শনিবার, ৮ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ, ভারতীয় বহুত্ববাদ ও মোদির দ্বিতীয় মেয়াদ

হারুন হাবীব

বাংলাদেশ, ভারতীয় বহুত্ববাদ ও মোদির দ্বিতীয় মেয়াদ

ভারতের মতো বহুমাত্রিক ও সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচন স্বভাবতই গোটা বিশ্বকে আকৃষ্ট করে। নানা আঙ্গিকে আরও বেশি আকৃষ্ট করে ভারতের পড়শি দেশগুলোকে, যাদের সঙ্গে ভারতের সীমানা আছে এবং সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত সম্পর্ক কিংবা বন্ধুত্ব ও বৈরিতা আছে। সেদিক থেকে ২০১৯-এর মহানির্বাচনটি সংগত বিশ্ব আকর্ষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক মাসের ভোটপর্বের ফলাফলে দেখা গেল এবারও দিল্লির মসনদ নরেন্দ্র মোদির কব্জায় থাকল, কংগ্রেস বা মোদিবিরোধীরা মোটেই সুবিধে করতে পারল না।

২০১৪ সালের নির্বাচনে গুজরাটের বহুল আলোচিত-সমালোচিত মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন প্রথমবার দিল্লি দখল করলেন তখন বড় চমক দেখিয়েছিলেন। কারণ তার আগে কোনো মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি রাজ্য থেকে কেন্দ্রের ভার নেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেননি। কিন্তু ২০১৯-এর চমকটা যেন আরও বেশি, আরও কৃতিত্বপূর্ণ! কংগ্রেস দলটি আগের চাইতে অনেক বেশি সুসংহত হওয়া সত্ত্বেও তারা প্রয়োজনীয় জনসমর্থন পায়নি। বরং দেখা গেল, আগেরবার মোদি যে গেরুয়া ঝড় তুলেছিলেন, তা স্তিমিত তো হয়ইনি, বরং নতুন নতুন রাজ্যে সে আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে। বলা বাহুল্য, এবারের ঝড়টি যেন অনেক বেশি বিস্ময় জাগানিয়া, আরও তাৎপর্যপূর্ণ। অতএব অস্বীকারের জো নেই মোদি ক্যারিশমা গত পাঁচ বছরেও বিন্দুমাত্র কমেনি বরং বেড়েছে। এ নির্বাচনে ভারতের গণমানুষ তাদের পছন্দের সরকার গঠনের পক্ষে দ্বিধাহীন সমর্থন ব্যক্ত করেছে। এ রায় গণতন্ত্রের, অতএব শ্রদ্ধার। গত নির্বাচন থেকে কিছু আসন বাড়লেও পরপর দুটি নির্বাচনে এটিও প্রমাণিত হয়েছে যে, পারিবারিক ঐতিহ্যের নেতৃত্ব ভারতের মতো দেশে ক্রমান্বয়েই শিকড়শূন্য হয়ে পড়ছে। অনস্বীকাযর্, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী নিজের যোগ্যতার পরিচিতিকে বহুলাংশেই বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মোদির যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেননি।

যেভাবেই চিহ্নিত করি না কেন, এবারের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। সত্তর বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই প্রথম কংগ্রেস বলয়ের বাইরে একটি দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠন করেছে। বিগত ৫০ বছরে এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোনো দলই পরপর দুবার সরকার গঠন করেনি। অধিকন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিজেপি এতটাই জায়গা করে নিয়েছে যাতে পুস্পষ্টভাবে বলা যায় ভারতের রাজনীতিতে গেরুয়া শিবির শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের মোহময়ী প্রচার এবং বেশকিছু জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি মোদির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে রেখেছে। বিতর্ক করাই যেতে পারে আখেরে এই ধর্মীয় জাতীয়তা ভারতের মতো সুবিশাল গণতান্ত্রিক দেশকে, যার শ্রীবৃদ্ধি কেবল বহুত্ববাদের মাধ্যমেই ঘটতে পারে, কতটা লাভবান করবে। তা যদি নাও করে তাহলেও কি সুবিশাল জনগোষ্ঠীর, প্রায় ৯০ কোটি ভোটারের, এ সমর্থনকে ঠুনকো ভাবার অবকাশ থাকে? থাকে না। কারণ এ জয় গণতন্ত্রের জয়।

প্রতিটি নির্বাচন বেশকিছু শিক্ষা রেখে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কংগ্রেস পরপর দুবার হারলেও জাতীয় দল হিসেবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেনি। দলটির ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় যারা বলেন তাদের সঙ্গে আমি একমত হব না। আসি পশ্চিমবঙ্গের দিকে। কী ঘটল সেখানে! মমতা ব্যানার্জির উগ্রমূর্তি ও বাগাড়ম্বর ধুয়েমুছে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এই প্রথমবারের মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা পোক্ত আসন করে নিল! রাজ্যের ৪২টি আসনের প্রায় অর্ধেক দখল করে নিল ভারতীয় জনতা পার্টি। যে বাঙাল মুলুক দীর্ঘ তিন যুগ বামেরা শাসন করেছে, সেই মুলুক আজ বামশূন্য। কংগ্রেসের খাতায়ও মাত্র ২টি দাগ। অর্থাৎ সময়ের চাহিদা পূরণের ব্যর্থতায় রাজ্য থেকে সিপিএম ও কংগ্রেস প্রায় নিশ্চিহ্ন। ক্ষয়িষ্ণু শক্তি হয়ে থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুছে যাওয়া বামদের ঘুরে দাঁড়ানো খুব সহজ হবে না তা বোঝা যায়।

তবে অনেক সাফল্যগাথার পরও এবারের নির্বাচনে প্রথবারের মতো নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ইভিএম নিয়ে বিস্তর বাদানুবাদ হয়েছে, যা আগে হয়নি। এমনকি নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অনেক রাজনীতিবিদের ভাষা ও আচরণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিপরীত ছিল। লক্ষ্য করার মতো যে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপির ইশতেহারে মূল বিষয় ছিল সুশাসন এবং যোগ্য নেতৃত্ব। ২০১৯ সালে জায়গা করে নিয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা। বিগত পাঁচ বছরে স্বাভাবিক কারণেই বেকারত্ব বেড়েছে, কৃষকের ঋণ সংকট ইত্যাদি বিক্ষোভের কারণ হয়েছে। জনগণের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ ও শঙ্কা পরিলক্ষিত হতে পারে এ বিবেচনাতেই যে নির্বাচনী নীতি নির্ধারিত হয়েছে বোঝা যায়। অনেকে আশঙ্কা করেন ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা অদূর ভবিষ্যতে ভারতকে আরও প্রকটভাবে গ্রাস করবে। আমার বিশ্বাস, যতটা ভাবা হচ্ছে বাস্তবতার খাতিরেই ততটা হবে না হয়তো। অবশ্য সবটাই ভবিষ্যৎ। বিস্তর বাদানুবাদ চলছে দ্বিতীয় মেয়াদে শ্রী নরেন্দ্র মোদি কী ধরনের শাসক হবেন। প্রথমবারের মতো নাকি অন্য রকম। আরও আলোচিত যে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির উত্থান-পতনে পাশাপাশি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কতটা প্রভাবিত হবে? প্রশ্ন উঠছেÑ সামনের দিনগুলোয় ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ, উদারবাদী শক্তি কি আরও বিপন্ন হবে? কিংবা উগ্র ডানপন্থি বা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা কি আরও বলশালী হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। তবে ভারতের মতো দেশের মূল শক্তি যেখানে বহুত্ববাদী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতি, যা দেশটিকে এগিয়ে নিয়েছে, সেই ভিত্তির পতন ঘটানো হলে তা মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।

লক্ষ্য করার বিষয় যে, প্রথম যাত্রায় মোদিকে যতটা কট্টর হিন্দুত্ববাদী ভাবা হয়েছিল, তিনি তা হননি বা হতে পারেননি। এবারের নির্বাচনের আগেও একই শঙ্কা জেগে উঠেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়েনি। মনমোহন সিংয়ের কংগ্রেস শুরু করলেও মোদির বিজেপির হাতেই দুই দেশের সম্পর্ক শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে, নতুন উচ্চতায় উঠেছে। সাংস্কৃতিক সম্পর্কের উন্নয়ন, ছিটমহল বিনিময়, সীমান্ত সমস্যার সমাধান, ট্রানজিট সুবিধা, বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ বহুবিধ ক্ষেত্রে দুই দেশের অভূতপূর্ব সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তারই আমলে। স্বীকার করাই সমীচীন যে, মোদি কংগ্রেসের ধারবাহিকতা রক্ষা করেছেন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন। সবাই জানি, প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ভারত সরকার কিছু বিষয়ে তাদের অঙ্গীকার পূরণ করতে পারেনি। কেন পারেনি তাও সবার জানা। দ্বিতীয় মেয়াদে মোদির নিজের আশ্বাস কীভাবে বাস্তবায়ন করেন তা দেখার বিষয়। আশা করা যায়, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির দৃঢ় পদচারণে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি আর আগের মতো অধরা থাকবে না।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের আস্থা আরও পুষ্ট করার জন্য অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন ও তিস্তার চুক্তি সম্পন্ন হওয়া সময়ের দাবি। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রশ্নে বাংলাদেশ যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, ভারত সেখানে আরও কত বেশি সহযোগিতা করতে পারে, তাও দেখার বিষয়। অনেক কথাবার্তার পরও সীমান্ত হত্যাকান্ডের খবরগুলো এখনো উদ্বেগের জন্ম দেয়। এরও একটা সুরাহা জরুরি।

আসামসহ বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা রাজ্যগুলোয় অবৈধ অভিবাসীর প্রশ্ন তোলে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি উত্তেজনা তৈরির প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। এ নিয়ে এক ধরনের উৎকণ্ঠারও জন্ম হয়েছে। আসামের মতো অন্য রাজ্যেও এনআরসি কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি উৎকণ্ঠার কারণ হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিষয়টি নরেন্দ্র মোদি কীভাবে মোকাবিলা করেন, তা দেখার বিষয়। বিগত পাঁচ বছরের মোদি শাসনামল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অভ্যন্তরীণ মতাদর্শিক পার্থক্য ও স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নতুন দিল্লির পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে, বিশেষত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, তেমন প্রভাব ফেলেনি। বরং একটা বাস্তববাদী নীতি বজায় রেখেছে মোদি সরকার। আমার বিশ্বাস, এ নীতি অনুসরণ করা হলে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও উচ্চতায় উঠবে।

অনেকেই বলেন, কেউ কেউ আবার প্রয়োজনের চাইতেও বেশি জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোনো বিশেষ দলনির্ভর নয়। জানা কথা। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশের সম্পর্কের ভিত্তি কেবল দলীয় দৃষ্টিকোণ নয়, বরং ইতিহাস, যে ইতিহাস সৃষ্টিতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে ভারত। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের সুস্পষ্ট মানদ- আছে। তার প্রধানতম হচ্ছে দুই দেশের মানুষ একই সংস্কৃতি ও ইতিহাসে সম্পৃক্ত। এ বাস্তবতা থেকেই বাংলাদেশ ও ভারত নিজেদের কূটনীতিতে জনগণের সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়ে জোর দিয়েছে, যা দুই দেশকেই উপকৃত করেছে। বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে ভারতের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি আছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে এক ধরনের বিষয় প্রাধান্য পায়, চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় অন্য বিষয়। একইভাবে ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের ধরন আলাদা। বিষয়টি ভারতের নতুন সরকার কতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে তা দেখার বিষয়। এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে, ভারতের মানুষ একটা স্থিতিশীল সরকার চায়। এককালে কংগ্রেস যেমন স্থিতিশীলতার জন্ম দিয়েছিল, প্রায় ৫০ বছর ধরে, আজ বিজেপি সেই স্থিতিশীল ও শক্তিশালী ভারতের ধারণা দিতে পেরেছে ভারতবাসীকে। ফলে জাতীয় পর্যায়ে উত্থান ঘটাতে সক্ষম হয়েছে বিজেপি। তবে স্মরণ করা যেতে পারে, কোনো দেশেই উগ্রবাদী বা সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান শুভ হয় না, স্বস্তিকর হয় না, হতে পারে না। আশা করি ভারতের নতুন কান্ডারিরা বিষয়টা অনুধাবন করবেন।

আমার বিশ্বাস, বাস্তবতার নিরিখেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক আরও গাঢ় হবে। অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা ও ইতিহাসের কালো অধ্যায় পেরিয়ে আমরা একসঙ্গে পথ চলব। নরেন্দ্র মোদি আগেরবারের চাইতেও সতর্ক দৃষ্টিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে ভাববেন এবং এ সুবিশাল বিজয় তাকে আরও বেশি গণতান্ত্রিক ও মানবিক করে তুলবে-  এ আমার বিশ্বাস।               

লেখক : বিশ্লেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর