রবিবার, ৩০ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

সুচিত্রা বললেন, বিশ্বাস করুন অভিনয় করিনি

নঈম নিজাম

সুচিত্রা বললেন, বিশ্বাস করুন অভিনয় করিনি

আমি কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে উঠছি। পুরনো দিনগুলো মাঝেমধ্যে আমাদের সবার মাঝেই জ্বলে ওঠে দুঃখকষ্টের সঙ্গী হিসেবে। অনেক দিন আগে সুচিত্রা সেনের ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিটি দেখেছিলাম। এত বছর পরও একটি ডায়ালগ দাগ কেটে আছে। এ ছবির একটি গান ছিল- ‘এই রাত তোমার আমার... শুধু দুইজনে...’। এ ছবিতে সুচিত্রা সেন ছিলেন নার্স। নাম রাধা। হাসপাতালের বড় ডাক্তার মানসিক রোগীদের নিয়ে গবেষণা করতেন। তার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল ভালোবাসা দিয়ে রোগীকে ভালো করে তোলা। এ কারণে নার্স রাধাকে প্রতিনিয়ত রোগীদের সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করতে হতো। এভাবে অভিনয় করতে করতে ক্লান্তি চেপে বসত রাধার। কিন্তু কিছুই বলার ছিল না। ডাক্তারকে বলতে গেলে তিনি বলতেন, মানুষের জন্য সেবা হিসেবে সবকিছু বেছে নাও। আবেগ দেখাবে, হৃদয়ে ঠাঁই দেওয়া যাবে না। কারণ, সবকিছু তোমার কাজ ও দায়িত্ব। আর এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আবেগকে ঠাঁই দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই একদিন রোগী দেবাশিস চলে যাওয়ার পর সুচিত্রা অশ্রুচোখে বলেছিলেন, ‘দেবাশিস আজ চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল আমি তার পরম বন্ধু। বলল, আমাকে সে কোনো দিন ভুলতে পারবে না। কিন্তু কেউ জানল না আজ আমি সত্যি অভিনয় করতে পেরেছি। হাসিমুখে বিদায় দিচ্ছি। হাসিমুখে বলেছি, আমি তো নার্স। এভাবে একেকজনের নিভে আসা জীবনে শুধু নতুন করে দীপ জ্বালানো আমার কাজ।’ দেবাশিসের জন্য সুচিত্রার নীরব দীর্ঘশ্বাস প্রকাশ পায় না। বরং সাফল্য হিসেবেই ধরা হয়। আর এ সাফল্যে খুশি হয়ে নার্সকে নতুন করে ডেকে নেন সিনিয়র ডাক্তার। বললেন নতুন আসা মানসিক রোগী তাপস চৌধুরীর দায়িত্ব নিতে। তাপস গভীর আঘাত পেয়েছেন প্রেমিকার কাছ থেকে। তাই তাপসের মা ও প্রণয়িনী- এ দুইয়ের মাঝে ভাব ও আবেগ তৈরির ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে রাধাকে। দেবাশিসকে বিদায় দিয়ে সেবাই ধর্ম মেনে নিয়ে তাপস চৌধুরীকে দেখা শুরু করলেন রাধা। কিন্তু মানুষ কি সব সময় অভিনয় করতে পারে জীবন চলার পথে? তাই অপার কষ্টের নতুন এক মায়াজালে জড়িয়ে পড়েন নার্স রাধা। ‘আর যেন নেই কোনো ভাবনা’ সুরে-তালে নতুন ভাবনা ছাড়াই মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে পড়েন রোগী তাপস ও নার্স রাধা। তাপসকে বাঁচাতে একদিন তার পুরনো প্রেমিকা সুলেখার বাড়িতে গিয়ে হাজির রাধা। তাকে অনুরোধ করেন হাসপাতালে যেতে। যেতে রাজি না হওয়ায় পুরনো দিনের চিঠি দেখিয়ে রাধা হাসপাতালে নিয়ে যান সুলেখাকে। এই সুলেখার বাড়ি থেকেই অপমানিত হয়ে বের হয়ে এসেছিলেন তাপস। আর কষ্ট-দুঃখ সইতে না পেরে হাসপাতালে ঠাঁই নেন। সেই সুলেখাকে হাসপাতালে দেখে তাপস উত্তেজিত হন। এ সময় রাধা সামনে এসে সব স্বাভাবিক করেন। সেদিনই তাপসকে ইলেকট্রিক শক দিতে নিয়ে যাওয়া হয়। রাধা তাকে রক্ষা করেন। এরপর তাপস দ্রুত সুস্থ হতে থাকেন। এই সুস্থতার মাঝে দুর্বল হন রাধার প্রতি। কিন্তু রাধা কীভাবে সেই ভালোবাসার জবাব দেবেন? রাধার কাজ তো শুধু চিকিৎসা করা। ডাক্তারের নতুন পদ্ধতির চিকিৎসায় গবেষণার পাত্রী হওয়া।

তাপসের বিদায়ের সময় আসে। বিদায়ের আগে নার্স রাধা একদিন গবেষক ডাক্তারকে বললেন, ‘তাপসবাবুর বিদায়ের সময় এসেছে। বিদায় মুহূর্তে তার সঙ্গে দেখা করতে চাই না। তার যাওয়ার আগেও না।’ ডাক্তার সম্মত হলেন। তাপস বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে রাধা মিত্রের সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করতে চাইলেন। কিন্তু তাকে জানানো হলো, রাধা দেখা করতে চান না। কারণ, রাধার সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্ক ভালোবাসার নয়, নিছক অভিনয়! তাপস বললেন, ‘বিশ্বাস করছি না তিনি আমার সঙ্গে অভিনয় করেছেন। আমি নিজের কানে শুনতে চাই। তাকে একবার ডেকে দিন। তার মুখে শুনতে চাই।’ তাপসের আর্তনাদে সাড়া দিলেন না ডাক্তার। তাপস রাধার ঘরে ছুটে যান। দরজা খুলতে বলেন রাধাকে। বাইরে থেকে চিৎকার করতে থাকেন- ‘রাধা, শুধু একবার বল এত দিন যা করেছিলে সব অভিনয়। আমি তোমার মুখে শুনতে চাই।’ রাধা বের হলেন না। যখন বের হলেন ততক্ষণে হাসপাতাল ছাড়লেন তাপস। আর রাধা হলেন মানসিক রোগী। এভাবেই সেবা করতে গিয়ে শেষ রক্ষা হয়নি তার। অভিনয় করতে করতে একদিন ক্লান্ত নার্স রাধা নিজেই হারিয়ে যান। তাই গবেষক ডাক্তারকে রাধা বললেন, ‘আপনি বিশ্বাস করুন, আমি অভিনয় করিনি। আমি অভিনয় করতে পারি না।’ শেষ পর্যন্ত রাধার ঠাঁই হলো হাসপাতালে তাপসের সেই ছেড়ে যাওয়া মানসিক রোগীদের রুমটিতে। সুচিত্রা সেনের সেই অসাধারণ অভিনয় এখনো মনে গেঁথে আছে। ভালোবাসার এই সাতকাহনের ছবি দেখে একসময় আবেগে আপ্লুত হতাম। এখন মানুষের মাঝে কোনো আবেগ নেই। মানুষ এক নিষ্ঠুরতার মাঝে অবস্থান করছে। সমাজের এই নিষ্ঠুরতা ধ্বংসের। সৃষ্টির নয়। আগে মানুষের সৃষ্টির মাঝে আবেগ ছিল। আর জীবন ভাবনায় ছিল বাস্তবতা। এ আবেগ থেকেই মানুষ বই পড়ত। সিনেমা, যাত্রা, থিয়েটার দেখত। গভীর মমত্ব নিয়ে প্রেমপত্র লিখত প্রিয় মানুষকে। সেই প্রেমপত্রের মাঝে সাহিত্য থাকত। আবেগ থাকত। এখন কিছুই নেই। এখন চারপাশে মৃত্যু উপত্যকা। বীভৎসতা আর নিষ্ঠুরতা। মানুষের সহনশীলতা উঠে যাচ্ছে। ইট-পাথরের এই নগর আমাদের বড় অচেনা। এই অচেনা জগৎ নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা শুনছি। সব ব্যাখ্যার যৌক্তিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ।

একটা কষ্ট ছড়ানো মায়ার জগতে আমরা অবস্থান করছি। জগতের অনেক কিছু আর মেনে নিতে ভালো না লাগলেও মানতে হয়। চারদিকের অস্থিরতা নিয়ে একটা সময় অতিক্রম করছি। লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষের এই জগতে সুস্থতা এখন অস্বাভাবিক। মানুষের কীসের এত অহংকার? কীসের এত বড়াই? অমিতাভ বচ্চনের আত্মজীবনীর একটি লেখা মনে পড়ছে। কিছুদিন আগে সামাজিক গণমাধ্যমে এ লেখাটি ভাইরাল হয়। অভিতাভ একটি ফ্লাইটে বিজনেস ক্লাসে বসা সহযাত্রী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমি তখন ক্যারিয়ারের তুঙ্গে। একদিন প্লেনে করে যাচ্ছিলাম। খুব সাধারণ শার্ট আর প্যান্ট পরিহিত একজন ভদ্রলোক আমার পাশে বসেই যাচ্ছিলেন। দেখে তাকে একজন শিক্ষিত ও মার্জিত মধ্যবিত্ত মানুষ মনে হয়েছিল। অন্য সহযাত্রীরা আমায় চিনতে পেরে খুব উৎসাহিত হয়ে অটোগ্রাফ নিচ্ছেন। কিন্তু পাশে বসা ভদ্রলোককে লক্ষ্য করলাম তার কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। তিনি একমনে একটা খবরের কাগজ পড়ছিলেন আর মাঝে মাঝে জানালার বাইরে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিলেন। চা পরিবেশন করা হলো, ঠোঁটের আগায় থ্যাঙ্কস লেগেই আছে। আমাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না।

তার প্রতি আমার কৌতূহল বেড়েই চলছিল। তাই তার সঙ্গে কথা বলার জন্য তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। তিনিও একটা সৌজন্যমূলক হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, হ্যালো। সামান্য কিছু সৌজন্যমূলক কথোপকথন শুরু হলো।

আমিই নিজ থেকে সিনেমার প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি সিনেমা দেখেন?’

তিনি বললেন, ‘কখনোসখনো। শেষ যে সিনেমাটা দেখেছি, হ্যাঁ... তাও প্রায় এক বছরের বেশি হয়ে গেছে।’

বললাম, ‘আমি ওই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেই আছি।’

তিনি উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘দারুণ ব্যাপার! তা আপনি কী করেন?’

বললাম, ‘আমি একজন অভিনেতা।’

প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘দারুণ!’

ব্যস! ওই পর্যন্তই...

প্লেন ল্যান্ড করার পর আমি ভদ্রলোকের দিকে করমর্দনের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘আমার নাম অমিতাভ বচ্চন।’

তিনি মাথা নত করে আমার হাতটা ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে দারুণ লাগল! আমার নাম জে আর ডি টাটা... (Jehangir Ratanji Dadabhoy Tata, chairman of TATA Group)... ’

চমকে উঠলাম আমি!

অমিতাভের এ কাহিনি ছিল বাস্তব একটি ঘটনার। রতন টাটার মাটির সঙ্গে মিশে চলাকে অমিতাভ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই সমাজে আমরা কি তা করতে পারছি? কেউ অনুধাবন করি না আজ আছি কাল থাকব না। জীবনের এই বেলায় এসে অনেক ধরনের ক্লান্তি ভর করেছে মনের গভীরে। প্রাণের সেই উচ্ছলতা পাই না চারপাশের সব দেখে। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে মানবতা, সুন্দর আগামীর স্বপ্ন। চারপাশের অসুস্থতা নিজের মাঝে হতাশা তৈরি করে। কষ্টকে জাগিয়ে দেয়। কখনো কখনো আবেগকে পুড়িয়ে মারে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার নষ্টামি আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে? সুচিত্রা সেনের ছবিতে ভালোবাসা দিয়ে একজন মানসিক রোগীকে সুস্থ করা যায়। কিন্তু এই সমাজে এখন আর কি তা করা যায়? ভালোবাসাকে জাগিয়ে অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করতে গবেষণা ছিল একজন ডাক্তারের। ডাক্তার এ বিষয়ে একজন নার্সকে কাজে লাগান। সেই নার্স নিজেই হেরে গেলেন। জীবনের নানা বাঁকে কত কিছুই লুকিয়ে থাকে। সুচিত্রা সেনের অভিনয় ছিল অন্য উচ্চতার। এখন সেই গান, ছবি, সুর কোনো কিছুই নেই। এমনকি আমাদের মায়ার বাঁধনগুলোও নেই। বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসের জায়গাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সোনালি সময়গুলো আমাদের হারিয়ে গেছে। অনেক বছর আগে আমাদের এক বন্ধু মুন্নার শরীর খারাপ ছিল টানা তিন দিন। একাকী জীবনে জ্বরের ঘোরে পড়ে ছিলেন। জ্বর ছাড়ল এক ভোররাতে। বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করতেই হঠাৎ মনে হলো নড়তে পারছেন না। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ক্লান্ত। তার মনে হলো মারা যাচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুকে। বললেন, টিংকু আমি মারা যাচ্ছি। আমার জন্য কিছু খাবার ও পানি নিয়ে আস। এত রাতে কোথায় যাবেন টিংকু? হঠাৎ মনে হলো মগবাজার মোড়ের রেস্টুরেন্টগুলো খোলা। সঙ্গে সঙ্গে গেলেন মগবাজারে। খাবার কিনলেন। তারপর বারিধারায় গেলেন সেই বন্ধুর বাড়িতে। এমন বন্ধু কি এখন পাওয়া যায়? বন্ধু এখন খুন করছে বন্ধুকে। পারিবারিক আর সামাজিক অপরাধ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিশ্বাসের ডালপালা শেষ। খুন-ধর্ষণের এ দেশ আমার নয়। মায়ামমতাহীন এ সমাজ আমার নয়। নিষ্ঠুর মানুষের কাজগুলো সমাজের নৈতিক ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছে। এই অসুস্থতা আমার মাঝে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, সবকিছু হয়ে উঠছে বসবাসের অযোগ্য। হিংসা-বিদ্বেষের মাঝে দীর্ঘ সময় কীভাবে চলব? বরগুনায় এক নারী আর্তনাদ করে সবাইকে ডাকছেন আমার স্বামীকে বাঁচান? কেউ এগিয়ে গেল না। একজন নারী একা লড়াই করে স্বামীকে বাঁচাতে পারলেন না। এই নিষ্ঠুরতাকে আমরা নিচ্ছি স্বাভাবিকভাবেই। কারণ, আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত এমন ঘটনাগুলোই ঘটছে। আর আমাদের মনে হচ্ছে কোথাও কোনো সমস্যা নেই! আসলে বাস্তবে অসহায় মানুষের কোথাও কেউ নেই।  ভীত চোখগুলোতে শুধুই স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার আকুতি।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর