শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

রমজানের ঘ্রাণ লেগে থাকুক জীবনভর

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

রমজানের ঘ্রাণ লেগে থাকুক জীবনভর

তাকওয়ার সওগাত নিয়ে এসেছিল রমজান। রমজানের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে অন্যরকম এক শুদ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছিল। ঘরে-বাইরে, হাটে-বাজারে সবখানে তাকওয়ার বীজ বুনে দিয়ে গেছে রোজা। তাই তো সর্বত্র তাকওয়ার শীতল বাতাস বইতে শুরু করেছিল। মসজিদগুলো মুসল্লিতে ভরে উঠেছিল। ধুলো জমা কোরআনে লেগেছিল তিলাওয়াতের সুর। মৃত আত্মা জেগে উঠেছিল। জীর্ণ ইমান সবল হয়েছিল। এভাবেই একটি মাস তাকওয়ার চর্চা করে আমরা শাওয়ালের পয়লা তারিখে ঈদ উদ্যাপন করেছি। উপমহাদেশের মুসলমানদের রোজা— ঈদ দেখে একজন ধর্মবিষয়ক গবেষক খুব আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, এই মুসলমানরাই কি বিগত এক মাসজুড়ে কঠোর সংযমের চর্চা করে অন্যের প্রতি সহমর্মিতার চমৎকার চর্চা দেখিয়েছিল? শাওয়ালের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি ও সমাজ জীবন থেকে যেভাবে আমরা তাকওয়ার পোশাক খুলে ফেলি, তা দেখে বিস্মিত হওয়ারই কথা। আফসোস! এক মাসের সংযম আমরা একটি দিনও ধরে রাখতে পারলাম না। ঈদের দিন থেকেই যেভাবে ধর্মকর্ম ছেড়ে অশ্লীলতা, বেপর্দা, বিজাতীয় সংস্কৃতিচর্চায় আমরা মেতে উঠেছি। এতে সন্দেহ হচ্ছে, আমার রোজা কতটুকু কবুল হয়েছে।

রোজা তো কোনো জাদুমন্ত্র নয় যে, এক মাস না খেয়ে থাকলেই আপনি পাক্কা মুত্তাকি হয়ে যাবেন। রোজা কোনো অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেটও নয়, নিয়মিত এক মাস এ ওষুধ খেলে একজন খারাপ মানুষ ভালো মানুষে পরিণত হবে। রোজা হলো একটি প্রশিক্ষণ। চর্চার বিষয়। প্রতীকী ইবাদত। এক মাস রোজার চর্চা বান্দাকে দেখিয়ে দিয়েছে বছরের বাকি দিনগুলো কীভাবে তাকে চলতে হবে, আমাদের সেভাবেই চলা উচিত। আফসোস! আমরা রোজাকে বুঝতে ভুল করেছি। তাই রোজা পালন করেও রোজার সুফল আমরা পাইনি। আপনি যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যান, ডাক্তার আপনাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। মনে করুন, আপনি এক মাসের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলেন। এই এক মাস ডাক্তারের পরামর্শের বাইরে এক মুহূর্তও চলার কোনো সুযোগ ছিল না আপনার। সারাক্ষণ চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে ছিলেন। আগে আপনার অনেক বাজে অভ্যাস ছিল। ধূমপান করতেন। মাদক নিতেন। রাতে দেরি করে ঘুমাতেন। ব্যায়াম করতেন না। ঠিকমতো খেতেন না। খেলেও তা স্বাস্থ্যসম্মত ছিল না।

এই এক মাসের নিবিড় পরিচর্যায় ডাক্তার আপনার পুরনো সব বদভ্যাস বদলে দিয়েছেন। আপনার ফুসফুস, হার্ট, দেহযন্ত্র ঠিকভাবে কাজ করতে শুরু করেছে। এখন ডাক্তার বলল, এবার আপনি বাড়ি যেতে পারেন। তবে হাসপাতালে যে নিয়মে চলেছেন, বাড়ি গিয়েও কিন্তু একই নিয়মে চলতে হবে। এখন কি আপনি বলতে পারবেন, এক মাস হাসপাতালে থেকেছি, এখন আর চিকিৎসকের পরামর্শ না মানলেও চলবে। বরং হাসপাতালের নিয়ম তো আপনি ফলো করবেনই, অতিরিক্ত আরও সতর্ক হয়ে জীবনযাপন করতে দেখা যাবে আপনাকে। একটু এদিক-সেদিক হলেই ডাক্তারকে ফোন করবেন। ডাক্তারের চেম্বারে দৌড়াবেন।

প্রিয় পাঠক! পাপ যখন আমাদের মনকে অসুস্থ করে ফেলে, আত্মার সজীবতা যখন আমরা হারিয়ে ফেলি, তখন মহান চিকিৎসক আল্লাহ এক মাসের নিবিড় পরিচর্যার কোর্স রমজান আমাদের দান করেন। এ কোর্সের মাধ্যমে আমাদের আত্মা আলোকিত হয়। মনে আল্লাহর ভয় জাগে। দুনিয়া ছেড়ে আখেরাতের জীবনের জন্য আমরা প্রস্তুতি নিতে থাকি। আল্লাহর দেওয়া এক মাসের নিবিড় পরিচর্যা আমরা শেষ করেছি। এখন আমাদের উচিত বাকি ১১টি মাসও রমজানের মতোই শুদ্ধ জীবনের চর্চা করা। মসজিদগুলো মুসল্লিতে ভরিয়ে রাখা। হাটে-বাজারে, ঘরে-বাইরে সবখানে তাকওয়ার পরিবেশ বজায় রাখা। যদি আমরা তা করতে পারি তাহলে বুঝব আমাদের রোজা আল্লাহ কবুল করেছেন। তাই আসুন আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত রমজানের প্রশিক্ষণের আলোকে সাজাই। আমাদের জীবনে রমজানের সুঘ্রাণ লেগে থাকুক বছরজুড়ে।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর