শুক্রবার, ২১ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

অন্যরকম ভালোবাসা!

মেজর নাসির উদ্দিন আহম্মেদ (অব.) পিএইচডি

অন্যরকম ভালোবাসা!

‘জেনি, আমি তোমাকে ভালোবাসি মেয়ে’- ৯৭ বছর বয়সী প্রেমিক রবিনস ৭৫ বছর পর তার ৯২ বছর বয়সী প্রেমিকা জেনিকে ঠিক এভাবেই বললেন তার ভালোবাসার কথা। বিষয়টা কোনো নাটক বা সিনেমা নয়, বাস্তবে ঘটেছে ফ্রান্সের একটি বৃদ্ধাশ্রমে।

ঘটনার সূত্রপাত সেই ১৯৪৪ সালে। জার্মানির একগুঁয়ে শাসক ও স্বৈরাচার অ্যাডলফ হিটলার তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে লড়ছেন মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে। এরই এক পর্যায়ে পাশের দেশ ফ্রান্স দখল করে পৌঁছে যায় ইংলিশ চ্যানেল পর্যন্ত। ইংলিশ চ্যানেল-ঘেঁষা উপকূলীয় এলাকা নরম্যান্ডি। এই নরম্যান্ডির অনতিদূরে ব্রিই এলাকায় থাকতেন সেদিনের অষ্টাদশী ফ্রান্স-সুন্দরী জেনি গানাইয়ে। নরম্যান্ডি থেকে ইংলিশ চ্যানেলের ওপারের ইংল্যান্ড দেখা যায়, যার প্রস্থ এলাকাভেদে ৬ থেকে ২৪০ কিলোমিটার। বাংলার সাঁতারু ব্রজেন দাস কয়েকবার সাঁতার কেটে পাড়ি দিয়েছিলেন এই চ্যানেল। চ্যানেলের ওপারে ইংল্যান্ড ভূখন্ডে তখন বিভিন্ন দেশের সেনা প্রস্তুতি নিচ্ছিল নরম্যান্ডিতে অবতরণ ও ফ্রান্স থেকে জার্মানদের বিতাড়িত করার জন্য। এই সেনাদেরই একজন ছিলেন কে টি রবিনস।

১৯৪৪ সালের ৬ জুন পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ সামরিক অভিযান শুরু হয় মিত্রবাহিনীর নরম্যান্ডিতে অবতরণ এবং জার্মানদের দুর্ধর্ষ ট্যাংক বাহিনী ‘প্যাঞ্জার’দের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। শত শত জাহাজ আর জল ও স্থলে চলার মতো ট্যাংক নিয়ে মিত্রবাহিনীর ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার সৈন্য ঢুকে পড়ে জার্মানদের প্রতিরক্ষা দুর্গ নরম্যান্ডিতে। আকাশ থেকে হাজার হাজার ছত্রী সেনা ও গ্লাইডারও নেমে পড়ে। উভয় পক্ষে তখন তুমুল যুদ্ধ; মৃত্যুর বিভীষিকা। ক্রমেই কোণঠাসা হতে থাকে জার্মানরা। আর মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এগোতে থাকে মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা। এদেরই একজন সেদিনের ২৪ বছর বয়সী আমেরিকান সৈনিক কে টি রবিনস। জার্মানরা সরে গেলে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে আমেরিকান শিবিরে ক্লান্ত-শ্রান্ত সৈনিক কে টি রবিনস তখন ফ্রান্সের স্থানীয় কাউকে খুঁজছিলেন পরনের ইউনিফর্ম ও অন্যান্য কাপড় ধোয়ার জন্য। তখনই দেখা হয় ফ্রান্স-সুন্দরী জেনির (১৮) সঙ্গে। প্রথম দেখাতেই দুজন দুজনার প্রেমে পড়ে যান। এরপর স্বপ্নের মতো কেটে যায় দুই মাস। আর ঠিক দুই মাসের মাথায় কে টি রবিনসসহ আমেরিকার সেনাদের আবারও সম্মুখযুদ্ধে এগিয়ে যেতে হয়। বলতে গিয়ে গলার স্বর বের না হলেও জেনিকে রবিনস বলতে বাধ্য হন যে, দ্রুতই সেসহ সব আমেরিকান সেনাকে আরও পূর্বে এগিয়ে যেতে হবে জার্মানদের চিরতরে ফ্রান্স থেকে বিতাড়নের জন্য। যাওয়ার সময় জেনির চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে রবিনস বলে গেলেন আমি ফিরে আসব জেনি, তোমাকে নিয়ে যাব। সহযোদ্ধাদের তাড়া খেয়ে রবিনস উঠে পড়ল সামরিক ট্রাকে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল ট্রাক, রেখে গেল জেনির চোখের জল। মনে মনে প্রার্থনা করল রবিনস- যেন যুদ্ধের পর আমেরিকায় ফিরে না যায়। আবারও ফিরে আসে জেনির কাছে। জেনি ভালো ইংরেজি জানত না। মনের অনেক কথাই তাই বলা হয়নি রবিনসকে। ভালোবাসার না বলা কথাগুলো বলার জন্য ইংরেজি শিখতে শুরু করল জেনি। খুব ইচ্ছা ছিল রবিনসের গলা জড়িয়ে চিৎকার করে ইংরেজিতেই বলবে, ‘আই অ্যাম ইউরস, আই লাভ ইউ রবিনস।’ কিন্তু সেই সৌভাগ্য হয়নি এই প্রেমিক যুগলের। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষে আমেরিকায় ফিরে যান রবিনস। জীবনের প্রয়োজনে আমেরিকান পাত্রী লিলিয়ানকে বিয়ে করেন। দীর্ঘদিন সংসার করার পর ২০১৫ সালে ৭০ বছর বয়সে মারা যান লিলিয়ান। আবারও নিঃসঙ্গতা নেমে আসে রবিনসের জীবনে। অন্যদিকে জেনি বিয়ে করেছিলেন পিয়ারসন্সকে। তাদের সংসারে জন্ম নেয় পাঁচটি সন্তান। একসময় পৃথিবী থেকে বিদায় নেন স্বামী পিয়ারসন্স। সব শূন্যতা বুকে আগলে বেঁচে থাকেন জেনি। এরই মধ্যে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বৃদ্ধাশ্রম বা রিচারমেন্ট হোমে ঠাঁই নেন জেনি। দুটি দেশের দুই প্রান্তে একাকী দিন কাটানোর মধ্যে রবিনস আর জেনির মাঝে বার বার ফিরে আসে সেই প্রথম প্রেমের স্মৃতি।

নরম্যান্ডি লেন্ডিংয়ের প্রথম দিনটি ছিল ৬ জুন, ১৯৪৪ সাল। ডি ডে নামে এই দিনটি বেশি পরিচিত। এ বছর ৭৫তম ডি ডে উপলক্ষে সেদিনের সৈনিকদের শ্রদ্ধা জানাতে ভুল করেনি মিত্রশক্তি তথা ইউরোপবাসী। সংগত কারণেই ফ্রান্সের কৃতজ্ঞতা ছিল বেশি। এই ফ্রান্সেরই ‘ফ্রান্স-২’ নামের একটি মিডিয়া গ্রুপ (ব্রডকাস্টার) উদ্যোগ নেয় ১৯৪৪ সালের যুদ্ধে অংশ নেওয়া আমেরিকান সৈন্যদের সাক্ষাৎকার ধারণ ও ডকুমেন্টারি তৈরি করার; বিশেষত সেই সেনাদের যারা ৭৫ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান উপলক্ষে ফ্রান্সে যাবে। সেই সূত্রে তাদের আলাপ রবিনসের সঙ্গে। প্রথামাফিক কথা বলার পর রবিনস ৭৫ বছর আগের একটা সাদা কালো ছবি বের করেন, যা ছিল সেই অষ্টাদশী ফরাসি-সুন্দরী জেনির। জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই পার হলেও এক শতাব্দীর তিন চতুর্থাংশ (৭৫ বছর) এই ছবি আগলে রেখেছিলেন রবিনস। মিডিয়া কর্মীরা বিস্মিত হয়েছিলেন রবিনসের এই লুকানো ভালোবাসা দেখে। এরপর রবিনস এ বছর জুনের প্রথম সপ্তাহে ফ্রান্সে আসেন ডি ডের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এখানে সেই ফরাসি মিডিয়া কর্মীরা রবিনসকে বিস্মিত আর বাকরুদ্ধ করে জানালেন তার লুকানো ভালোবাসার জেনি (৯২) বেঁচে আছেন এবং তার সঙ্গে দেখা করতে চান। এরপর রবিনসকে নিয়ে যাওয়া হয় জেনির বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে ৭৫ বছর অপেক্ষার পর দেখা মেলে দুজনার। তারা জড়িয়ে ধরেন একে অন্যকে। আবেগে চুমো খান, রবিনসের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে প্রেমের সেই শাশ্বত বাণী- আমি সব সময় তোমায় ভালোবেসেছি জেনি। তুমি কখনো আমার হৃদয়ের বাইরে ছিলে না। এই বলে রবিনস জেনিকে দেখালেন ৭৫ বছর আগের সেই সাদাকালো ছবি। খুব একটা ইংরেজি বোঝেন না জেনি। ছবি দেখে প্রত্যুত্তরে শুধু একটি শব্দই বললেন- এয়াও; যার সম্ভবত কোনো অনুবাদ হয় না, কেবল উপলব্ধি করতে হয়। জেনিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, রবিনস কী বলেছেন তাকে। মিষ্টি হেসে জেনি বললেন, আমি শুধু এতটুকু বুঝেছি যে, ও আমাকে ভালোবাসে। কয়েক ঘণ্টা একত্রে কাটানোর পর ডি ডের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নরম্যান্ডি যেতে বাধ্য হন রবিনস। চোখে জল নিয়ে লাঠিতে ভর করে রবিনসকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেন জেনি। জড়িয়ে ধরে দুজনে প্রতিজ্ঞা করলেন-  আবারও তাদের দেখা হবে। যাওয়ার আগে রবিনস বলে গেলেন ‘জেনি, আমি তোমাকে ভালোবাসি মেয়ে’- এরই নাম হয়তো লুকানো ভালোবাসা।

                লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর