সোমবার, ১৭ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ট্রাম্প ও মোদির উত্থান অশনিসংকেত

নূরে আলম সিদ্দিকী

ট্রাম্প ও মোদির উত্থান অশনিসংকেত

আমি যদি সুকান্ত ভট্টাচার্য অথবা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো বাম বিপ্লবী কবি হতাম, তাহলে দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেতাম পৃৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ধর্মকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক নেতাদের এক হাতে বিজয় নিশান অন্য হাতে শানিত কৃপাণ। সেই সুদূর আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বিশাল ভারতের গণতান্ত্রিক অঙ্গনের নরেন্দ্র মোদি আজ মিলেমিশে যেন একাকার। চিন্তাচেতনা মনন ও মননশীলতায় দারিদ্র্য, দুর্নীতি, বেকারত্ব তাদের কাছে প্রধান সমস্যা নয়। দুটি দেশই আজ পারমাণবিক অমিত শক্তির অধিকারী। মুহূর্তের মধ্যে পুরো বিশ্বকে তারা ভস্মীভূত করে দিতে পারেন। হিরোশিমা নাগাসাকির চেয়েও নির্মম আঘাত হানার শক্তি তারা রাখেন। যে পারমাণবিক শক্তির একটি আঘাত লাখ লাখ মানুষের জীবনপ্রদীপ শুধু নিমিষে নিভিয়েই দিতে পারে না, বরং তেজস্ক্রিয়তায় জন্ম-জন্মান্তর ধরে বিকলাঙ্গ করে বিশ্বে তার নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের আসুরিক শক্তির প্রচ- ও বিকৃত বীভৎসতার জানান দিতে পারে।

গণতন্ত্রের দুটি পাদপীঠ ভারত এবং আমেরিকা। একটি দেশ থেকে আরেকটি দেশ প্রচ- খরস্রোতা আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে যেতে হয়। দুটি দেশেই অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী গৌরবের স্মৃতি রয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য, মানবতার জন্য অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অসংখ্য মানুষের সীমাহীন ত্যাগের অবর্ণনীয় ক্লান্তিহীন সংগ্রামের বিস্তীর্ণ পথপরিক্রমণের ইতিহাস রয়েছে। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমণে জাগ্রত জনতাকে কোনো স্বৈরাচার, বর্ণবাদ বা সাম্প্রদায়িক কোনো অপশক্তি ক্লান্ত, পরাভূত বা পর্যুদস্ত করতে পারেনি। মহাত্মা গান্ধীর মতো বিশাল প্রাণকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে। অন্যদিকে জন এফ কেনেডি এবং মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো কালজয়ী মানবতাবাদী নেতার জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে কিন্তু তাদের প্রদীপ্ত আলোকপ্রবাহ কখনোই এতটুকু ম্লান হয়নি, এতটুকু ঔজ্জ্বল্য হারায়নি। যুগে-যুগে কালে-কালে দেশে-দেশান্তরে নগরে-বন্দরে অজপাড়াগাঁয়ে মানুষের চিত্তকে উদ্বেলিত করেছে, প্রজ্বলিত করেছে, উৎসাহিত করেছে মানবতার এই উচ্ছ্বসিত প্রাণতরঙ্গ। তাদের মানবতাবাদী চেতনা বিষাক্ত সর্পের ছোবলে বারবার জর্জরিত হয়েছে, বিষের যন্ত্রণায় ছটফট করেছে কিন্তু মৃত্যুবরণ করেনি। বরং অমোঘ অজেয় শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে সাফল্যের স্বর্ণগাথা এক অনবদ্য স্বরলিপি রচনা করে বিশ্বমানবতাকে অবিস্মরণীয় আলোকরশ্মিতে উদ্ভাসিত করেছে।

কিন্তু রাজনীতিতে বিশ্বজোড়া আজ একি দৈন্যদশা! ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যখন বিজয়ী হলেন তখন মানবতার পক্ষের সব শক্তি ভেবেছিল এটি একটি দৈব-দুর্ঘটনা মাত্র। এ বিজয় মানবতাকে বিধ্বস্ত করতে পারবে না। বরং গণতন্ত্রের শত্রু স্বৈরাচারের প্রেতাত্মাকে বধ করে মানবতার বিজয়কে চিরঞ্জীব করবে। সম্প্রতি ভারতে যে নির্বাচন হয়ে গেল সেখানে প্রচ-ভাবে ধর্মের নামাবলি গায়ে দেওয়া রাজনীতির যে বিস্ময়কর বিজয়ের কেতন নরেন্দ্র মোদি ওড়ালেন সেটি অবলোকন করে সমগ্র বিশ্ব আজ ম্লান মূক মুখে অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করছে আগামী দিনের রাজনীতিতে ধর্মান্ধতার প্রভাব, তার ব্যাপ্তি ও বিকাশ মানবতা, শান্তি ও সৌহার্দ্যকে কী প্রচ-ভাবে পরাভূত করবে নাকি এটা কেবলই সাময়িক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো কোনো ঘটনা। আমেরিকা সম্বন্ধে বলা যেতে পারে, সেখানে বর্ণবাদ বা রাজনীতিতে ধর্মীয় চেতনার প্রভাব একটা সাময়িক দুর্ঘটনা বা দুর্বিপাক ছাড়া কিছু নয়। সেখানে এই ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় আরোহণ দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারবে না। আমেরিকার প্রতিষ্ঠিত চারজন কালজয়ী নেতা (জর্জ ওয়াশিংটন, জন এডামস, থমাস জেফারসন, জেমস ম্যাডিসন-  আমেরিকার প্রথম চার প্রেসিডেন্ট) আমেরিকার রাজনীতিকে একটি দিগন্তবিস্তৃত মানবিক সত্তার ওপর প্রতিস্থাপিত তো করেছেনই, বরং সারাবিশ্বের মানবতার জন্য অসামান্য জ্যোতি ছড়িয়েছেন। জর্জ ওয়াশিংটন, জন এডামস, থমাস জেফারসন, জেমস ম্যাডিসন, বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন, জন জ্যাঁ, আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন-  এই সাতজন আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদার হিসেবে স্বীকৃত।

তাদের রাজনৈতিক চেতনা ও রাজনীতিতে উ™ভূত ঘাত-প্রতিঘাত সম্পর্কে দূরদর্শিতা প্রচন্ড প্রখর ছিল বলেই সংক্ষিপ্ত হলেও শাসনতান্ত্রিকভাবে তার সুরক্ষার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান ও ব্যবস্থা তারা করতে পেরেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত সব রাষ্ট্রের মধ্যে সম্প্রীতি ও রাজনৈতিকভাবে কার্যকর অটুট বন্ধন একটি আশ্চর্যজনক দৃঢ়তায় দীর্ঘকাল ধরে নিরবচ্ছিন্ন রয়েছে এবং বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো আশঙ্কা আজ আর বিদ্যমান নেই। ছোট হোক বড় হোক প্রতিটি রাষ্ট্রের দুজন করে সিনেটর এবং প্রতিটি রাষ্ট্রের জনভিত্তির ওপর জনপ্রতিনিধি (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ) নির্বাচিত হন এবং সিনেট ও জনপ্রতিনিধি পরিষদের সম্মিলিত বৈঠক প্রায় সব জাতীয় ইস্যুরই সুরাহা করেন। এ যৌথ বৈঠকটিকে কংগ্রেস বলা হয়। আরেকটি অদ্ভুত রাজনৈতিক ব্যবস্থার চর্চা সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে। জাতীয় ইস্যুতে ফ্লোর ক্রস করলেও, অর্থাৎ-  রিপাবলিকান কেউ ডেমোক্রেটদের বা ডেমোক্রেটদের কেউ রিপাবলিকানদের পক্ষে ভোট প্রদান করলে তাদের সদস্য পদ বিলুপ্ত হয় না। তবুও রাজনৈতিকভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত জরুরি অবস্থা ছাড়া ফ্লোর ক্রসিং হয় না বললেই চলে। কিন্তু কংগ্রেস, বিশেষ করে সিনেট অনুমোদন না দিলে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত কোনো বিল আইনে পরিণত হয় না। বরং  তিনবার    অ-অনুমোদিত হলে বিলটি বাতিল বা অগ্রাহ্য হয়ে যায়। যখন রাষ্ট্রপতি ডেমোক্র্যাট আর সংসদ রিপাবলিকানদের দখলে থাকে তখন যে কোনো জটিলতা রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা হয়। এটিই তাদের ঐতিহ্য বা স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি।

তারপরও কখনো গৃহযুদ্ধ বন্ধের জন্য, কখনো বর্ণবাদ, কখনো ক্রীতদাস প্রথা উচ্ছেদ ও তাদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের প্রাক্কালে আব্রাহাম লিংকন, জন এফ কেনেডি, মানবতাবাদী প্রাণপুরুষ মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো ব্যক্তিত্বদের আমেরিকার প্রশাসনিক ও সামাজিক জীবন থেকে সাদা-কালোর বৈষম্য দূরীকরণ করে একটি সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠার পথ বিনির্মাণে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে। কিন্তু সে আত্মত্যাগ এতটাই কালজয়ী ছিল যে, কালোরা শুধু ভোটাধিকার ও রাজনীতিতে সমঅধিকারই ভোগ করছেন না, কালো বংশো™ভূত বারাক ওবামা দু-দুবার নির্বিঘ্নে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে শুধু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিতই হননি, ডেমোক্র্যাটদের জাতীয় কাউন্সিলেও ঐতিহ্যমন্ডিত সাদা পরিবারের জাঁদরেল ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্রীয় উন্মুক্ত নির্বাচনে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। শুধু কি তাই, বারাক ওবামা নির্বাচনে জিতে হিলারি ক্লিনটনকে সেক্রেটারি অব স্টেট বানিয়েছিলেন এবং হিলারি ক্লিনটনও দু-দুবার আমেরিকার ফার্স্টলেডি হওয়া সত্ত্বেও সযতœ লালিত্যে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের প্রয়াস চালিয়েছেন এবং প্রচন্ড সফলতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন চলার আগে মনোনয়ন নিশ্চিত হলে বারাক ওবামার রানিংমেট, অর্থাৎ ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে হিলারি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু বারাক ওবামা সেই আগ্রহকে আমলে নেননি। হয়তো বা কেউ কেউ হিলারি ক্লিনটনকে উপ-রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিলে বারাক ওবামার ব্যক্তিত্ব কিছুটা ম্লান হওয়ার আশঙ্কা বোধ করেছিলেন। বারাক ওবামা তাই নিখুঁত কারিগরের মতো একজন কালো প্রার্থী হিসেবে নিজের বিজয়কে সগৌরবে সমুন্নত রাখতে চেয়েছিলেন এবং পেরেছিলেন।

ওই নির্বাচনটি বারাক ওবামাকে শুধু বিজয়ীই করেনি, আমেরিকার রাজনীতিতে সাদা-কালোর ব্যবধান ও বিভাজন শুধু কমিয়েই আনেনি, একটা স্বচ্ছ ও সৎ রাজনীতির বিজয় বর্ণবাদকে কতখানি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে পারে সেটি প্রতিস্থাপিত করেছে। ওবামার ওই বিজয় স্ট্যাচু অব লিবার্টির কাছাকাছি আরেকটি নতুন অদৃশ্য মনুমেন্ট রচনা করতে সক্ষম হয়েছে। পৃথিবীর রাজনীতি যখন প্রত্যয়দৃঢ় চিত্তে বর্ণবাদসহ সব আভিজাত্যবাদের কবর রচনা করে মানবতার বিজয় কেতন উড়িয়ে চলেছে, তখন ভারতের মতো বিশাল এবং দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত অবারিত গণতন্ত্রের দেশে মোদির হিন্দুত্ববাদের উত্থান অবলোকন করে শুধু বিস্মিত ও আশ্চর্যান্বিত হতে হয় তাই না, একটা প্রচন্ড হোঁচট খেতে হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার আবীরমাখানো বিশাল ভারতে রাজনীতির এ যেন একটা দৈন্যদশা। কোন জাদুর কাঠির স্পর্শে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে সাম্প্রদায়িকতার প্রতীক ও প্রতিভূ নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথদের ধর্মান্ধতার ম্যাজিক শুধু ভারতের রাজনীতিকেই নয়, বিশ্বকেও তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

ভারতবর্ষ না হিন্দুস্তান?-  ভারতের রাজনীতিতে এ প্রশ্নটির উদ্যোক্তা বিজেপি, যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও প্রকাশ্য উদ্যোক্তা হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি যে অচিন্ত্যনীয় সফলতা অর্জন করলেন তা তার সংগঠনেরই জাঁদরেল নেতা প্রয়াত বাজপেয়ীকে তো বটেই, জীবিত লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলি মনোহর যোশী, সুষমা স্বরাজ, যোগী আদিত্যনাথকেও বিস্ময়াভিভূত ও আশ্চর্যান্বিত করেছে। এ নির্বাচনে বিজেপি এককভাবে ৩০৩টি আসন পেয়েছে এবং তাদের জোট পেয়েছে ৩৫২টি আসন। ভিপি সিংয়ের আবির্ভাবের আগে ভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপির আসন ছিল মাত্র দুটি। সেখান থেকে এককভাবে সরকার গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের চমক দেখিয়ে নরেন্দ্র মোদি তার সংগঠনকে, ভারতবর্ষকে এমনকি গণতান্ত্রিক বিশ্বকেও হতবাক করেছে।

নরেন্দ্র মোদি টানা দুবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। অথচ এই মোদি গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উদ্যোক্তাই শুধু ছিলেন না, মুসলিম নিধনের নারকীয় যজ্ঞের সক্রিয় অংশীদার ছিলেন। ভারতে এখন দুটি স্পষ্ট ধারা। সেটি হলো-  ভারতবর্ষ না হিন্দুস্তান? বিগত নির্বাচনগুলোতে মোদির বক্তব্যে সুস্পষ্ট ছিল, ভারতকে হিন্দুস্তান হিসেবে ধর্মে-কর্মে আচার-অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত করার। এবারের নির্বাচনের ফলাফল তার সাম্প্রদায়িক চেতনার বিশাল বিজয়কে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ বিজয়ের অন্তর্নিহিত সত্য সাম্প্রদায়িকতা স্থায়ী না ক্ষণস্থায়ীÑ সে বিচার ভবিষ্যৎই করবে। এ নির্বাচনের প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদি সমগ্র ভারতের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় অসংখ্য বক্তৃতা করেছেন। যার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল-  ভারতবর্ষ মূলত হিন্দুস্তান। মুসলমানদেরকে তাদের চিন্তা-চেতনা ও মননশীলতায় অনেকটা ছাড় দিয়েই ভারতবর্ষে থাকতে হবে। মোদিকে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিভূ জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের মৃত্যুদন্ড হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী চিন্তা তাদের মতোই উগ্র ও পক্ষপাতদুষ্ট। এবারের নির্বাচনের ফলাফল যা হয়েছে তাতে ভারতের মুসলমানদের ইমান-আকিদা নিয়ে বসবাস করাই দুষ্কর হতো, যদি ভারত তার দীর্ঘ রাজনৈতিক পথপরিক্রমণের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্ম-নিরপেক্ষ রাজনীতির আবহ সৃষ্টিতে সক্ষম না হতো। যদিও বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে লোকসভার ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টিতে বিজয়ী হয়েছে, তবুও মমতা ব্যানার্জি অকুতোভয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন যে, পশ্চিমবঙ্গকে গুজরাট হতে দেব না। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির প্রবাহ মমতা ব্যানার্জিকে বজ্রনিনাদে এ ঘোষণা দিতে উজ্জীবিত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক ভোটার সংখ্যায় শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ মুসলমান। সেখানে মোদির ১৮টি আসন প্রাপ্তি অভাবনীয়। তাহলে কি ভারতবর্ষের এবারের নির্বাচনে ইভিএম-এর মাধ্যমে ডিজিটাল কারচুপি হয়েছে? আরেকটি প্রশ্ন সবার মনে, ভারতের রাজনীতিতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে কট্টর বামরা কি বাম রাজনীতি পরিহার করে সরাসরি বিজেপিতে ঢুকে পড়েছেন? ভারতের মতো বিশাল বিস্তীর্ণ এবং ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দেশে আদর্শের এ ভয়াবহ স্খলন বিশ্বমানবতাকে মারাত্মকভাবে শঙ্কিত করে তুলেছে।  

রাজনীতিতে শঠতা, চতুরতা ও ভন্ডামিতে নরেন্দ্র মোদির দক্ষতা সারাবিশ্বের কাছে আজকে প্রতিভাত। তিনি গান্ধীর মরণোত্তর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান যেখানে হয়েছিল, সেখানে গান্ধীর তিরোধান দিবসে কৃত্রিম শ্রদ্ধা প্রকাশে নরেন্দ্র মোদি কখনোই ভুল করেন না। গান্ধীর প্রয়াণ দিবস অনেকটাই যেন তার অন্তরের আত্মশুচির কর্মসূচি। হিন্দু মহাসভার সক্রিয় সদস্য নথুরাম গডসে মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করে। আর কৌতূহলের বিষয় হলো, নরেন্দ্র মোদি গান্ধীঘাটে তর্পণ শেষে ছুটে এসে নথুরাম গডসের প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্যে ওই গঙ্গাজল আর নানান পুষ্প-পল্লবে গান্ধীর হত্যাকারী নথুরাম গডসেকে অর্চনা প্রদান করেন। নরেন্দ্র মোদির এটা প্রতিবছরের নিয়মিত অর্চনা হলেও সারাবিশ্বের রাজনীতিতে এর কোনো দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। মোদির এ স্ববিরোধী আচরণ বিশ্বকে স্তম্ভিত করলেও ভারতবাসীকে হয়তো বিচলিত ও আশ্চর্যান্বিত করে না। অন্তত এবারের নির্বাচনের ফলাফল তাই প্রমাণ করে। রাজনীতিতে এ দ্বিমুখী নীতি ও শঠতা ঐতিহ্যমন্ডিত ভারতের রাজনৈতিক মনন ও সংস্কৃতিকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সিপিএম ও তৃণমূলই পাল্টাপাল্টিভাবে ক্ষমতায় ছিল। সেখানে বিজেপির ১৮টি আসন প্রাপ্তি হতবাক করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব করেছে। এটা সত্য, ক্ষমতায় এসে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটা হিংসাত্মক দানবীয় শক্তি হিসেবে নিজেদের জাহির করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়াও দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও বেকারত্ব মানুষের ক্ষোভের উপাদান সৃষ্টি করেছে। একজন বিজ্ঞ স্ট্যাটস্ম্যান হিসেবে নয়, বরং মিছিলের অনবদ্য স্রোত থেকেই মমতা ব্যানার্জির আবির্ভাব। ক্ষমতায় এসে দুর্বিষহ সন্ত্রাস ও দুর্নীতির প্রচন্ড প্রবাহকে তিনি কেন প্রশ্রয় প্রদান করলেন তা অনুধাবন করা দুষ্কর। এ দুর্নীতির পালের গোদা তার আপন ভ্রাতুষ্পুত্র। যার সম্পদ মুকেশ আম্বানি, টাটা, গোয়েঙ্কাদের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের লোকের ধারণা এই দুর্নীতিলব্ধ বিশাল সম্পদের মালিকানা মূলত মমতা ব্যানার্জির। মমতা ব্যানার্জি চিরকুমারী বিধায় নিঃসন্তানও। জীবনযাপন করেন নিতান্তই সাদামাটা। অর্থলিপ্সা তো তার থাকার কথা নয়। অথচ দুর্নীতি ও সন্ত্রাসই আজ তৃণমূলের প্রধান বাহন। যেহেতু অন্য কোনো রাজনৈতিক শক্তি দুর্দমনীয় তৃণমূলকে আটকাতে পারছে না, তাই আসুরিক শক্তি বিজেপির আশ্রয় চাইছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। তাইতো তিল তিল করে গড়ে ওঠা তৃণমূলের হিমাচলের মতো জনপ্রিয়তায় এই বিশাল ধস নেমেছে। তাই মমতা ব্যানার্জিকেই এ ধস ঠেকানোর আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গণতন্ত্রে সহনশীলতার কোনো বিকল্প নেই। মমতা ব্যানার্জির পক্ষে সন্ত্রাস ও আসুরিক পথ বিসর্জন দিয়ে সহনশীলতার পথ ধরে একটা স্থায়ী ও স্থিতিশীল রাজনীতির পথ বিনির্মাণ সম্ভব। নইলে অসাম্প্রদায়িক পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অপশক্তির উত্থান ঠেকানো সম্ভব হবে না। মমতা ব্যানার্জি যত শিগগিরই এই বাস্তব সত্যটি অনুধাবন করবেন, শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, সারা ভারতবর্ষের সংকট নিরসন তত ত্বরান্বিত হবে।

ভারতে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার বা প্রভাবক হয়ে ওঠার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে বলে অনেকে মনে করছেন। এ আশঙ্কাটি একেবারেই অমূলক নয়।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর