সোমবার, ১০ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ফেসবুক আসক্তি

তপন কুমার ঘোষ

ফেসবুক আসক্তি

আমাদের প্রায় সবারই সর্বক্ষণের সঙ্গী স্মার্টফোন। ইন্টারনেট এখন সহজলভ্য। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিংবা বাসে-ট্রেনে বসে দেখে নেওয়া যায় সর্বশেষ খবরাখবর বা নিউজ আপডেট। ফেসবুক বন্ধুরা কে কী পোস্ট করেছেন তাও। সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বদলে দিয়েছে আমাদের জীবনধারা। এক জরিপে দেখা যায়, পৃথিবীতে প্রায় ২৭০ কোটিরও বেশি মানুষ সক্রিয়ভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ফেসবুক। দ্বিতীয় স্থানে আছে মেসেঞ্জার। এরপর রয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব। পৃথিবীর যেসব শহরে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে ঢাকা দ্বিতীয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং কানাডাভিত্তিক একটি ডিজিটাল সেবা প্রতিষ্ঠান এ জরিপ পরিচালনা করে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৭ মে ২০১৯)। বাংলাদেশ প্রতিদিনের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে-  শিশু-কিশোরদের মধ্যে সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বিশ্বব্যাপী। আমাদের দেশেও বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, আমাদের দেশে মাধ্যমিকে স্কুল চলাকালেই সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমে আসক্ত ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী আবার এটি ব্যবহার করছে পাঠদান চলাকালে। শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অত্যধিক আসক্তি কমিয়ে দিচ্ছে পড়ালেখায় মনোযোগ। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিক সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণে মনোদৈহিক নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। একনাগাড়ে দীর্ঘক্ষণ ঘাড় নিচু করে মোবাইল ফোনে বুঁদ হয়ে থাকলে একদিকে যেমন ঘাড়ে ব্যথা অনুভূত হয়, অন্যদিকে বাড়ে স্থূলতা। মানসিকভাবে তৈরি হয় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, বিষণœতা, একাকিত্ব, অপরাধ প্রবণতা। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়া খবর দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু মানুষ কোনো বাছবিচার ছাড়াই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রাপ্ত তথ্য অন্ধের মতো বিশ্বাস করেন। অনেক তথ্যের শিকড় বা সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু তাতে কী! নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে যা মিলে যায় অধিকাংশ মানুষ তা সানন্দে গ্রহণ করেন। সত্যাসত্য যাচাই করার প্রয়োজন নেই। দেখা মাত্রই শেয়ার বা ফরওয়ার্ড। আর সত্যতা যাচাই করার সুযোগইবা কোথায়? কোনটা আসল আর কোনটা নকল তা চিনে নেওয়া সত্যি দুষ্কর। মতলববাজরা এ সুযোগটা নেয়। ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে মিথ্যা পোস্ট দিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে ফায়দা লুটছে। নিছক ফান বা মজা করার জন্যও অনেকে পোস্ট দিয়ে থাকেন। কিন্তু এর পরিণাম যে কী ভয়াবহ হতে পারে তা একবারও ভেবে দেখেন না। মূল ধারার নিউজ মিডিয়ার সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার একটা পার্থক্য আছে। সংবাদপত্রে বা টিভি চ্যানেলে সম্পাদকীয় নীতিমালা থাকে। এটা ফিল্টার (ছাঁকনি) হিসেবে কাজ করে। খবর সম্পাদনা করা হয়। কিন্তু এ ফিল্টারিংটা সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই। ফলে যার যা খুশি তাই পোস্ট করছেন, মন্তব্য করছেন। মন্তব্য করতে গিয়ে আমরা প্রায়ই দিশা হারিয়ে ফেলি। কথার ওপর তো ট্যাক্স নেই। দিনে কয়েকবার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সাধারণ বিষয়াদি ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করা হচ্ছে। দুই-চার দিন পর পর প্রোফাইল পিকচার আপডেট করা হচ্ছে। এটাকে আসক্তি (নেশা) ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়! ফেসবুক বন্ধুদের কাছে এগুলো একঘেয়ে, বিরক্তিকর এবং জঞ্জাল মনে হতেই পারে। কয়টা ‘লাইক’ পড়েছে এটা দেখে পছন্দ-অপছন্দ বোঝার উপায় নেই। ‘অপছন্দ’ করার অপশনই তো নেই। ‘সব ঘটনাই খবর নয়’। ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ না হলে তা বন্ধুদের আগ্রহের বিষয় হবে না। ঘটনার বর্ণনায় কী, কখন, কেন, কোথায়, কে এবং কীভাবেÑ এ ছয়টি প্রশ্নের জবাব থাকতে হবে। ছবি ব্যতিক্রমধর্মী হতে হবে। ছবির পরিচিতি না থাকলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার আগে এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।

বিশিষ্ট কান, নাক ও গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. প্রাণ গোপাল দত্ত সম্প্রতি চটগ্রামে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বলেন, ১৬ বছরের কম বয়সী কারও হাতে মোবাইল ফোন দেওয়া উচিত নয়। বিল গেটস ১৪ বছরের আগ পর্যন্ত নিজের কোনো ছেলেকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেননি। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল ফোনে কথা বলা উচিত নয়। অনেকক্ষণ মোবাইল ফোনে কথা বললে মাথা ব্যথা, ঘুম না আসা এবং সহজ বিষয়ও ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের উল্লেখ করে তিনি জানান, ফেসবুক মানুষের মস্তিষ্কে কোকেনের মতোই আসক্তি সৃষ্টি করে (মেডিভয়েস, ২৬ এপ্রিল ২০১৯)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মনোবিজ্ঞানী মেহতাব খানম সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মাদকের চেয়েও ভয়াবহ সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে মানুষের মাঝে অস্থিরতা বেড়ে গেছে। সব বয়সীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে মানসিক চাপ। রাতের পর রাত জেগে কিশোর-কিশোরীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ হয়ে থাকছে। এতে পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। এ মনোবিজ্ঞানী আরও বলেন, এখন খুব সহজেই একজনের সঙ্গে আরেকজনের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এ কারণে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বেড়ে যাচ্ছে। তবে তিনি একথাও বলেছেন, সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে দেওয়া এর সমাধান নয়। সমাধান কোন পথে? সোশ্যাল মিডিয়ার দায়িত্বশীল ব্যবহার, তার জবাব। সোশ্যাল মিডিয়া এখন জনমত গঠন ও প্রতিবাদ জানানোর একটি শক্তিশালী প্লাটফর্ম।

অন্যায়-অবিচার-অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। প্রতিবাদ ও ক্ষোভ ঝরে পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার রোধ করতে হবে। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়- এ কথা আমরা সবাই জানি। ফেসবুকের দায়িত্বশীল এবং পরিমিত ব্যবহারেই রয়েছে সমস্যার সমাধান। ফেসবুক-আসক্তি মাদকাসক্তির চেয়েও যে ভয়ঙ্কর!

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক সোনালী ব্যাংক লিমিটেড। 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর