বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

জায়রা ওয়াসিমের বলিউড ত্যাগ

তসলিমা নাসরিন

জায়রা ওয়াসিমের বলিউড ত্যাগ

কাশ্মীরী কিশোরী জায়রা ওয়াসিম ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে অত্যন্ত ভাগ্যবতী অভিনেত্রী। তার অভিনীত প্রথম ছবি দংগল অসাধারণ ছবি। সিক্রেট সুপারস্টার, দ্বিতীয় ছবিটিও অসাধারণ। দুটোই জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। এলাম, দেখলাম, জয় করলামের মতো জায়রা বলিউডে এলো, অভিনয় করলো, দর্শকের মন জয় করলো। কিন্তু সবাইকে তাজ্জব করে দিয়ে সে সেদিন ঘোষণা দিয়েছে, সে অভিনয় ছেড়ে দেবে, কারণ চলচ্চিত্র জগতে থেকে তার ইমান নষ্ট হচ্ছে। কোরআনের প্রচুর সূরা উদ্ধৃত করে সে ফেসবুকে লিখেছে, সে তার ধর্মে ফিরে যাবে। ধর্ম করতে হলে কি কর্ম ত্যাগ করতে হয়? প্রশ্নটা এখানেই। কত লক্ষ কোটি পেশাজীবী লোক নির্বিঘেœ ধর্ম পালন করছে। কারও তো সমস্যা হচ্ছে না!

বিয়ে হওয়ার পর এক সময় শর্তই ছিল মেয়েদের চাকরি করা চলবে না। সময় বদলেছে, অনেক পরিবারই মেয়েদের উপার্জিত টাকা সংসারে খরচ হোক চায়। কিন্তু এখনও এমন পরিবার ভূরি ভূরি, যারা মেয়েদের ঘরের বাইরে যাওয়াই পছন্দ করে না। স্বামী সংসার সন্তানের পেছনে মেয়েরা সময় দেবে, এসব কাজ করার জন্যই মেয়েদের জন্ম। আপিস কাচারি পুরুষেরা করবে। সংসার পালন করতে হলে পেশা ত্যাগ করতে হয় শুনেছি, কিন্তু ধর্ম পালন করতে হলে পেশা ত্যাগ করতে হয়। এটি আমার কাছে নতুন।

জায়রার পোশাক আশাক, চলাফেরা, কথাবার্তা যতটা দেখেছি এবং শুনেছি, তাকে স্মার্ট এক কিশোরী বলেই মনে হয়েছে। হঠাৎ করে অতুল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে পায়ে মাড়িয়ে যাচ্ছে কেন সে? কেন সে তার পেশা ছেড়ে দিতে চাইছে? এটি কি তার নিজের ইচ্ছেয়? কোরআন সে এমনই মুখস্থ করেছে যে ফেসবুকে লিখতে গিয়ে এক এক করে তার কোরআনের আয়াতগুলো মনে পড়ে গেছে? আমার কিন্তু মনে হয় জায়রার লেখাটি একেবারেই জায়রার লেখা নয়। লেখাটি অন্য কেউ লিখে দিয়েছে, এই অন্য কেউটি কোনও কট্টর মৌলবাদী, যে মৌলবাদী যে কোনও মুহূর্তে সন্ত্রাসী বনে যেতে পারে, যে ধর্মের নামে মানুষ খুন করতেও দ্বিধা করে না। জায়রাকে হয়তো এভাবেই ভয় দেখিয়ে চলচ্চিত্র জগৎ থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে, যেভাবে গানের জগৎ থেকে প্রাগাস নামে কাশ্মীরী মেয়েদের গানের দলটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছিল কয়েক বছর আগে। গ্র্যান্ড মুফতি ফতোয়া দিয়েছিল মেয়েদের গান গাওয়ার বিরুদ্ধে। মেয়েরা মৃত্যুর হুমকি এত পেয়েছিল যে দল বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল। কাশ্মীরে কিন্তু পুরুষদেরও গানের দল আছে, তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু এভাবে ফতোয়া জারি হয় না। কাশ্মীরের পুরুষও চলচ্চিত্রে অভিনয় করছে, তাদের কিন্তু হুমকি দেওয়া হচ্ছে না বা অভিনয় ছাড়তে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে না।

জায়রা আর কোনও ছবিতে না সই করে অভিনয় জগৎ থেকে চুপচাপ সরে যেতে পারতো, কিন্তু সে যে চুপচাপ সরে না গিয়ে সরবে জানিয়ে গেল যে অভিনয় করলে ইমান নষ্ট হয়ে যায়, আল্লাহ অখুশি হন, ইসলামের অবমাননা হয়, এই বিবৃতিটিই রাজনৈতিক। এর নাম ইসলাম নয়, এর নাম ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’। যে পলিটিক্যাল ইসলাম জগৎজুড়ে সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে। এই বিবৃতির মাধ্যমে সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম মেয়েদের জানিয়ে দেওয়া হলো, সাবধান, অভিনয় পেশা ছেড়ে দাও, অথবা অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিও না, শুধু অভিনয় জগৎ নয়, গানের জগৎ, শিল্প সাহিত্যের জগৎ, ঘরের বাইরের যে কোনও জগৎই মেয়েদের জন্য নিষিদ্ধ। স্বনির্ভরতা মেয়েদের জন্য হারাম। মেয়েরা ঘরে বসে কোরআন হাদিস পড়বে, নামাজ রোজা করবে, স্বামীর সহায় সম্পত্তির দেখভাল করবে, স্বামীসেবা করবে, সন্তান উৎপাদন করবে, সন্তানদের পরহেজগার বানাবে, আর ঘরের বাইরে যদি যেতেই হয় যাবে বোরকা পরে, কোনও পরপুরুষ যেন তাদের শরীরের কোনও অংশ না দেখতে পায়- এসব ছাড়া মেয়েদের জন্য আর কোনও কাজের অনুমোদন ধর্মে নেই।

জায়রার মাধ্যমে কঠোর কঠিন নারীবিরোধী নির্দেশ বিশ্বকে আরও একবার জানিয়ে দিয়েছে কট্টরপন্থিরা। সন্ত্রাসী আইসিসরা বিশ্বাস করে- মুসলিম পুরুষের সেবাদাসী আর যৌনদাসী হওয়া ছাড়া মুসলিম নারীদের আর কোনও ভূমিকা থাকতে পারে না। মুসলিম নারী মুসলিম পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এই সম্পত্তির নিজস্ব কোনও জগৎ এবং জীবন থাকতে নেই। স্বাধীনতা বা অধিকার তাদের জন্য নিষিদ্ধ। জায়রার চিঠির লেখকবৃন্দ সেই কথাটিই জানিয়েছে এবং জায়রাকে অভিনয় জগৎ থেকে সরিয়ে নিয়ে প্রমাণ করেছে তারা এখনও শক্তিশালী। মুসলিম নারী-শিল্পীদের ওপর অলিখিত একটি হুমকিও কিন্তু প্রকারান্তরে দেওয়া হয়েছে।

এ সময় বলিউডের তো বটেই, পুরো দেশের সচেতন মানুষের উচিত ধর্মের নামে প্রতিভাময়ী এক অভিনেত্রীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। কিন্তু মুশকিল হলো, নারীবিরোধী মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে অপদার্থ কিছু ইসলামবিদ্বেষী বা মুসলিমবিদ্বেষী ছাড়া খুব বেশি কেউ দাঁড়ায় না। কোথায় নারীবাদী, মানবাধিকার সংগ্রামী, কোথায় সত্যিকার বুদ্ধিজীবী, কোথায় শিল্পী সাহিত্যিক? ধর্মের নামে নারীর প্রতিভাকে আর কত কুপিয়ে মারা হবে, প্রতিভার আর কত মৃত্যু আমাদের দেখতে হবে? আমরা যদি আজ জায়রাকে রক্ষা করতে না পারি, আগামী দিনে আমাদের দেখতে হবে আরও প্রতিভাময়ী মুসলিম নারীকে, যারা বাধ্য হবে প্রতিভা বিসর্জন দিয়ে ঘরবন্দী হতে। ইসলামকে ১০০ ভাগ মেনে চলা মুসলমানদের পক্ষেও সম্ভব নয়। তাই তারা বেছে নিয়েছে কী মানবে, কতটুকু মানবে। যেটুকু মানলে সুবিধে হয়, সেটুকুই মানছে। ইসলামে চুরি করলে হাত কাটার কথা বলা হয়েছে। তাই বলে মুসলমানরা কি চুরি করছে না? দুর্নীতিতে ভেসে যাচ্ছে মুসলিম দেশগুলো। চোরদের হাত কাটা হচ্ছে না। বেশিরভাগ মুসলিম শাসক বাণিজ্যের কারণে বিধর্মী শাসকদের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক বজায় রাখে। সৌদি আরবের সঙ্গে প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলোর যে সম্পর্ক তার চেয়ে ভালো সম্পর্ক ইউরোপ আমেরিকার অমুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে। ইসলাম সত্যিকার মেনে চলছে না পুরুষেরা। কিন্তু মেয়েদের ওপর ধর্ম চাপিয়ে যাচ্ছে, কারণ মেয়েদের ওপর ধর্ম চাপানো সহজ। যেহেতু সমাজের পুরুষতন্ত্র মেয়েদের কাবু করে রেখেছে বহুকাল, ধর্ম নিজেই যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক, তাই ধর্ম ব্যবহার করে ইতিমধ্যে কাবু মেয়েদের আরও কাবু করছে তারা। আমরা দেখি, কত মুসলিম মেয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়েছে, লেখাপড়া করছে, চাকরি করছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা দেখিনা কত মেয়ে অন্ধকারে পড়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও মুখ বুজে পড়ে আছে শুধু নারীবিরোধী ধর্মান্ধ লোকদের নৃশংসতা থেকে বাঁচার জন্য।

ইসলামের নিষেধ সত্ত্বেও বাংলাদেশ পাকিস্তান ইরান মিসর জর্ডান লেবানন এরকম কত মুসলিম দেশ চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে। চলচ্চিত্র নির্মাতারা মুসলিম, অভিনেতা অভিনেত্রীরা মুসলিম। চলচ্চিত্রে অভিনয় করার জন্য কারও ধর্ম বিশ্বাসে কোনও তো সমস্যা হয়নি! হাজার হাজার মানুষের সমস্যা হচ্ছে না, জায়রার হচ্ছে। কিন্তু কেন? সমস্যা, আমার বিশ্বাস জায়রার নয়, সমস্যা জায়রাকে যারা অভিনয় ছাড়তে বাধ্য করছে, তাদের। অথবা জায়রার যদি মগজধোলাই হয়ে থাকে, তবে সমস্যা তাদের, যারা জায়রাকে মগজধোলাই করেছে।

এত বড় শক্তিশালী বলিউড থেকে এত বড় এক সফল জনপ্রিয় অভিনেত্রীকে ধর্মের দোহাই দিয়ে ভ্যানিস করে দেওয়া হবে, আর মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল চুষবে, এ কি মেনে নেওয়া যায়? কিন্তু এর প্রতিবাদ করতে গেলে মুসলিম মৌলবাদীরা ক্ষুব্ধ হবে, তাহলে ‘সেক্যুলার’ লেবেলটা হারিয়ে যেতে পারে, ভারতের বুদ্ধিজীবীদের ভয়টা সেখানেই। অন্যান্য ধর্মীয় মৌলবাদীদের কীর্তিকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে, কেবল মুসলিম মৌলবাদীরা যা কিছুই করুক, কুলুপ এঁটে বসে থাকতে হবে। এই হলো এদেশি সেক্যুলার এবং উদারপন্থি নামধারীদের নকশা। সংখ্যালঘু লোক, তাদের মধ্যে যতই নারীবিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা, বর্বরতা থাকুক না কেন, তারা যতই অপরাধ করুক না কেন, তাদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। হিপোক্রেসিতে যখন বুদ্ধিজীবী সমাজ আক্রান্ত, তখন সত্যিই সমাজের বড় দুরবস্থা।

জায়রার চলে যাওয়া জায়রার সিদ্ধান্ত নয়। মাথায় সামান্য বুদ্ধি আছে যাদের, তাদেরই এটা বোঝার কথা। জায়রা বাধ্য হচ্ছে চলচ্চিত্র জগৎ ত্যাগ করতে। আমি বাধ্য হয়েছি আমার নিজের দেশ ত্যাগ করতে, আমাকে বাধ্য করা হয়েছে আমার দ্বিতীয় বাসভূমি পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করতে। আরও কত মেয়েকে গান ছাড়তে, নাচ ছাড়তে, ছবি আঁকা ছাড়তে, লেখাপড়া ছাড়তে, চাকরি ছাড়তে, ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। মেয়েদের কোনও স্বপ্ন থাকতে পারে না। মেয়েদের কোনও স্বাধীনতা থাকতে পারে না। তাই জায়রারও কোনও স্বাধীন ইচ্ছে থাকতে পারে না। তার ইচ্ছেকে নিয়ন্ত্রণ করছে নারীবিদ্বেষী ধর্মের রক্ষকেরা।

একবিংশ শতাব্দীতে এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এর চেয়ে ভয়াবহ প্রস্থান দৃশ্য আর কী হতে পারে! আমাদের সমাজে রিফর্ম ঘটুক, অথবা মেয়েরা, যে যা কিছুই বলুক, নিজের স্বপ্নকে সফল করার পথে হেঁটে যাক। এ ছাড়া আমি আর কোনও সমাধান দেখছি না। সরকারের ওপর আস্থা নেই। ফতোয়াবাজ মোল্লাদের বিরুদ্ধে সরকার আগেও ব্যবস্থা নেয়নি। এখনো নেবে না।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর