সোমবার, ৩ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা
মতামত

শিশুদের সাজানো বাগান চাই

ফাতিমা পারভীন

শিশুদের সাজানো বাগান চাই

পারিবারিক নিয়ম-শৃঙ্খলা, ভালোবাসা, সাহায্য-সহযোগিতা, সহানুভূতি ও অনুপ্রেরণার মাধ্যমেই একজন শিশু সমাজে প্রত্যাশিত সব আচরণ করতে শিখে। প্রকৃতপক্ষে অনেক আকাক্সক্ষা-অনুভূতির মধ্য থেকে যখন ভ্রণ হয়ে একটি শিশুর মাতৃগর্ভে আগমন ঘটে, ঠিক তখনই শুরু হয় ছেলে-মেয়ের বিভেদ সৃষ্টি। গর্ভধারিণী মা নিজেই কামনা করেন ভ্রূণটি যেন সুন্দর একটি পুত্রসন্তান হয়। চিকিৎসার উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পাঁচ থেকে ছয় মাসের সময়ে যখন মেয়ে ভ্রূণের অস্তিত্ব বা পরিচয় ঘটে তখন থেকেই শুরু হয় অনাগত আবেগীয় নির্যাতন। সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় সেবা ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা বা চেকআপ অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে।

দিন-মাস পেরিয়ে যখন পৃথিবীর বুকে ভ্রূণের আগমন ঘটে তখন পরিবারে ভিন্ন মানসিক গঠন নিয়ে গড়ে ওঠে বিশাল এক বৈষম্য। তাতে যতই উচ্চবিত্ত পরিবারই হোক না কেন। যদিও সমাজে তাদের অতীতের ঐতিহ্য, সুনাম ধরে রাখার জন্য লোকচক্ষুর সামনে শিশুকে আলাদা করে না কিন্তু অন্তরালে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। মনের মণিকোঠায় পুত্রসন্তান বংশের বাতি আর পরবর্তী বংশধর হয়ে নিমগ্ন হৃদয়ের গহিনে দাগ কাটে। অথচ একটু দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে মেয়েশিশু হয়ে উঠতে পারে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। জীবন আর পরিচয় বদলে দিতে পারে।

ছেলে বা মেয়ে নয়, একটি শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে প্রথমেই প্রয়োজন শিশুকে বাঁচিয়ে রাখা। পারিবারিক কলহমুক্ত রেখে শিশুকে আনন্দময় পরিবেশ উপহার দেওয়া। ছেলেশিশু মেয়েশিশুর বৈষম্য না রাখা। বড়রা যাতে কোলে তুলে নিয়ে চিমটি কাটা, সুড়সুড়ি দিয়ে অধিক পরিমাণে হাসিয়ে মজা না নেয়, সেদিকে খেয়াল করা। শিশুকে অধিক হাসানো শিশুর ওপর এক আবেগীয় নির্যাতন। যা আদর কিংবা স্নেহ-ভালোবাসার মধ্যেই পড়ে না। অনেক সময় শিশুকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোলে তুলে নেওয়া হয়, এতে শিশুকে মারলে যেমন শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, তেমনি জোর করে কিংবা তার অনিচ্ছার বিরুদ্ধে কোলে নেওয়াতেও শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শুধু সাধারণ ও পারিবারিক এই সমস্যাগুলোই সমস্যা নয়, শিশুদের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যাও ব্যাপক, তার শিক্ষা জীবনকে এসব সমস্যা ব্যাহত করতে পারে। তাকে অমনযোগী হতে, স্কুল পালাতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এ জন্য শিশুদের সুরক্ষা দিতে হলে তাদের যথাযথ পরিচর্যা করতে হবে। কিশোরীদের বিশেষক্ষেত্রে প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রয়োজন স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন। বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক পরিবর্তনকে মানাতে সহযোগিতার জন্য প্রয়োজন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকদের সচেতন করা। কেননা একজন শিশুকে লালন-পালনের মধ্য দিয়ে সমাজে পরিচিতি লাভ করে। একজন সুনাগরিক হতে সহায়তা করে। শিশুর আচরণ পরিবারের সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তা অবদান রাখে। শিশুবিকাশে শুধু একজন মা নয়, গোটা পরিবারের ভূমিকা জরুরি। এখানে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সচেতনতার জন্য সরকারকর্তৃক উন্নয়নমুখী তৎপরতা আরও বেশি জরুরি। সরকার ও পারিবারিক সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া মূলত শিশুর শারীরিক-মানসিক বিকাশ ও সন্তোষজনক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব নয়। প্রতিটি পরিবারের উচিত সঠিক সময়ে শিশুকে শিক্ষার সুযোগ দেওয়াসহ মতপ্রকাশের অধিকার।

টেকসই উন্নয়ন অর্জনে প্রয়োজন, গর্ভবতী মা ও সব শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি ও কৈশোরকালীন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা। এ জন্য সরকারকে আগেই নারীদের গর্ভ, প্রতিটি শিশুর জন্ম ও পরিচর্যা, কিশোর, কর্ম, বাল্যবিয়ে- এসব জায়গায় সমস্যা নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষ করে সব ডেলিভারি যেন হাসপাতালে বা দক্ষ ধাত্রী দ্বারা হয়, তা সরকার কর্তৃক নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় সরকার এখানে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। উন্নয়ন বলতে শুধু রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, অবকাঠামো নয়। একজন সুস্থ শিশুর আগমন ও তার পরিচর্যাও উন্নয়নের একটি বড়সড়ো অংশ। মানবসম্পদ গড়তে হলে প্রথমে একজন শিশুর সব অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। উন্নয়নে তহবিল থেকে স্থানীয় সরকার ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে, পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীকে সচেতনতার লক্ষ্যে গণনাটক, উঠানবৈঠক, দক্ষ ধাত্রী প্রশিক্ষণ, অভিভাবক সমাবেশ, মা সমাবেশ, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন, স্বাস্থ্যকর্মী ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্থানীয় সমাবেশ প্রকল্পের আওতায় আনতে পারে। পরিশেষে বলতে চাই আজকের যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে, আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই।

লেখক : নারী ও শিশু অধিকার কর্মী।

[email protected]

সর্বশেষ খবর