বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

হিন্দু রাষ্ট্র কায়েম করতে চাচ্ছেন মোদি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

হিন্দু রাষ্ট্র কায়েম করতে চাচ্ছেন মোদি

বিশ্বের যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র আছে সেখানে সরকার গঠন করতে জনগণই শেষ কথা বলে বিবেচিত আর এটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি। ভারতের সংসদীয় নির্বাচনে এই ধারাই অব্যাহত ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের রায় এটাই। তবে বিগত নির্বাচন কোনো একটি দলের নামে হয়নি। হয়েছে মাত্র একজনের নামে। গণতন্ত্রের পক্ষে এটা মারাত্মক ঘটনা বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। মোদির প্রচারে ছিল এক ধরনের অহমিকা ও একনায়কতন্ত্রের দিকে ঝোঁক। তিনি প্রচারে বলতেন, ‘আপনাদের এক একটি ভোট মোদি খাতামে জায়গা’। তার প্রচারে ছিল ষোলোআনা ধর্মীয় মেরুকরণ। তবুও এ কথা মানতেই হবে শেষ হাসি হেসেছেন গুজরাটের নরেন্দ্র ভাই দামোদর দাস মোদি।

মোদির প্রচারে ১ নম্বরে ছিল ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদ, বালাকোট, পুলওয়ামা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। কার্যত তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভয় দেখিয়ে ভোট আদায় করে নিয়েছেন। এবারে ভারতের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ২৬ মে অর্থনীতিবিদ নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। তার প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, মোদি ক্ষমতা পুনরায় দখল করেছেন কিন্তু তার নেপথ্যে কোনো আদর্শ ছিল না। ড. অমর্ত্য সেন আরও লিখেছেন, মোদি জমানায় ভারত থেকে বহুত্ববাদ উঠে যেতে বসেছে। ধর্মনিরপেক্ষবাদ প্রায় তুলে দেওয়ার মুখে। এদেশে স্বাধীনতার আগে থেকে এবং কংগ্রেস শাসনকালে মূল আদর্শ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। নোবেল বিজয়ী আরও লিখেছেন জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জহরলাল নেহেরু ও মৌলানা আবুল কালাম আজাদ বুঝিয়েছিলেন জাতপাতের ঊর্ধ্বে ওঠে দেশ গঠন করতে হবে। অমর্ত্য সেন লিখেছেন, ভারতের মোট জনসংখ্যার ২০০ মিলিয়ন যারা জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু এবং মুসলিম। তিনি কটাক্ষ করে বলেছেন মোদি হলেন ভালো বক্তা। তিনি সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় মনোভাবকে শুধু উপেক্ষাই করেননি তিনি ভোটের প্রচারে তাদের অবজ্ঞাও করেছেন। তার ভোট মিটে যেতেই সংখ্যালঘুদের কাছে তুলে নেওয়ার জন্য তার পুরনো সেøাগান, সবকা সাথ, সবকা ঠিকানা, সবকা বিশ্বাস। অপরদিকে দর্শনবিদ অরিন্দম চক্রবর্তী সম্প্রতি লিখেছেন- স্বার্থসন্ধানী, অকল্যাণকামী কথাকে সত্য অর্থে শব্দ বলা চলে না। এনডিএর নবনির্বাচিত সদস্যদের সামনে তিনি বলেছেন, সবার সঙ্গে থেকে, সবার উন্নয়নের জন্য কাজ করার পাশাপাশি আর একটি কর্তব্য পালন করতে হবেÑ সবার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস অর্জন যেন নতুন পর্বের অন্যতম লক্ষ্য হয়। প্রধানমন্ত্রীর উক্তিকে অকল্যাণকামী বলার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কথাটি স্বার্থসন্ধানী কিনা তা নিয়ে অবশ্য দ্বিমত থাকতে পারে। কেউ বলতে পারেন, সংখ্যালঘু বিদ্বেষের অভিযোগে কলঙ্কিত ভাবমূর্তি কাটাতেই এমন উক্তি। বিপুল নির্বাচনী সাফল্যের পরেও প্রধানমন্ত্রীর আসনে পুনরোধিষ্ঠিত হওয়ার সময় দেশের ও দুনিয়ার কাছে ‘ভালো সাজার’ কৌশলমাত্র। এই সংশয়কে ছিদ্রান্বেষীর কুবাক্য বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। অভিযোগ অহেতুক নয়, কলঙ্কও নতুন নয় এবং নির্বাচনের প্রচার পর্বেও সপারিষদ প্রধানমন্ত্রীর কথায় ও কাজে অন্ধকার গাঢ়তর হয়েছে। তার ভক্তরাও নিশ্চয় জানেন, বিদেশি পত্রিকার প্রচ্ছদ নিবন্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে বিভাজনের নায়ক- অভিধা মুদ্রিত হলে দেশের গৌরব বাড়ে না। এসব সমালোচনা যদি তাকে সংখ্যালঘুর বিশ্বাস অর্জনের আহ্বান ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ করে থাকে তবে বুঝতে হবে, আন্তর্জাতিক সমালোচনা এমনকি এই ভারতেও নিষ্ফল নয়।

মোদি আগামী পাঁচ বছরের জন্য দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। তার আগেই হিন্দুত্ববাদের ও হিন্দু রাষ্ট্র কায়েম করার দাবি আরএসএস থেকে তোলা হয়েছে। আরএসএস প্রধান মোহন ভগবত নাগপুর থেকে ফতোয়া জারি করে বলেছেন, শীর্ষ আদালতের রায়ের জন্য আর অপেক্ষা করা চলবে না। সংসদের প্রথম দিনের অধিবেশনেই সরকারকে রামমন্দির তৈরির কথা ঘোষণা করতে হবে। এবারে ৫৪২ জন সদস্যের সংসদে যারা নির্বাচিত হয়ে এসেছেন তার মধ্যে ২১৬ জনের বিরুদ্ধে (বেশিরভাগ বিজেপি) মারাত্মক অপরাধ (ঈৎরসরহধষ ড়ভভবহপব) মামলা চলছে। একাধিক বিজেপি নেতা দাবি তুলেছেন আর কালবিলম্ব না করে অবিলম্বে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হোক। এই গেরুয়া বাহিনীর অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত সংসদ সদস্যরা বোঝেন না ভারতের গেরুয়া বাহিনী শত চেষ্টা করলেও সংবিধানকে পরিবর্তন করে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করা কখনই সম্ভব নয়। আর বিশ্বের কোনো দেশই তা সমর্থন করবে না। এমনকি ইসলামিক দেশগুলোও করবে না। আর এদের নেপথ্যে উসকানি দিয়েছে নাগপুর। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পারসোনাল ল’ বোর্ডের চেয়ারম্যান মুহম্মদ ওয়াসিম ওই দাবিদারদের উদ্দেশে বলেছেন, সাহস থাকলে মোদি সরকার করে দেখাক। গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী সবাই এই বিশাল ভারতবর্ষকে জাতপাতের ধর্মে বিভক্ত করেননি। যতবারই এর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ততবারই মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ও জহরলালের সঙ্গে নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়ে তা আটকে দিয়েছেন।

মোদির এই ভারতের নির্বাচনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ যোগেন্দ্র যাদব দাবি তুলেছিল ভারতের সব নাগরিকের প্রতি আস্থা অর্জনের জন্য যদি সত্যি মনেপ্রাণে চান তবে তা ভারতবাসীকে জানান। গত পাঁচ বছরে এ দেশের মানুষের জন্য তিনি যেসব কাজ করেছেন তা জানিয়ে যিরঃব ঢ়ধঢ়বৎ বের করুন। অপরদিকে মহারাষ্ট্রের সাংবাদিক এবং অটল বিহারি বাজপেয়ির উপদেষ্টা সুধীন্দ্র কুলকার্ণি মনে করেন, মোদির সামনে বর্তমানের চ্যালেঞ্জ হলো- ১. প্রবৃদ্ধির হার চাঙ্গা করা, তার হাত ধরে কাজের সুযোগ তৈরি, ২. কৃষির দুর্দশা কাটাতে তার আমূল সংস্কার। জোর আর্থিক সংস্কারেও, ৩. চাষিদের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার ব্যবস্থা, গ্রামে মজুরির অঙ্ক বৃদ্ধির দিকে নজর, ৪. জোর কারখানায় উৎপাদন, পরিকাঠামো উন্নয়ন, ৫. বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে বেসরকারি লগ্নি বৃদ্ধির বন্দোবস্ত, ৬. অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হয়তো বাড়বে সরকারি বিনিয়োগ। সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের খরচ। তবু মাত্রাছাড়া হলে চলবে না। রাজকোষ ঘাটতি, ৭. রিজার্ভ ব্যাংক, এনএসএমও, কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দফতরের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজে নাক না গলানো। বরং তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি ও ৮. অনুৎপাদক সম্পদে রাশ টেনে ব্যাংকিং ক্ষেত্রের সংস্কার। অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদদের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। যখনই প্রশ্ন উঠত সমস্যার সমাধানের তখনই গেরুয়া বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়বে মেরুকরণের দিকে। আগামী পাঁচ বছরে বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের কথা বা দাবি বিরোধীরা তুলবে আর তখনই এগিয়ে আসবে হিন্দু রাষ্ট্রের কথা। এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেক শিল্পপতিও। নরেন্দ্র মোদিকে ক্ষমতা ফিরে আসতেই হবে গোয়েঙ্কা টুইট করে বলেছেন আগামী পাঁচ বছরে কাজের সুযোগ তৈরি, কৃষিতে সংস্কার, কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি ও পরিকাঠামো উন্নয়নের মতো বিষয়ে জোর দিতে হবে কেন্দ্রকে। বাড়াতে হবে রিজার্ভ ব্যাংক, এনএসএসওর মতো প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা। নাক গলানো চলবে না তাদের কাজে। মোটের ওপর শুরু থেকেই পাখির চোখ করতে হবে অর্থনীতিকে। তার সঙ্গে একমত অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ বিশেষজ্ঞ। তাঁদের মতেও, জোট ময়দানে কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী মোদিকে অর্থনীতির ছবি ঝাঁ চকচক করে হাঁটতে হবে ভারসাম্যের সরু সুতোয়, কাজের সুযোগ তৈরির জন্য বৃদ্ধির গতি বাড়াতে হবে। ঘাটতিকে আগাগোড়া লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে বেঁধে রেখে। সঙ্গে থাকছে সংস্কারের গতি বৃদ্ধির আশা।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং কম কথা বলার লোক। তিনি মোদির সাফল্য কামনা করে বলেছেন, ১২ লাখ কোটি টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে নতুন সরকার কীভাবে দেশের আর্থিক অগ্রগতি করবে তা নিয়ে দেশের অন্যান্য অর্থনীতিবিদও উদ্বিগ্ন। এই অগ্রগতিকে চাপা দেওয়ার জন্য বিজেপি সরকার কি আবার হিন্দুত্ববাদের জিহাদ ঘোষণা করবে। এ চিন্তা দেশবাসীরও।

                লেখক : ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর