সোমবার, ৩ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিউক্লিয়ার ফর বেটার লাইফ : বাস্তব প্রেক্ষাপট

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

নিউক্লিয়ার ফর বেটার লাইফ : বাস্তব প্রেক্ষাপট

‘নিউক্লিয়ার ফর বেটার লাইফ’ প্রতিপ্রাদ্য বিষয় নিয়ে এপ্রিলে রাশিয়ার অবকাশ কেন্দ্র ও শীতকালীন অলিম্পিক গেমস-২০১৪ এর আয়োজক বলে পরিচিত সূচিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ১১তম আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি ফোরাম এটমএক্সপো-২০১৯। পরমাণু শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত বা কিছুটা খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছে এটমএক্সপো ফোরাম সমধিক পরিচিত।

রুশ রাষ্ট্রীয় পরমাণু শক্তি করপোরেশন রসাটমের উদ্যোগে ২০০৯ সাল থেকে প্রতি বছর নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ এটমএক্সপো। গত এক দশকে এর কলেবর যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি সূচিতেও এসেছে অনেক বৈচিত্র্য। দুই দিনব্যাপী ফোরামটিতে এ বছর বাংলাদেশসহ ৭৪টি দেশের তিন হাজার ৬০০-এর বেশি প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। যার মধ্যে ছিলেন পরমাণু বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ, নীতি-নির্ধারক, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ, পরমাণু শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ প্রমুখ। পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহারকারী উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি ফোরামে অংশগ্রহণ করেছিল এই প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ। উন্নত দেশগুলো তাদের উদ্ভাবিত নিত্য-নতুন পণ্য ফোরামে প্রদর্শন করে থাকে।

পরমাণু প্রযুক্তির ব্যবহার আজ শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ নয়, জীবনের প্রায় সর্ব ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে। কৃষি, চিকিৎসা, শিল্প উৎপাদন, পরিবহন, মহাকাশ গবেষণাসহ বিভিন্ন খাতে পরমাণু প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানবজাতির সুরক্ষা ও উন্নততর জীবনমান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করতে পরমাণু প্রযুক্তি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম তা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

জাতিসংঘের নির্ধারিত ১৭টি সূচকই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার ওতপ্রতোভাবে জড়িত, এমনটাই অভিমত রসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচোভের। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তব্যে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে ফোরামটি সর্বাধুনিক পরমাণু প্রযুক্তির বর্তমান রূপটি বিশ্বব্যাপী জানান দেওয়ার সুযোগ করে দেবে এবং এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নির্মল পৃথিবীর ভিত রচিত হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ১৭ নম্বর সূচকটি বাকি ১৬টি সূচকের লক্ষ্য অর্জনে পার্টনারশিপ বা অংশীদারিত্বের কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এটমএক্সপো উপলক্ষে বক্তব্যে উল্লেখ করেন, রাশিয়া সক্রিয়ভাবে পরমাণু শক্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে এবং পার্টনারদের উচ্চমান সম্পন্ন, নির্ভরযোগ্য, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব সমাধান পেতে সহায়তা করে আসছে।

এটা সর্বজনবিদিত যে, একলা চলো নীতি অবলম্বন করে কোনোভাবেই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব নয়। প্রয়োজন পারস্পরিক মত ও অভিজ্ঞতা বিনিময়, সমন্বিত প্রয়াস। এটমএক্সপো ফোরামটি ছিল এমনই একটি প্ল্যাটফর্ম। পরমাণু প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে এখানে মোট ১৮টি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পারস্পরিক সহযোগিতা সংক্রান্ত তিন ডজনেরও বেশি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ফোরামটিতে।

বর্তমানে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিশ্বের জলবায়ুর উষ্ণায়ন একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় সীমাবদ্ধ রাখা। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সম্মেলন ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত চুক্তিতে ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি শিল্প-বিপ্লব পূর্ববর্তী তাপমাত্রার চেয়ে দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে ধরে রাখার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে পরমাণু শক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমানে পরমাণু শক্তি ব্যবহারের ফলে বছরে ২০০ কোটি টন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশনের জ্বালানিবিষয়ক উপ-মহাপরিচালক গেরাসিমভ থমাস একটি সেশনে বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু সংক্রান্ত ২০৫০ লক্ষ্যমাত্রা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদানের মধ্যে যে ফারাক রয়েছে তা পূরণ করতে পরমাণু শক্তির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপ গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন ২০৩০ সাল নাগাদ ৪৫ শতাংশ, ২০৫০ নাগাদ ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কার্বনমুক্ত করার ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তির ব্যবহার জরুরি বলে মনে করি। বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এটা প্রতীয়মাণ হচ্ছে, ইউরোপের বিদ্যুৎ চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ পূরণে পরমাণু শক্তির প্রয়োজন অপরিসীম।”

বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় এটি প্রতীয়মাণ হয়, যদিও বর্তমানে জার্মানি ও ইতালিসহ কয়েকটি দেশ পরমাণু বিদ্যুৎ থেকে সরে আসতে চাইলেও যৌক্তিক কারণেই নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ দিয়ে ভবিষ্যতের বিদ্যুতের চাহিদা মিটানো সম্ভব হবে না। বর্তমানে পরমাণু প্রযুক্তি যেভাবে উন্নয়ন ঘটছে তা থেকে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, অদূর ভবিষ্যতে এটি হতে যাচ্ছে সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব।

তবে ২১০০ সাল নাগাদ বিশে^ প্রায় ১১০০ কোটি মানুষের বিশাল বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে নিউক্লিয়ার এবং নবায়নযোগ্য শক্তি হতে হবে একে অন্যের পরিপূরক, মুখোমুখি নয়। তবে প্রযুক্তির চেহারা হবে সম্পূর্ণ ভিন্নতর, যা জেনারেশন-৪ প্রযুক্তি নামে অভিহিত হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে থাকবে জেনারেশন-৪ নামক পরমাণু ও সৌর প্রযুক্তি। একই সঙ্গে থাকবে বিস্তর চ্যালেঞ্জ- প্রযুক্তি উন্নয়ন বিষয়ক পলিসি সাপোর্ট, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থ বিনিয়োগ, গবেষণা, অস্ত্র বিস্তাররোধ, জেনারেশন-৪ প্রযুক্তিজ্ঞান সমৃদ্ধ প্রশিক্ষিত জনবল ও সংস্থা, নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জনসচেতনা, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতা, সরল দৃষ্টিভঙ্গি।

অনেক বছর পর যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। জাপান ধীরে ধীরে ফুকুশিমার দুর্ঘটনার আগের অবস্থায় ফিরতে যাচ্ছে। রাশিয়া তার মোট চাহিদার ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ পরমাণু শক্তি থেকে তৈরি করছে। বর্তমানে তারা নিজ দেশে আরও সাতটি পরমাণু বিদ্যুৎ ইউনিট তৈরি করছে এবং দেশের বাইরে অন্য ১২টি দেশে অনুরূপ ৩৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। চীন ও ভারত তো পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে রকেট গতিতে এগোচ্ছে।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কাজে লাগিয়ে নির্মল বিদ্যুৎ উৎপাদনে টেকসই অর্থনীতি উন্নয়নে উদাহরণ সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পে স্থাপিত হতে যাচ্ছে সর্বশেষ ৩+ প্রজন্মের রুশ ভিভিইআর ১২০০ রিঅ্যাক্টর ভিত্তিক দুটি ইউনিট, যার রেফারেন্স তিনটি ইউনিট ইতিমধ্যে রাশিয়ার জাতীয় গ্রিডে সফলভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে এবং ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি, বেলারুশ, তুরস্কসহ অন্য কয়েকটি দেশে নির্মাণের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। অনুরূপ বিদ্যুৎ ইউনিট স্থাপনের জন্য ভারতও ইদানীং রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

আধুনিক এই ভিভিআর ১২০০ রিঅ্যাক্টর বছরে মাত্র ২৯ টন ইউরেনিয়াম জ্বালানি ব্যবহার করে। অন্যদিকে একই ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজন হয় বছরে ৮৭ মিলিয়ন টন কয়লা ও ৫৪ মিলিয়ন টন তেল। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের কথা বিবেচনা করলে কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় ভিভিইআর ১২০০ ভিত্তিক পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে আদর্শ আর কোনো সমাধান হতে পারে না।

অতি মাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে, কার্বন দূষণে, জলবায়ুর রূঢ় আচরণে, পৃথিবীর নিম্নাঞ্চলগুলো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে। বাংলাদেশ হচ্ছে তার অন্যতম। জ্বালানি নিরাপত্তা, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও জলবায়ুর পরিবর্তন বিষয়ে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভূমিকা হবে অপরিসীম।

রসাটমের আমন্ত্রণে আমিসহ দুজন মিডিয়াব্যক্তিত্ব এবারের এটমএক্সপোতে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে ফোরামে অংশ নেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী, রূপপুর পরমাণু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক এবং রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। ব্যক্তিগতভাবে আধুনিক জেনারেশন ৩+ পরমাণু চুল্লি, নতুন ধরনের উচ্চ নিরাপত্তা ও দক্ষতা বিশিষ্ট গবেষণা চুল্লি, নিউক্লিয়ার সাবমেরিন ও ভাসমান পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তাত্ত্বিক জ্ঞানের সঙ্গে বাস্তব জ্ঞানের মিল-অমিল খুঁজে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। সুযোগ হয়েছে ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার সংঘের প্রধান নির্বাহী, ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব নিউক্লিয়ার অপারেটরের প্রধান নির্বাহী, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত পরিবেশবিদ মাইকেল সেলেনবারগারসহ বিভিন্ন দেশের পরমাণু গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরিচয় ও মতবিনিময় আমার জন্য ছিল এক দারুণ অভিজ্ঞতা। সর্বাধুনিক পরমাণু প্রযুক্তি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে অধিকসংখ্যক সাংবাদিক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, গবেষক ও নীতি-নির্ধারক এ ফোরামে অংশগ্রহণ করা উচিত বলে আমি মনে করি। এতে পরমাণু প্রযুক্তি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা জন্মাবে। পরিবেশ রক্ষা করে সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ হোক আগামীর প্রত্যাশা।

লেখক : চেয়ারম্যান, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর