রবিবার, ২ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ধানের দরপতনের দায়

শাইখ সিরাজ

ধানের দরপতনের দায়

থমাস মুরের ‘ইউটোপিয়া’, সেই যে কল্পরাজ্য, যেখানে নাগরিকরা সুখী ও সন্তুষ্ট। সে রাজ্যের নাগরিকদের প্রত্যেকেই বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় কৃষিকাজে অংশ নেয়। সে রাজ্যে যে যে পেশাতেই থাকুক না কেন ফসল বোনার সময় নয় তো ফসল কাটার সময় গ্রামে গিয়ে কৃষিকাজে অংশ নেওয়ার নিয়ম। আর যদি কেউ শুধু কৃষিকাজই করতে চায় তবে সে সম্মানের সঙ্গেই কৃষির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে সারা জীবন। কয়েকদিন ধরে আমার ইউটোপিয়ার কথাই মনে হচ্ছিল। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় পাকা ধানে আগুন দেওয়া কৃষক আবদুল মালেক সিকদারের ধান কেটে দিয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সিরাজগঞ্জে শ্রমিক সংকট ও ধানের দরপতনে লোকসানের মুখে পড়া হতাশ চাষির খেতের ধান কেটে দিয়েছেন অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তারা। ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলায় চাষির ধান কেটে ঘরে তোলার কাজে সহযোগিতা করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গ্রামীণ মানবিক উন্নয়ন সংস্থা ও হেলডস ওপেন স্কাউট গ্রুপ। এ খবরগুলো খুব আশার সঞ্চার করে। হতাশ ও অসহায় কৃষকের পাশে দাঁড়ানো এই মানুষগুলোই বাংলাদেশে নতুন এক ইউটোপিয়ার বারতা দিল। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে উঠে আসা একটা দেশের প্রত্যেক নাগরিকের কৃষি বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকা জরুরি। আমাদের দেশে বইপত্রে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণি পর্যন্ত কৃষিশিক্ষা বাধ্যতামূলক হলেও সে শিক্ষাটা হাতে-কলমে নয়। ফলে একজন শিক্ষার্থী যেমন কৃষকের ব্যথাটা অনুভব করতে পারে না, তেমনি কৃষকের ফসল ফলানোর অনন্য আনন্দটুকু থেকেও সে বঞ্চিত হয়। আমি প্রতি বছর ‘ফিরে চল মাটির টানে’ নামে একটা কার্যক্রমের মাধ্যমে শহরের শিক্ষার্থীদের কৃষির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার এ কাজের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা দেখে অন্যরাও যেন তাদের সন্তানদের কৃষির সঙ্গে সংযোগ ঘটায়। এই ছেলেমেয়েরা হয়তো বড় হয়ে কেউ কৃষক হবে না, কিন্তু তাদের চিন্তাভাবনায় যেন কৃষিটা থাকে। যে ছেলেটা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হলো সে যেন কৃষকের কথা চিন্তা করে একটা সফটওয়্যার ডেভেলপ করে। যে মেয়েটা গবেষক হবে সেও যেন কৃষিকে মাথায় রাখে। যে যেখানে যা-ই করুক সবার ভিতরেই যেন কৃষির প্রতি ভালোবাসা থাকে। যা হোক, সাম্প্রতিক সময়ে কৃষকের ধানের বাজারদর নিয়ে মিডিয়া বাজার খুব গরম, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া। আমি মনে করি বর্তমানে ধানের দর না থাকার পেছনে আমাদেরও দায় আছে, দায় আছে সবরকমের মিডিয়ার। ২০১৭ সালে আকস্মিক বন্যায় হাওরাঞ্চলের ফসল নষ্ট হওয়ার ঘটনাটি মিডিয়ায় এমনভাবে ফোকাস পায় যেন দেশে খাদ্য ঘাটতি অবশ্যম্ভাবী। সরকার থেকে বলা হয়েছিল, এই ঘাটতির ফলে ঘাটতি হবে ১০ লাখ টন চালের। সে সময় সাধারণ কৃষক থেকে শুরু করে চাল ব্যবসায়ী, আড়তদার, চাতাল মালিক লাভের প্রত্যাশায় প্রচুর চাল মজুদ করে। সরকারও আপৎকালীন নিরাপত্তার জন্য বাইরে থেকে চাল আমদানি করে। চাল আমদানির শুল্ক ২৮% থেকে ২%-এ নামিয়ে আনা হয়। সরকারি-বেসরকারিভাবে প্রচুর চাল আমদানি হয়। ২০১৭-১৮ সালে ৬০ লাখ টন চাল আমদানি হয়। সে বছর হাওরে ও উত্তরাঞ্চলে বন্যায় সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়। হাওরে বন্যায় ফসল নষ্ট হলেও সে বছর সারা দেশে বোরোর ফলন ভালো ছিল। প্রকৃত অর্থে খুব বেশি ঘাটতি হয়নি। কিন্তু আমদানি থামেনি। সরকার আমদানি শুল্ক পুনরায় আরোপ করার আগেই প্রচুর এলসি খোলা হয়। ব্যবসায়ীরা লাভের প্রত্যাশায় প্রচুর চাল নিয়ে আসে। তারপর আমনেও বাম্পার ফলন। আর ২০১৮ সালেও ধানের ফলন বেশ ভালো হয়। যে লাভের আশায় চালকল মালিক, আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা খাদ্য মজুদ করেছিল সেই গুড়ে বালি। তাদের গুদামে এখনো পুরনো চাল রয়ে গেছে। ফলে তারাও এখন আর চাল কিনছে না। বেশ কয়েকজন চালকল মালিকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি বোরোর এ মৌসুমে সারা দেশে চালু রয়েছে মাত্র ১ হাজার চালকল। অথচ বোরো ধান কাটা শুরু হওয়ার সময় দেশের ১৬ হাজার চালকলের প্রায় সবকটিই চালু থাকত। চালকল মালিকরা লোকসান গুনেছেন। তারা টাকা বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট। ব্যাংক ধান কিনতে ব্যবসায়ীদের টাকা দিচ্ছে না। আরেকটি বিষয় হলো, ভারত প্রতি তিন বছর পরপর তাদের খাদ্যগুদামগুলোয় থাকা খাদ্যশস্য ঝেড়ে ফেলে নতুন করে মজুদ করে। সে সময় কম মূল্যে প্রচুর চাল তারা বিক্রি করে দেয়। চালের মান তেমন ভালো হয় না। তারা সেগুলো সাধারণত গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু আমাদের দেশের চাল ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ ওই চাল কম মূল্যে কিনে এনে পুনরায় মিলিং করে বাজার মূল্যে বিক্রি করে। এসব কারণেই এ মৌসুমে ধানের দরপতন।  চালকল মালিকরা এ মৌসুমে ধান কিনছেন নাÑ এটিই কৃষকের ধানের দর না পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। খাদ্য অধিদফতরের তথ্যমতে সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা ২১ লাখ টন। বর্তমানে খাদ্য মজুদ আছে প্রায় ১৩ লাখ টন। সরকার এ মৌসুমে ১২ লাখ টন চাল কেনার কথা বলেছে; যা মোট উৎপাদনের ৫ শতাংশেরও কম। ফলে উদ্বৃত্ত চাল নিয়ে ধানের দরের এ সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন ব্যাপার। আমি অনেক দিন থেকে বলে আসছি সরকারের খাদ্য মজুদ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। সেটা কমপক্ষে ৫০ লাখ টন হওয়া উচিত। আমাদের দেশের ৩ কোটি টন দানাদার খাদ্যের বাজারে সরকারি মজুদ ক্ষমতা মাত্র ২০ লাখ টন (তাও কাগজে-কলমে)। এত কম মজুদ ক্ষমতা নিয়ে সরকার খোলাবাজারিদের সঙ্গে পেরে উঠবে না। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আমি মনে করি ভর্তুকি দিয়ে হলেও সরকারের চাল কেনার পরিমাণ বাড়ানো উচিত। কৃষকের অভিযোগ, সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনে না। কৃষকের কাছ থেকে সরকার সরাসরি ধান না কেনারও কারণ আছে। সরকারি গুদামে ধান দিতে হলে সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা নিশ্চিত করতে হয়। আর না হলে গুদামে ধান গজিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের বেশি হলে কৃষকের সে ধান সরকার নেয় না। এদিকে কৃষক ময়েশ্চার কী তা-ই জানে না। শুধু কৃষকই নন, সরকারি কর্মকর্তারাও তাই নিশ্চিন্ত হতে চালকল মালিকদের কাছ থেকেই ধান কেনেন। এসব ছাড়াও ধানের বাজারে অন্য কোনো সিন্ডিকেট কাজ করছে কিনা সরকারকে তা তলিয়ে দেখা উচিত। এ সংকট কাটিয়ে উঠতে কৃষকের পাশে দাঁড়ানো উচিত সংশ্লিষ্টদের। উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দাম না পাওয়ার কষ্টটুকু কৃষকের একান্ত নিজের। অথচ কৃষি ও কৃষকের সমস্যাটা যদি আমরা সবাই অনুভব করতে পারতাম তাহলে কোনো সংকটই অতিক্রম করা কঠিন হতো না।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর