শুক্রবার, ৩১ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লবী পরিবর্তন দরকার

অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন

পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে অনেক আগে থেকেই পিপলস সেন্টারড হেলথ কেয়ার বা জনগণকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যসেবার প্রচলন শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা যা কিছুই করি না কেন, সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু আসলে মানুষই। জনগণের সেবার প্রয়োজনেই ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক্স, হাসপাতাল, ওষুধ, যন্ত্রপাতি, পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ এত আয়োজন। অথচ পুরো ব্যাপারটাকে আমরা সেভাবে দেখছি না। কোনো এক অদ্ভুত কারণে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও চিকিৎসক সমার্থক হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য খাতের যা কিছু সীমাবদ্ধতা, সবকিছুর দায় যেন চিকিৎসকের। সরকারি হাসপাতালগুলোয় তীব্র লোকবল সংকট। ১০ জন চিকিৎসকের কাজ চারজন দিয়ে চলছে। ডাক্তারের তুলনায় যেখানে নার্সের সংখ্যা অন্তত তিন গুণ হওয়া উচিত সেখানে নার্সের সংখ্যা চিকিৎসকের তুলনায় কম। অধিকাংশ উপজেলা হাসপাতালে অপারেশনসহ অন্য চিকিৎসা দেওয়ার অবকাঠামো অপ্রতুল। প্রয়োজনের তুলনায় ওষুধের সরবরাহ নেই। সঙ্গে অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতি তো আছেই। ফলে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। আর মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আছে হাসপাতালে স্থানীয় দুর্বৃত্তদের তা-ব। এদের হাতে প্রায়শই চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা নিগৃহীত হচ্ছেন, ফলে চিকিৎসকরাও  ভীষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বর্তমানে সমগ্র স্বাস্থ্য খাতে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে। একদিকে খাতজুড়ে তীব্র ব্যবস্থাপনা সংকট, অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা। স্বাস্থ্য খাতকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় নিয়ে একে যদি কয়েকটি ভাগে ভাগ করি, যেমন সরকারি খাত, বেসরকারি খাত, মেডিকেল শিক্ষা, সুশাসন, তারপর প্রতিটি খাতে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে আমরা সমাধানের পথ খুঁজি, তাহলে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে একটা বিপ্লবী পরিবর্তন আনা সম্ভব। আমরা স্বাস্থ্য খাতের সরকারি অংশটুকু নিয়ে তাও কিছু আলোচনা করি, কিন্তু বেসরকারি খাতটা একেবারেই উপেক্ষিত। বাংলাদেশে একজন গার্মেন্ট শ্রমিকেরও যেখানে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত আছে, সেখানে অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে মালিকপক্ষ একজন চিকিৎসককে নামমাত্র বেতন দিচ্ছেন। যে যেখানে পারছেন চিকিৎসকদের ঠকাচ্ছেন। আমাদের এ সমস্যাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে উঠে আসছে ঠিকই, কিন্তু আমরা পদ্ধতিগতভাবে সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি না। অথচ আমাদের যারা নীতিনির্ধারক ও পেশাজীবী নেতা আছেন, এগুলো তো তাদেরই কাজ। াংলার মানুষের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ চাই, সরকারি হাসপাতালসমূহে চিকিৎসকসহ জনবল বৃদ্ধি করতে হবে, সরকারি হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা বাড়াতে হবে, প্রতিটি জেলায় প্রধান সরকারি হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিউ, ১০ শয্যার সিসিইউ ও ১০ শয্যার ডায়ালাইসিস সেন্টার থাকতে হবে, স্বাস্থ্য খাতে ব্যবস্থাপনা সংকট নিরসনসহ সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতকে সুনির্দিষ্ট নিয়মের আওতায় আনতে হবে, মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনার নামে লুটপাট বন্ধ করতে হবে, মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করতে হবে এবং কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের দেশের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থাও অসম্পূর্ণ ও অনাধুনিক। যুগোপযোগী, রোগীবান্ধব চিকিৎসক আমরা তৈরি করছি না। ফলে বাস্তব ক্ষেত্রে জটিলতা আরও বাড়ছে। একজন চিকিৎসককে অসুখ-বিসুখের বাইরেও দেশের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে হবে, রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং তাদের প্রত্যাশাকে মূল্যায়ন করতে হবে। এ বিষয়গুলো এমনি এমনি হয় না, এমবিবিএস অধ্যয়নকালীন মেডিকেল ছাত্রছাত্রীদের শেখাতে হবে। দেশের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার আজ সময়ের দাবি। তবে এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি অংশ আছে। তার প্রথমটাই হলো নেতৃত্ব ও সুশাসন। অনুকূল নীতি ও নেতৃত্ব ছাড়া কোনো দেশে সফল স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। একজন নেতা আর ব্যবস্থাপকের মধ্যে তফাত হলো নেতাকে দূরদর্শী হতে হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে একটা আমূল পরিবর্তন আনার মতো একজন বোদ্ধা নেতা আমরা কখনো পাইনি। বাংলাদেশের মানুষের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সুযোগ পেলেই নানান দিকনির্দেশনামূলক কথা বলেন, অথচ তা বাস্তবায়ন করার মতো নেতৃত্বের আজ বড় অভাব। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবাই-  একদিকে সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে চিকিৎসক-নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মী।

লেখক : চেয়ারম্যান, ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেইফটি অ্যান্ড রাইটস (এফডিএসআর)।

সর্বশেষ খবর