বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

স্মৃতির শহর প্রাণের শহর

মাকিদ হায়দার

স্মৃতির শহর প্রাণের শহর

চোখ দুটি বন্ধ করলে এখনো স্পষ্ট দেখতে পাই স্মৃতিকাতরতার দিনগুলি। স্মৃতি যে মধুময় সে কথা রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার বলেছেন, এমনকি তিনি এমনও বলেছেন- মানুষের স্মৃতি পুরাতন মদের মতো। সে রকম স্মৃতির ভেতরে অবগাহন করেছিলেম গত ২৭ এপ্রিলের ২০১৯ শনিবার। সেই স্মৃতিতে যে আমি নিজেই ডুবেছিলেম তাই নয়, ডুবেছিলেম সেই ১৯৬৩ সালের ২৭ এপ্রিলে প্রতিষ্ঠিত ইফার (ইনস্টিটিউট অব ফাইন আটস) জন্মলগ্নে। আমার মতো একদল তরুণ-তরুণী। যাদের অধিকাংশই ছিলাম প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী আগামী বছরের। আমার ইচ্ছে ছিলো একদিন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো বিখ্যাত গায়ক হবো, কিংবা রবীন্দ্রসংগীতের পুরোধা পঙ্কজ মল্লিক অথবা দেবব্রত বিশ্বাস (জর্জ) আমাকে হতেই হবে। সেই প্রেক্ষিতে ইফার প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন, পাবনা শহরের প্রাণকেন্দ্র লাহিড়ীপাড়ার নবপ্রতিষ্ঠিত সেই ইফাতে আমিও ভর্তি হয়েছিলেম। ৫৬ বছর আগের এক দাবদাহের বিকেলে। আমাকে আমার প্রিয় সাইকেল ‘হারকিউলিসে’ যেতে হয়েছিলো আমাদের দোহারপাড়া গ্রাম থেকে শহরের সেই ইফাতে। ইফার যাত্রা শুরুর মাত্র দিন কয়েক আগে থেকেই জেলা প্রশাসন শহরময় মাইকিংয়ে শহরবাসীকে জানিয়েই ক্ষান্ত হননি, জানিয়েছিলেন শহরের বাইরের মহল্লাগুলোকে। সেই বাইরের মহল্লার অন্তর্ভুক্ত ছিলো দোগাছি, হরিতলা, ব্রজনাথপুর, কালীদহ, আরিফপুর, দোহারপাড়া, এমনকি শহরের দক্ষিণের ঘোষপাড়া, চর আশুতোষপুরের লোকদের জানিয়েছিলেন প্রশাসন। একটি গানের স্কুল খোলা হয়েছে, শহরের লাহিড়ীপাড়ায়। তার দু’বছর আগে শহরের দিনাকিপুর মহল্লায় ১৯৬০-৬১ সালে উমাদে চাকীবাড়ির বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী প্রণয় চাকীর বাবা সুঅভিনেতা লক্ষ্মী চাকী, সীতেন দে এবং সিরাজউদ্দিন ম ল ও মোকাররম হোসেনের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শিশু কল্লোল। শিশু কল্লোলে গান শেখাতেন ভম্বল কাকা এবং নাচ শেখাতেন আরেক নাচের শিল্পী। মহল্লার ছেলেমেয়েদের কে ভবিষ্যতে শিল্পী হবে সেই লক্ষ্যে হারমনিয়াম, তবলা বাজাতে শেখাবেন শৈলেশ সান্যাল। শৈলেশ কাকার বড় ছেলে নিখিলেশ সান্যাল তপন ও ছোট ছেলে পল্লব সান্যাল পিলু, বাংলাদেশের অন্যতম তবলাবাদক। আবৃত্তির চর্চা- সেই শিশু কল্লোলের ছাত্ররাই কচি কোমল মুখে শিশুদের কণ্ঠে যার একান্ত প্রচেষ্টায় শুরু হয়েছিলো, তিনি ছিলেন আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো বলাইদা। সেই বলাইদা নিহত হয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গায়। দাঙ্গার নেপথ্যে ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানের না-পাক-সরকার। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শিশু কল্লোল একটি শিল্পচর্চার প্রাণকেন্দ্রে পরিচিতি পাবার পরেই অনেক কট্টরপন্থি পরবর্তীতে শিশু কল্লোলকে দাঁড়াতে দেয়নি। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে গানে শক্তি চাকী, ভক্তি চাকী, কবিতা আবৃত্তিতে আনোয়ারা বেগম শিউলি, তবলায় নিখিলেশ এবং নাচে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন ব্যবসায়ী মোকাররম হোসেনের মেয়ে বেগম মমতাজ হীরা এবং তাদের ভেতরে রবীন্দ্র অধিকারী শিশুদের রবীন্দ্রসংগীত প্রতিযোগিতায় রাজশাহী বিভাগ প্রথম হয়েছিলো এবং শিশুদের দলীয় নাচে শিশু কল্লোলের নৃত্যশিল্পীরাও প্রথম হয়েছিলো, বিভাগের সেকালের পুরাতন পাঁচটি জেলার ছেলেমেয়েদের মধ্যে।

ষাটের দশকের গোড়ার দিকে অল পাকিস্তান ওমেন্স অ্যাসোসিয়েশন (আপওয়া) এবং ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টসের চিন্তাভাবনার প্রেক্ষিতে না-পাক- পাকিস্তান সরকার ইফা এবং আপওয়ার জটলা খুলেছিলেন ১৯৬৩ সালে। আমাদের নিরিবিলি এবং আলোকিত ওই শহরে। ইফার প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম সেই সুবাদে গত ২৭ এপ্রিল ঢাকা থেকে গিয়েছিলেম দু’টি উল্লেখযোগ্য উৎসবে। সংস্কৃতি সচিব ড. আবু হেনা মুস্তফা কামাল। জনাব কামালের পৈতৃক নিবাস এই শহরের পশ্চিম প্রান্তে। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে তিনি ছাত্র থাকাকালেই সম্ভবত যুক্ত হয়েছিলেন ইফার সঙ্গে। তাই তাকেও যেতে হয়েছিল ইফার ৫৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রধান ব্যক্তি হিসেবে। গিয়েছিলেন ৫৬ বছর আগের আমরা যারা ছাত্র ছিলাম তারা সবাই। নিখিলেশ সান্যাল, হাসনাত মোশাররফ, শাকিব রোহানীসহ অনেকেই।

পাবনা শহরে সংগীতশিল্পের পুরোধা ব্যক্তি যিনি প্রায়শই ইফাতে আসতেন, তিনি বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ এবং ঢাকা মিউজিক কলেজের প্রতিষ্ঠাতা বারীন মজুমদার, স্ত্রী ইলা মজুমদার, রূপবাণী শিকদার, অনিমা রায় গাইতেন আধুনিক। সৈয়দ মোহাম্মদ আলী শেখাতেন নজরুলের গান। পল্লীগীতির গায়ক হিসেবে রেডিও পাকিস্তানের রাজশাহীর বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত গান পরিবেশন করতেন রূপবাণী, অনিমা, শিবানী নাগ এবং পুরুষ শিল্পীদের ভেতরে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন পল্লীগীতির গায়ক হিসেবে শিল্পী আবদুল গফুর। গফুর স্বল্পশিক্ষিত হলেও মার্জিত রুচির লোক ছিলেন এবং অসম্ভব সাহসী। সেই সাহসিকতার অন্তরালে ঢাকা পড়েছিলো তার শিল্পীসত্তা। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যাত্রার প্রাক্কালে তাকে না-পাক-সৈনিকদের হাতে তুলে দিয়েছিলো- কালীদহ, দোগাছির রাজাকারপ্রধান সুলতান আবদুল গফুরকে না-পাকদের হাতে তুলে দেবার নেপথ্যে ছিলেন দোগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুসলিম লীগ নেতা আকবর আলী খান। গফুরের প্রতি রাগ-বিরাগ অনেকদিন থেকেই ছিলো, বহুবার চেষ্টা সত্ত্বেও গফুরকে মুসলিম লীগের প্রাথমিক সদস্যও করতে পারেননি। সেই জ্বালায় আবদুল গফুর বয়াতির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল হরিতলার পদ্মা নদীর পূর্বপাড়ে। বারীন মজুমদার শৈলেশ সান্যাল ইফাতে ঢুকেই প্রথমে যেতেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে। তারা উভয়েই জানতে চাইতেন উচ্চাঙ্গ সংগীত এবং তবলার তাল-লয়-বোল, ঠিকমতো শিক্ষকেরা শেখাচ্ছেন কিনা? আমরা কিশোরেরা সমবেত কণ্ঠে বলতাম, শেখাচ্ছেন, তবলার শিক্ষক, নারায়ণ চন্দ্র বশাক, উচ্চাঙ্গ সংগীতের প্রতি আমাদের অধিকাংশেরই আগ্রহ-উৎসাহ না থাকলেও লক্ষ্মী চাকীর পরিবারের দুই ছেলে ভক্তি চাকী, শক্তি চাকী যথেষ্ট পারদর্শিতার সঙ্গে একদিন বারীন মজুমদার এবং ইলা মজুমদারের সামনেই গেয়েছিল উচ্চাঙ্গ সংগীত। যার প্রেক্ষিতে শক্তির এবং ভক্তির সুনাম তো ছড়িয়ে পড়েছিলো- উপরন্তু শ্রী মজুমদারের সহায়তায় নাকি রাজশাহী বেতারে উচ্চাঙ্গ সংগীত পরিবেশন করতেন।

পঞ্চাশের দশকের শেষে পাবনার আরেক কৃতী সন্তান, কবি, কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৫৮ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন ষাটের দশকের গোড়ার দিকে। তার মতো কৃতীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতার সুযোগ দেওয়া হয়নি, বিভক্তির রাজনীতিতে। কেননা ড. আবু হেনা প্রচ  রকমের পি ত এবং ঠোঁট কাটা এবং একই সঙ্গে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে নাকি কথার ছলে বলতেন, ‘ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার আর আসে না আসবে না।’ তাকেও দেখেছি পাবনা অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরিতে এবং ইফাতে। সেই ইফাতে আমাকে আমাদের বাড়ির জায়গির মাস্টার আবু মুসা প্রথম নিয়ে গিয়েছিলেন। ইফাতে উভয়েরই অভিপ্রায় ছিলো স্বদেশজোড়া নামকরা গায়ক হবো। তখন ছাত্র ছিলাম নবম শ্রেণির, ইচ্ছেটা ছিলো প্রবল। কেননা, আমাদের দোহারপাড়ার বাড়িতে ১৯৩০-৩১ সালে পিতা শেখ মোহাম্মদ হাকিম উদ্দিন কলকাতা থেকে বড় দুই বোনকে গান শেখানোর জন্য হারমনিয়াম, ডুগি, তবলা কিনে এনেছিলেন এবং আমাদের ছোট কাকা আবু সাঈদ আবুল কাশেম তিনি ১৯৩৪ সালে এস্রাজ এবং সেতার কিনে এনেছিলেন। তিনি নিজেই ছিলেন নাটক রচয়িতা ও একাধারে নাট্যনির্দেশক, অভিনেতা, উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিল্পী। হয়তো তারই প্রেরণায় আমাদের ‘হায়দার পরিবার’ শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হলেও কেউই কণ্ঠশিল্পী হতে পারেননি। তবে সেই ইফাতে পরবর্তী সময় তার সুযোগ্য ছেলে আবুল হাসনাত মোশাররফ রতন সুখ্যাতি পেয়েছিলো, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তবলা বাজিয়ে যে তবলা, ডুগি, হারমনিয়াম, সেতার, এস্রাজ, আমাদের বাবা এবং ছোট কাকা এনে দিয়েছিলেন ত্রিশের দশকে। সেসব বাদ্যযন্ত্র লুট হয়ে গিয়েছিলো ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং আমাদের ১১৭ বছর আগে নির্মিত পুরাতন দোতলা বাড়ির নিচতলার মাঝখানের ঘরে ফুটবল প্রিয় মেজ কাকা হাবীবর রহমানের সংগৃহীত দুটি বিখ্যাত ছবি দীর্ঘকাল দেয়ালে ঝুলতে দেখেছি তার মধ্যে একটি ত্রিশ এবং চল্লিশের দশকের মোহামেডান, মোহনবাগান এবং ইস্ট বেঙ্গল ফুটবল দলের বিখ্যাত সব সফল খেলোয়াড়দের। সেকালের ফুটবলের জাদুকর নামে খ্যাত আবদুস সামাদ, বাপ্পি খানসহ আরও অনেকের। দ্বিতীয় সংগ্রহ ছিলো অভিনেত্রী কাননবালার এবং রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি। তিনটি ছবিসহ লুট হয়েছিলো এবং কাকাদের শখের বাদ্যযন্ত্র- কাননবালা, রবীন্দ্রনাথ সেই ১৯৭১ সালে। ১৯৬৩ সালের এই মধুমাসে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে জায়গির মাস্টারের হাত ধরে নাম লিখিয়েছিলেম ইফার খাতায়। ভর্তি ফি ছিলো ৩ টাকা। সেই ৩ টাকার কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তে দেননি মুসা ভাই। তিনি তখন এডওয়ার্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তার গ্রামের বাড়ি শাহজাদপুরের খুকশীতে। প্রতি মাসেই তার বাবা ১৫ টাকা পাঠাতেন মুসা ভাইকে। মুসা ভাইয়ের উৎসাহে যেহেতু ভর্তি হতে গিয়েছিলেম তিনিই আমাকে ভর্তি করালেন। ইফার প্রথম অধ্যক্ষ জনাব আবদুর রশীদ, তিনি ছিলেন পাবনা জেলা প্রশাসনের উচ্চমান কারণিক। তৎকালীন জেলা প্রশাসক জানতে পেরেছিলেন রশীদ সাহেব একজন অভিনেতা এবং সংগঠক, সেই প্রেক্ষিতেই আবদুর রশীদকে বিনা বেতনে ইফার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। জেলা প্রশাসক হয়তো তাকে কিছু অর্থ সাহায্য দিতেন গোপনে। কেননা তার বাড়ি শহর থেকে বেশ অনেকটা উত্তরে। যদিও তার একটি ‘ফিলিপ্স’ সাইকেল ছিলো, সেই সাইকেলে তাকে যাতায়াত করতে দেখেছি। আমার গান শোনার সেই মিষ্টি মধুর দিনে। তাল, লয়, কাহারপা, খাম্বাজ, পিলু এদের নাম শুনলেও সেগুলো রপ্ত করার আগেই নবম শ্রেণির ষাণ¥াসিক পরীক্ষা এলো পাবনা গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। আমি যথারীতি ষাণ¥াসিক পরীক্ষার অন্য বিষয়গুলো ভালো করলেও অঙ্কে পেয়েছিলেম ১৯, ওই স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক রমেশ চন্দ্র সাহা, বিএসসি (ক্যাল) ছিলেন আমার পিতার পরিচিত। তিনি একদিন জজ কোর্টের সামনে পিতাকে পেয়ে জানিয়েছিলেন আমার অঙ্কের প্রাপ্ত নম্বরের কথা। সেই কথা শুনে এসে বিকেলে যখন হাজীর মাঠে ফুটবল খেলতে যাবো ঠিক তখনি, আমার কপালে দুর্গতি নেমে এলো। পিতা জায়গির মাস্টার মুসা ভাইকে ডেকে জানালেন, অঙ্কে পেয়েছে মাত্র ১৯, জীবনে মাধ্যমিক পাস করতে পারবে না। রাগতস্বরে মুসা ভাইকে বললেন, রোকনের অঙ্কের খাতা নিয়ে এসো, (আমার ডাকনাম রোকন)। যথারীতি পিতার হাতে অঙ্কের খাতাটি তুলে দিতেই খাতায় মাত্র দুই-একটি লসাগু গসাগু- মানসাঙ্ক এবং যাদব বাবুর পাটিগণিতের দুই-একটি অঙ্ক বাদে সব খাতা জুড়েই গানের নোটে গান, সারেগামা। যথারীতি প্রহারান্তে পিতা জানালেন, রোকনকে আগামীকাল থেকে মুনছুর হাজীর ইটের ভাটায় পাঠিয়ে দাও। দিন গেলে পারিশ্রমিক পাবে দেড় টাকা। ভাটার ভেতরে কাঁচা ইট নামাবে আর শুকনো ইট তুলবে। ওর লেখাপড়া, গানবাজনা আজ থেকে সব শেষ। পিতা কথা না বাড়িয়ে মাকে গিয়ে জানালেন আমার মহান কীর্তির কথা। মৃদুভাষী মা কিছু না বলায় পিতা রেগে গিয়ে উচ্চলয়ে জানালেন, রোকনকে আজ রাত থেকে খাবারদাবার দেওয়া যাবে না; এমনকি ওই মুসাকেও। দয়াময়ী মা পিতার নির্দেশ না মেনে মাঝরাতে ভাত মাছ খেতে দিয়েছিলেন- আর ওই মুসা ভাইকেও। অথচ আমাদের বাড়িতে বাদ্যযন্ত্র আনার সুবাদে পিতাকে প্রায়শই গুনগুনিয়ে গাইতে শুনতাম, তার প্রিয় কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত এবং নজরুলের বিরহের গান এবং রবিঠাকুরের একটি গানের চরণ এখনো মনে আছে- ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে ... ... ... অবসান’। পূজা পর্বের সেই গানের একটি চরণে ‘অবসান’ শব্দটির সঙ্গেই আমার গান শোনারও অবসান ঘটেছিল, ১৯৬৪ সালে। তবে ইফার ৫৬তম জন্মদিনে উপস্থিত সুধীজনেরা স্মৃতিচারণায় জানিয়েছিলেন অনেক কথা। বিশেষত জনাব হাসনাত মোশাররফ জানালেন ইফাতে কীভাবে মাটি দিয়ে একটি ঢিবিকে স্টেজ বানিয়ে সেই অনুষ্ঠানের দিন তৎকালীন জেলা প্রশাসককে প্রায় জোর করেই নিয়ে এসেছিলেন ইফার প্রথম জন্মবার্ষিকীতে। মাটির ঢিবির ওপরেই ছেলেমেয়েরা গান, নাচ মিলিয়ে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা শহরবাসীকে এবং প্রশাসনকে উপহার দেওয়ায়, সেই সময়ের জেলা প্রশাসকের অর্থায়নে হয়েছিলো একটি স্টেজ বা মঞ্চ। ৫৬তম জন্মবার্ষিকীর প্রধান অতিথি এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, তার প্রিয় ললিতকলা কেন্দ্র ইফাকে দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবনার সংস্কৃতি এবং ইফার উন্নয়নে দিয়েছেন। যা ছিলো একান্তই আমাদের কাম্য।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব জনাব হেনা যেহেতু একদা পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের কৃতী ছাত্র ছিলেন এবং ছিলেন কলেজের যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাে  নিয়োজিত। গত ২৫ এপ্রিল তাকে যেতে হয়েছিলো দ্বিতীয় আরও একটি উল্লেখযোগ্য কারণে। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন অনেক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অগ্রগণ্য জাতীয় কবির নামে প্রতিষ্ঠিত নজরুল ইনস্টিটিউট। সমগ্র বাংলাদেশে সরকার সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কয়েকটি জেলায়, জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার একটিতে আমি ছিলাম বরগুনায়। জেলা প্রশাসক জনাব কবির মাহমুদ প্রিন্স, তার প্রশাসনিক দক্ষতায় সুন্দর একটি নজরুল উৎসবের অনুষ্ঠান করেছিলেন বরগুনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে। নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) আবদুর রাজ্জাক ভূইয়ার নেতৃত্বে গত জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে। ঢাকা থেকে গিয়েছিলেন কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন, নেত্রকোনা থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন বন্ধু রফিকুল্লাহ খান, যিনি শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। নজরুলগীতির বিশিষ্ট শিল্পী ফাতেমা-তুজ-জোহরা, নাশিদ কামাল, ইয়াকুব আলী খান এবং একদল নৃত্যশিল্পী। আমাকে যেতে হয়েছিলো কবিতা আবৃত্তি ও আলোচনার জন্য। নজরুল ইনস্টিটিউটের সচিব আবদুর রশীদ, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, আরেক কর্মকর্তা মাহবুব সকলেই গিয়েছিলেন এবং শুনেছিলেন প্রফেসর রফিকুল্লাহ খানের মনোমুগ্ধকর আলোচনা। জেলা প্রশাসক কবির মাহমুদ প্রিন্স, তার বক্তব্যে ছিলো নজরুল সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার কথা। বলা যেতে পারে নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক, যিনি একাধারে কবি মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক। অপরদিকে তিনি নজরুলগীতির একজন স্বনামখ্যাত গায়ক।

গত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে তারই নেতৃত্বে এবার ঢাকা থেকে পাবনায় গিয়েছিলেন ২০-২৫ জন নজরুল পুরস্কারপ্রাপ্ত সুগায়িকা সাদিয়া আফরিন মল্লিক, সালাউদ্দিন আহমদ, ফাতেমা-তুজ-জোহরা, সুধীন চক্রবর্তী খোকাদার মেয়ে। এবারের প্রধান বক্তা ছিলেন শাহজাদপুরের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ। যিনি বিরতিহীনভাবে বলেছিলেন প্রায় ২৭ মিনিট। কেউ টুঁশব্দটিও করেননি তার অনবদ্য কথামালায় এবং পাবনার সুযোগ্য জেলা প্রশাসক মো. জসিমউদ্দিন, ইতোমধ্যেই তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। তার ত্রিমুখী চতুর্মুখী কর্মকাে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ১. তিনি একমাত্র জেলা প্রশাসক যিনি পাবনা সার্কিট হাউসে জাতির জনকের একটি দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য বানিয়েই ক্ষান্ত হননি, সেই ভাস্কর্যের নিচেই আছে বিখ্যাত লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়ের সেই বিখ্যাত কবিতাটির গোটা কয়েক চরণ- ‘যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী বহমান’। দ্বিতীয় কর্মটি দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। তার দাফতরিক ভবনের দোতলায় উঠবার সময় তিনি একটি অপূর্ব কর্মকা  ঘটিয়েছেন সেটি ১৯৫২ থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে ’৬৯ এবং ’৭১ সালে না-পাক পাকিস্তানি সৈনিকদের বিভিন্ন অপকর্মের চিত্রটি তুলে ধরেছেন আগামী প্রজন্মের জন্য। ১৮২৮ সালে পাবনায় প্রথম জেলা প্রশাসক হয়ে এসেছিলেন একাধিক আইসিএস অফিসার। প্রথম জন হলেন মি. এ ডব্লিউ মিলস। ১৮তম ছিলেন মি. ডব্লিউ আই অ্যালেন- ১৮২৮ সালের পরে যারাই ‘শাসক’ হয়ে এসেছিলেন ১৯০৫ সাল পর্যন্ত তারা সবাই ছিলেন ব্রিটিশ আইসিএস। তবে ১৯০৬ সালে একজন বাঙালি আইসিএস জেলা প্রশাসক হয়েছিলেন মি. এস বি মুখার্জি। মাঝখানে অনেকেই এসেছেন, গিয়েছেন। ১৯৭০ সালের আগস্টের ৪ তারিখে নুরুল কাদের খান জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র কয়েক মাস পরই শুরু হয়েছিল ’৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রফিকুল ইসলাম বকুল, বেবী ইসলাম, ইকবাল হোসেন এবং আ স ম আবদুর রহিম পাকনসহ আরও অনেকেই। তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের নেপথ্যে ছিলেন জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান। মুক্তিযোদ্ধা। এই শতকের প্রথম দশকে ১৫/১০/২০১০ তারিখে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন জনাব মুস্তাফিজুর রহমান। তার কৃতিত্ব তিনি পাবনার রেললাইন শিল্পকলা একাডেমির জমিসহ এবং মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের বাড়িটি উদ্ধারের আগেই হয়তো তিনি বদলি হয়েছিলেন পদোন্নতি পেয়ে। মাঝের কয়েক বছর ঝিমিয়ে ছিলো পাবনা শহরের যাবতীয় শিল্পকলা ললিতকলার আচার অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানের পুনঃপ্রবর্তন করলেন জেলা প্রশাসক মো. জসিমউদ্দিন। ইতিপূর্বে তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন তার পাবনাভিত্তিক যাবতীয় কর্মকাে র জন্য। ২৫/৪/২০১৯ থেকে ২৮/৪/১৯ পর্যন্ত এডওয়ার্ড কলেজের মাঠে নজরুল ইনস্টিটিউট আয়োজিত জাতীয় কবি নজরুলকে নিয়ে যে অনুষ্ঠানটি হলো- সেখানে কবি আসাদ চৌধুরী, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন এবং আমাকে পদ্য পাঠ করতে হয়েছিলো। বৈশাখের সন্ধ্যায় হাজার হাজার মানুষ দীর্ঘদিন পরে নজরুল ইনস্টিটিউট এবং জেলা প্রশাসকের সহায়তায় ২৬/৪/১৯-এর সকাল থেকেই শুরু হয়েছিল উৎসব। উৎসবে আরও ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জনাব ফারুক মল্লিক। স্বনামধন্য উপাচার্য এ আর মল্লিকের (আজিজুর রহমান মল্লিক) পুত্র। অনুষ্ঠানের তিন দিনই ছিলো নাচ, গান, আবৃত্তি, নজরুলের কবিতা। পুলিশ প্রশাসনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার যিনি একদা উদীচীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গৌতম কুমার বিশ্বাস। তার সুরেলা কণ্ঠে অনেক নজরুলগীতি শুনিয়েছিলেন আমাদের। তবে তার স্ত্রী ইতি বিশ্বাস দর্শক সারিতে থাকলেও তিনি পরিবেশন করেননি কোনো গান।

অনুষ্ঠানের শেষ দিনে পাবনা এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ ড. মো. হুমায়ুন কবির মজুমদারের আমন্ত্রণে কবি আসাদ চৌধুরী, কবি মালিক আবদুর রাজ্জাকসহ প্রচ  গরমে একটু শান্তির পরশ পাওয়ার অভিপ্রায়ে গিয়ে আমি পড়েছিলাম মহাবিপদে। অধ্যক্ষ মহোদয় সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ফলে বেশ জনাকয়েকজন প্রভাষক, সহঅধ্যাপক, অধ্যাপক আমাদের ঘিরে জানালেন- আপনার নাম এবং ছবি আমরা ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনে’ দেখি এবং নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠ করি। কেননা আপনার অধিকাংশ লেখা বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাতায় পাঠান্তে পাবনার কথা লিখে থাকেন এবং অধ্যক্ষ সাহেব জানিয়েছেন আপনার দুই অগ্রজ জিয়া হায়দার, রশীদ হায়দার এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। আপনি নন। অজস্র কথার মাঝখানে সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুরনিবাসী ওই কলেজের ইতিহাসের শিক্ষয়িত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেম, আপনার বাড়ি কোথায়? তিনি জানালেন সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে। আমি কথায় কথায় রসিকতার ছলে বলেছিলেম, এনায়েতপুর তো জোলাদের (তন্তুবায় সম্প্রদায়ের) বসবাস। ইতিহাসের শিক্ষিকা, প্রচ ভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে জানতে চাইলেন আপনি কেন জোলাদের বসবাস বললেন।- বললাম আমার শ্বশুরালয়ও ওই এনায়েতপুরেই। শেষে তাকে বলেছিলাম, প্রফেসর রমেশ চন্দ্র মজুমদারের (আর সি মজুমদার) ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ চার খ  পাঠ করলেই জানতে পারবেন জোলা বা তন্তুবায় শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে কীভাবে। অধ্যাপিকা শান্ত হলেন। আমিও বিপদমুক্ত হলাম শ্বশুরালয়ের দোহাই দিয়ে। এডওয়ার্ড কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপিকা অনুরোধ করলেন তাকে নিয়ে যেন আমি বাংলাদেশ প্রতিদিনে তার নাম উল্লেখ করে একটি লেখা লিখি। জনপ্রিয়তার শীর্ষে বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমার লেখা ‘রৌদ্র ছায়ার নিচে’ অধ্যাপিকার নাম না লিখলে তিনি একদিন হয়তো বলবেন কবিমাত্রই ভ , মিথ্যুক। আমি বলি ইতিহাস দীর্ঘজীবী হোক, সেই সঙ্গে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক নিলুফার সুলতানা চৌধুরী। ‘পথের সঞ্চয়’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন- ‘অন্যকে সত্যরূপে না জানিলে নিজেকে কখনোই সত্যরূপে জানা যায় না।’ যেমন তন্তুবায় শব্দটি।

                        লেখক : কবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর