সোমবার, ১৭ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাজেট : লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে

অধ্যাপক ড. মো. সেলিম উদ্দিন

বাজেট : লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে

তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য যে প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করা হয়েছে তা নির্বাচনী ইশতেহারকে সামনে রেখেই প্রণয়ন করা হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষ বছরের এই বাজেটে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর, উন্নয়নশীল দেশের পথে উত্তরণ, এসডিজি বাস্তবায়ন, রোহিঙ্গা ইস্যু, বদ্বীপ পরিকল্পনা ২০১০, রূপকল্প-২০৪১, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পরিকল্পনা, ডিজিটাল বাংলাদেশ, ডিজিটাল অর্থনীতি, ৪র্থ শিল্প বিপ্লব, সব শ্রেণির ও পেশার মানুষকে মনোযোগ ও গুরুত্ব, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি কৌশলগুলোকে সামনে রাখা হয়েছে। শস্যবীমা, উদ্যোক্তা সৃষ্টি, বিনিয়োগ প্রণোদনা, প্রবাসী আয় আকর্ষণ, সামাজিক সুরক্ষা প্রয়াস বৃদ্ধি, ব্যাংক ও পুঁজি বাজারের সংস্কারের অঙ্গীকার, নতুন এমপিওভুক্তি ইত্যাদি বিষয়গুলো এ বাজেটকে কিছুটা নতুনত্ব দিয়েছে। কোনো ধরনের তাৎপর্যপূর্ণ নতুন করারোপ ছাড়াই এই বিশাল এবং উচ্চাভিলাষী বাজেট যদি আগামী ছয় মাসে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয়ের কমপক্ষে ৩৫ শতাংশ সঠিক অর্থে ও মানসম্মতভাবে বাস্তবায়িত হলে সামগ্রিম চাহিদা বৃদ্ধি, অবকাঠামো ঘাটতি হ্রাস এবং দারিদ্র্যবান্ধব, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বিধানমূলক ব্যয় ইত্যাদির মাধ্যমে প্রস্তাবিত বাজেট সার্বিক জনকল্যাণে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে। মোদ্দা কথা, প্রস্তাবিত বাজেটের সাফল্য অনেকাংশ নির্ভর করবে সারা বছরের আর্থিক কর্মকা-গুলো মাসিক কিংবা ত্রৈমাসিকের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে গুণগত ও পরিমাণগত বৈশিষ্ট্যের আলোকে মানসম্মত বাজেট বাস্তবায়নের ওপর। কেননা বিগত বছরগুলোতে বাজেট অবাস্তবায়নের হার প্রায় ১০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৯ শতাংশ পৌঁছেছে। এ বাজেটে সবচেয়ে ভালো দিক হলোÑ চলতি বছরের বাজেটের তুলনায় ২০১৯-২০ বাজেটের মোট ব্যয়, মোট রাজস্ব এবং এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর রাজস্বের প্রবৃদ্ধি সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং জবাবদিহিতায় আন্তরিক হলে বাস্তবায়নের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। বিগত দুই বছর এবং চলতি বছরে জিডিপি যথাক্রমে ৭.২৮, ৭.৮৬ এবং ৮.১৩ শতাংশ অর্জন এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার আলোকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৮.২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। বাজেট ২০১৯-২০ এ মোট ব্যয় প্রাক্কলন হয়েছে ৫, লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা যেটি সংশোধিত ২০১৮-১৯ এর বাজেটের ৮০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা বা ১৮.২ শতাংশ বেশি। একইভাবে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা যেটি সংশোধিত ২০১৮-১৯ অর্থসাল থেকে ৬১ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা বা ১৯.৩২ শতাংশ বেশি। বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আহরণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাক্কলিত অর্থ সংগ্রহ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রস্তাবিত বাজেট জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বিধানমূলক কর্মসূচি এবং কর সহনীয়করণসহ প্রবৃদ্ধি সঞ্চারি মেগা প্রকল্পগুলো এবং স্থবির বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির নানা কলাকৌশলকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। বাংলাদেশের অপার উন্নয়ন সম্ভাবনা, জনগণের  ভোগ ও চাহিদার ক্রমোন্নতি, বর্তমান অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচকের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে বলা যায় যে, বাজেটের আকার রক্ষণশীল না হওয়াই ভালো। অনেকে মনে করেন যে, বড় আকারের বাজেটে অর্থের অপচয় ও অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমি বলব অর্থ বরাদ্দে উদারতা থাকা ভালো। তবে অর্থ ব্যবহারে যথেষ্ট সতর্ক থাকা এবং অর্থ অপব্যবহার বা অপচয় রোধে সতর্কতা অবলম্বন করলে এই বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব। বাজেটের বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে বাজেট বক্তৃতায় সুনির্দিষ্ট অনেক প্রস্তাবনা এসেছে। প্রস্তাবনাগুলো সঠিক সময়ে বাস্তবায়িত হলে এ বিশাল আকারের বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। মুদ্রাস্ফীতি ৫.৫ শতাংশে রাখা, মধ্যমেয়াদি নীতি-কৌশল কঠোরভাবে পরিপালনসহ কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, রপ্তানি খাত, আবাসন খাত ও সেবা খাতকে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে নেওয়ার অঙ্গীকার রয়েছে বাজেটে। দারিদ্র্য নিরসন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট এবং আয় বৈষম্য নিয়ন্ত্রণের সবিশেষ উদ্যোগের কথা বাজেটে গুরুত্ব পেয়েছে। বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে যেটি মানব সম্পদ উন্নয়নে ও গুণগত শিক্ষার ক্ষেত্রে এমপিওভুক্তির দীর্ঘদিনের ন্যায্য দাবি পূরণ হবে। এ ছাড়া পরিবহন ও যোগাযোগ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নসহ স্বাস্থ্য, কৃষি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ইত্যাদি খাতগুলোকে বিগত কয়েক বছরের ন্যায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় শিল্পের সংরক্ষণ এবং রপ্তানি খাতকে প্রণোদনা দেওয়ার চেষ্টা ও রাজস্ব আদায়ে বিভিন্ন উদ্যোগসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক দিকগুলোকে বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তি খাত ও সরকারি খাতে অব্যাহত বিনিয়োগ প্রসঙ্গ বাজেটে গুরুত্ব পেয়েছে যেটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা, পল্লী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আর্থিক খাতের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। নতুন প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে কৃষকদের জন্য শস্যবীমা, উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে যুবক বেকারদের জন্য ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন, প্রবাসীদের জন্য ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা ও বীমা সুবিধা, নদীভাঙনের ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য তহবিল গঠন, সামাজিক সুরক্ষায় অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তকরণ, নতুন এমপিওভুক্তির মাধ্যমে শিক্ষায় গতিশীলতা সৃষ্টির প্রয়াস, অটিস্টিকসহ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নাগরিককে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের জন্য প্রণোদনা, তৈরি পেশাাক রপ্তানিতে ১ শতাংশ হারে প্রণোদনা, গবেষণা উন্নয়ন খাতে অতিরিক্ত ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ, দারিদ্র্য বিমোচনে সুদমুক্ত ক্ষুদ্র ঋণসহ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা হাইটেক পার্কে বিনিয়োগে কর প্রণোদন এবং ভৌত অবকাঠামো খাতে শিল্পায়নের জন্য ১০ বছর কর অবকাশ উল্লেখযোগ্য। প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে সামষ্টিক অর্থনীতির দুর্বলতা, অসঙ্গতি, প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতি নজর থাকা দরকার। উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বর্তমান বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়। সক্ষমতার অভাবে এডিপি বাস্তবায়ন পুরোপুরি না হওয়ায় সরকারি বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে না। নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ গত কয়েক বছর ধরে                       ২১-২২-২৩ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধির জন্য এই হার জিডিপির ২৬-২৭ শতাংশে উন্নীত করা দরকার।

লেখক : অধ্যাপক, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর