্রশ্ন। এসব সংকট ও চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে দেশহীন, ঘরহীন মানুষের ওপর ছায়া হয়ে কাজ করছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তাদের সুশৃঙ্খলভাবে রাখতে ১০ পদাতিক ডিভিশনের সদস্যরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

এমন পরিস্থিতিতে পর্যটননগর কক্সবাজারের ওপর জনঘনত্বের চাপ কমাতে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। নোয়াখালীর ভাসানচরে ২৩ হাজার পরিবারের প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা স্থানান্তর নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই আলোচনা চলছে। স্বার্থান্বেষী কিছু বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) তৎপরতায় রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করা যায়নি। ইতিমধ্যে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। সেখানে হাটবাজার, চিকিৎসা কেন্দ্রসহ অন্যান্য সুবিধা তৈরি করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে শতাধিক সাইক্লোন শেল্টার। সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, শিগগিরই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করা হবে। তবে কিছু এনজিওসহ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশন (ইউএনএইচসিআর) নিরাপত্তা-ঝুঁকির ‘অজুহাত’ তুলে এর বিরোধিতা করছে। অবশ্য সম্প্রতি ইউএনএইচসিআর বলছে, স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গারা সেখানে যেতে চাইলে স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় আপত্তি থাকবে না জাতিসংঘের। রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করে ইউএনএইচসিআরের সুরক্ষাবিষয়ক সহকারী হাইকমিশনার ভলকার টাক বলেন, ‘কক্সবাজারের শিবিরে এখন গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। সে কারণে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পুনর্বাসনে বাংলাদেশের নেওয়া সিদ্ধান্তকে ইউএনএইচসিআর স্বাগত জানায়। তবে যে কোনো পুনর্বাসনপ্রক্রিয়া স্বেচ্ছায় হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।’

গত বছর ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের ফসল ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের অমানবিক জীবনযাত্রা দেখে এসেছি লেবানন সফরকালে। ইসরাইল-ফিলিস্তিনি যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনের প্রায় ৫২ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পাশের দেশগুলোয় শরণার্থী জীবন যাপন করছে। তাদের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শরণার্থী হয়ে আছে জর্ডানে, প্রায় ২০ লাখ। ফিলিস্তিনের কাছের বন্ধু লেবাননে আছে ৫ লাখ শরণার্থী। ১৯৪৮ ও ’৬৭ সালের দুটি বড় ধরনের অভিযানে ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই প্রতিবেশী দেশগুলোর শরণার্থী। লেবানিজদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, গত ৫০ বছরেও ফিলিস্তিনিরা নিজেদের জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারেনি। লেবাননে ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা অমানবিক জীবন যাপন করছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা অধিকারহীন জীবন কাটাচ্ছে পাশের দেশগুলোয়। তারা যেন হয়ে উঠছে চিরকালের শরণার্থী। বাংলাদেশ মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’ হিসেবে স্বীকার করে না। বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। সর্বশেষ সবচেয়ে বড় বিতাড়নের সময় পুরো বাংলাদেশ তাদের জন্য মমতার ডালা সাজিয়ে বসেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি বড় অংশ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ায় কক্সবাজারের স্থানীয়রা তাদের আর ভালো চোখে দেখছে না। স্থানীয়রাই এখন চরমভাবে কোণঠাসা। বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গাদের যত দ্রুত সম্ভব তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে।

বাংলাদেশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কোথায় রাখবে এটা একান্তই সরকারের ব্যাপার। এনজিও কিংবা জাতিসংঘের এ ব্যাপারে নাক গলানোর কিছু নেই। তারা শুধু দেখতে পারে, রোহিঙ্গাদের অমানবিক পরিবেশে রাখা হচ্ছে কিনা। বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে সেটাই সবচেয়ে বড় মানবিক দৃষ্টান্ত। প্রচারণা চলছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর করা হলে মিয়ানমার তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আগ্রহ দেখাবে না। অভিযোগ উঠেছে, একশ্রেণির এনজিও স্থানান্তর প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোকে অশান্ত করতে ইন্ধন জোগাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে তাদের দ্বীপান্তর করা হচ্ছে। ফলে কক্সবাজারের ক্যাম্প ছাড়তে চাচ্ছে না রোহিঙ্গারা।

বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চান না দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা। একজন কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গাদের খাবারসহ সব ধরনের খরচের জোগান দিচ্ছে ইউএনএইচসিআরসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থা। রোহিঙ্গাদের কারণে এনজিওদের এখন পোয়াবারো অবস্থা। রোহিঙ্গাদের একাংশকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হলে দেশি-বিদেশি এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দফতরগুলোও সেখানে নিতে হবে। কর্মকর্তাদের থাকতে হবে ওই চরে। তাদের ছাড়তে হবে কক্সবাজারের বিলাসবহুল তারকা সুবিধার হোটেল-মোটেল। ঢাকা ও চট্টগ্রামের হুটহাট বিমানযাত্রাও বন্ধ হয়ে যাবে। মূলত এসব কারণেই বিদেশি এনজিওরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থানান্তরের বিরোধিতা করছে।

আমরা মনে করি, মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ভাসানচরসহ নিয়ন্ত্রিত জায়গায় রাখতে হবে। তারা যেন দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে সারা দেশে কিংবা বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে। ৩১টি রোহিঙ্গা শিবিরের সবকটির চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। সবচেয়ে বড় বিষয়, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে বিশ্বজনমত জোরদার করতে হবে। আমরা চাই রোহিঙ্গারা নিজেদের বাসভূমে নিরাপদে ফিরে যাক, সেটা যত দ্রুত সম্ভব। রোহিঙ্গারা যেন আমাদের এই প্রিয় ভূখন্ডে চিরদিনের ‘শরণার্থী’ না হয়ে পড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে। ১৮ কোটি মানুষের এই সীমিত ভূখন্ডে আমরা সভ্যতার আলোবর্জিত, অশিক্ষিত ও কলহপ্রবণ রোহিঙ্গাদের চিরদিনের শরণার্থী হিসেবে দেখতে চাই না।

লেখক : সাংবাদিক।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর