শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিবেক নিয়ে বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হচ্ছে -

মইনুল হোসেন

বিবেক নিয়ে বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হচ্ছে -

বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত শরীফ (২৬) নামে এক যুবককে দিনদুুপুরে জনসমক্ষে আইন-কানুন বা সরকারের ভয় না করে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার স্ত্রীর সব আকুতি-মিনতি এবং প্রতিরোধ কোনো কাজে আসেনি। হত্যাকারীরা সবাই যুবক এবং স্থানীয় জনসাধারণই বলছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ই তাদের এ হত্যাকান্ড ঘটাবার দুঃসাহস জুগিয়েছে এবং তারা দলবদ্ধ হয়ে পাশবিক ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছে।

এরূপ নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড অহরহ ঘটছে। হাই কোর্ট ডিভিশনের মাননীয় দুজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত একটি বেঞ্চে এ ব্যাপারে হতাশা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, প্রকাশ্য দিবালোকে একজন যুবককে কোপাচ্ছে দেখেও সাধারণ মানুষ সাহায্যে এগিয়ে এলো না। এর কারণ খুঁজলে সহজেই বলা যাবে, তারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান, দলবদ্ধ, এ কারণে অসহায় জনগণ ভয়ে এগিয়ে আসেনি। স্থানীয় পুলিশও তো এগিয়ে আসেনি। পুলিশকে দিয়েও রাজনীতি করানো হচ্ছে।

এ ধরনের হত্যাকান্ডের জন্য গ্রেফতারের নির্দেশ দিতে হয় প্রধানমন্ত্রীকে। তাতে এটাই প্রমাণ হয় যে, খুনিরা সাধারণ খুনি নয়, আইনও তার নিজস্ব গতিতে চলছে না।

জনগণ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই ভয়-ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে আছে। জনগণকে শক্তি ও সাহস জোগাবার কেউ নেই। সরকারের বিপরীতে শক্তি জোগায় বিরোধী দল। রাজনীতি পারিবারিক ব্যাপার হওয়ায় বিরোধী দলও জনগণের শক্তি ও সাহস নয়। তাই সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নেই; বিরোধী দলও জনগণের বিশ্বাস ভঙ্গ করে চলেছে।

দেশের জনগণ কেন অসহায়, কেনই বা রাজনৈতিক পরিচয়ে বিশেষ একশ্রেণির লোক খুন-খারাবিসহ সব ধরনের জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তার উত্তর নীতি-আদর্শহীন রাজনীতির মধ্যেই খুঁজতে হবে। সবাই একবাক্যে বলবেন যে, বর্তমান দলীয় রাজনীতি দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি। দুর্র্বৃত্ত তৈরি করাই রাজনীতি। বলা হচ্ছে, জনগণ নির্বাচনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, এমন কথা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতারা বলতে পারেন না এবং এমন বক্তব্য তাদের কাছ থেকে কেউ প্রত্যাশাও করে না। দেশের জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতি যাদের শ্রদ্ধা নেই তাদের কাজ হচ্ছে অবাধ নির্বাচন অস্বীকার করা, কারণ নির্বাচনেই জনগণ তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারে। জনস্বার্থবিরোধী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে।

শাসনতান্ত্রিকভাবে যেখানে গণতন্ত্র কার্যকর রয়েছে সেখানে অবাধ নির্বাচনকে অস্বীকার করা দেশদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে। ভোটের অধিকার অস্বীকার করে জনগণের সব অধিকারই হরণ করা হয়েছে। নির্বাচন থেকে বঞ্চিত জনগণ এখন গুরুত্বহীন এবং সম্পূর্ণ অসহায়। তাই জনগণের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের অন্যায়-অবিচার চালিয়ে যেতে অসুবিধা হচ্ছে না। কথায় কথায় পুলিশের ভয় দেখানো সহজ হচ্ছে। জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহি বলতে কিছু নেই। ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জনগণ তাদের বৈধ সরকার প্রতিষ্ঠা করবে, এটা তাদের শাসনতান্ত্রিক অধিকার। নির্বাচন কোনো আস্থা বা অনাস্থার ব্যাপার নয়, নাগরিকদের শাসনতান্ত্রিক অধিকার।

বিগত সাধারণ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বা তাদের শক্তিকে কেন্দ্র করে বহুদলীয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যর্থ করার সরকারি নীলনকশা সম্পর্কে নিশ্চুপ থেকে গেল। আসলে রাজকীয় স্টাইলে পরিবারতান্ত্রিক সহজ রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান নেওয়ার সুযোগ থাকে না।

বিগত সাধারণ নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে ভোট প্রদান কিংবা ভোট গণনার সুযোগ যে থাকবে না, এ কথা বিরোধী ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের জানা ছিল না, ব্যাপারটা এমন নয়। ভোট কেন্দ্রের বাইরে সেনা মোতায়েন রাখা যে অর্থবহ হবে না তাও বলা হয়েছিল। নির্বাচনী জয়-পরাজয়ে ভোটারদেরও কোনো অংশগ্রহণ থাকবে না। তথা-পি নেতাদের কোনো এক ভিন্ন ধারণায় বিভোর থাকতে দেখা গেছে। এখন যে প্রশ্নটা করা দরকার তা হচ্ছে, বিরোধী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিশেষ করে বিএনপি জনগণের জন্য অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করার ব্যাপারে কতটা বিশ^স্ত ভূমিকা রেখেছে? তাদের কর্মীরা এবং অন্যরা প্রকাশ্যে পুলিশি হয়রানি, জেল-জুলুম ও অন্যান্য নির্যাতন সহ্য করেছেন এবং এখনো অনেকে কারাগারে বন্দীজীবন যাপন করছেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব ভুলভ্রান্তি হয়েছে এবং অঘটন ঘটেছে তা কেন্দ্রীয় নেতাদের হজম করতে দেখে দলীয় কর্মী ও স্থানীয় নেতারাও হতভম্ব।

পুলিশের সহযোগিতায় সরকারের পক্ষে ব্যালট বাক্স ভরে দেওয়া কোনো গোপন ব্যাপার ছিল না। ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে একটা শক্তিশালী বিরোধী ঐক্য রয়েছে তা মনেই হয়নি। যদিও এই ঐক্যের নেতৃত্বে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শাসনতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞ ও মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

আগে থেকেই নির্বাচনের ওপর সরকার ষোলআনা নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যাপারে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের কোনো ছাড় দেয়নি। তার পরও তারা কর্মীদের কোনো পরিষ্কার দিকনির্দেশনা দেয়নি এবং নির্বাচনী লড়াইয়ে থাকা প্রার্থীদের বলেনি সরকারের নির্বাচন বানচালের কারসাজি মোকাবিলা করার কৌশল কী হবে? ভোটারদের সাধারণভাবে ভোট দিতে আসতে বলা হয়েছে, কিন্তু তারা যাতে ভোট কেন্দ্রে না আসে তার জন্য সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা জেনেও না জানার ভাব করেছে। বরং ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের আত্মতুষ্টিতে ভুগতে দেখা গেছে। নির্বাচনী বিপর্যয় ঘটার পরও তারা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিংবা অর্থবহ প্রতিবাদ জানায়নি। তাদের হাবভাব দেখে মনে হয়েছে তারা কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। তাদের গোপন ব্যবস্থা গোপনই থেকে গেল, বাস্তবায়ন হয়নি। কার্যকর প্রতিবাদের অভাবে নির্বাচন গৃহীত হয়ে গেল।

ঘটনা কী ঘটল তা জানার জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরা ঢাকায় এসে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ব্যাখ্যা পর্যন্ত জানতে চাইলেন না। কোনো প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচনের বিভ্রাট সম্পর্কে জনগণকে অজ্ঞ রাখতে পারে না।

এখন নির্বাচনী রাজনীতি যে শেষ হয়ে গেল এর দায় কি নির্বাচনের ওপর জনগণের বিশ^াসহীনতা, না বিরোধীদলীয় নেতাদের আপসকামী দুর্বলতা ও সংগ্রামবিমুখতা? এ ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে, তা হলো পারিবারিক রাজনীতির দুর্বলতা। পরিবারের প্রধান বেগম খালেদা জিয়া নেই তাই দলের জীবনীশক্তিও নেই। এর নাম রাজনৈতিক দল নয়। বেগম জিয়াকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগের সুবিধাবাদী ব্যবস্থা।

দুজন শীর্ষ নেতা কাদের ওপর বিশ্বাস করে অন্য কোনো প্রার্থীর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই কেমন করে একসুরে বললেন যে, নির্বাচন সুুন্দর হয়েছে এবং তারা ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্ট। এ বিষয়টা একটি বড় ধরনের রহস্য হয়ে থাকবে। এত সহজে এবং এতটা দ্রুততায় নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তারা কেমন করে নিশ্চিত হলেন?

বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটি নির্বাচনী ফলাফল এবং অনির্বাচিত সংসদকে প্রত্যাখ্যান করে। তাই যে দু-চার জন বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন তারা কেউ অনির্বাচিত সংসদে যোগদান করতে পারবেন না বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু দ্রুত এ সিদ্ধান্ত বদলে যায় যখন তারেক রহমান লন্ডনে বসে ভিন্নতর সিদ্ধান্ত নেন। তাদের যে দু-চার জন নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তাদের অনির্বাচিত সংসদে যোগদান করতে অসুবিধা হয়নি।

আমাদের বিবেচনায় সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত, কারণ বাইরে তাদের নেতারা সরকারি নির্যাতনের ভয়ে প্রমাণ করেছেন যে তারা নির্বাচন ডাকাতির বিরুদ্ধে কোনো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারছেন না। তাই পার্লামেন্টে গেলে দলটি একেবারে মরে যাবে না। কিছুটা হলেও বিরোধী রাজনীতির অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারবে।

প্রশ্ন হলো, কোনো রাজনৈতিক দল যদি তার আগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তবে নিজস্ব কর্মী ও বৃহত্তর জনগণের কাছে তার একটা ব্যাখ্যা দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে সে রকম কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচিত হয়েও সংসদে যোগদান করলেন না, কিন্তু দলের মহাসচিব রইলেন। দলের মহাসচিব কেন এমন সংগতিবিহীন কাজটি করলেন তারও কোনো কারণ খুলে বললেন না।

আমাদের দেশে পারিবারিক রাজনীতি দলের সবাইকে রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ ও দায়িত্বের কথা ভুলিয়ে দিচ্ছে। একসময়ের গণতন্ত্রের পক্ষে সংগ্রামী আওয়ামী লীগ একই রোগে ভুগছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সেই আওয়ামী লীগ আর নেই। নির্বাচন না করে নির্বাচিত হওয়ার গণতন্ত্র তো আওয়ামী লীগের রাজনীতি হতে পারে না। ক্ষমতায় থাকতে পারলেই হলো। বিত্তশালী হওয়ার সুযোগ ছাড়া হবেই বা কেন। এসব কারণে সাধারণ মানুষ পারিবারিক রাজনীতির বিরুদ্ধে ভীষণ ক্ষুব্ধ এবং হতাশ। ঐক্যফ্রন্টে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তাদের কাছ থেকেও কোনো সাহসী ভূমিকা দেখছি না।

তাই এখন প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির নেতা-কর্মীদের দৃঢ়তার সঙ্গে ভাবতে হবে তারা কি বিদ্যমান রাজনৈতিক শূন্যতা ও জনগণের অসহায়ত্ব দূর করার জন্য বিএনপিকে একটি সত্যিকার রাজনৈতিক দল হিসেবে পুনর্গঠন করতে চান, না পারিবারিক নেতৃত্বের সেবা করে যাবেন। বেগম খালেদা জিয়ার শক্তিতে তারা বলীয়ান আর তার অনুপস্থিতিতে তারা কেউ কিছু নন। এটা তো প্রমাণিত হলো যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি জনগণের কোনো কাজে আসছে না। জনগণকে অসহায় হতেই সাহায্য করছে। পারিবারিক রাজনীতি কার্যত রাজনীতির উচ্চতর মহতী আদর্শকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। তাই আজ এ দেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ নেই। দুর্নীতিই রাজনীতি। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকসমূহে দুর্নীতিপরায়ণদের জমা টাকার পরিমাণ ইতিমধ্যে ৫ হাজার কোটি ছাড়িয়ে গেছে। দুঃখজনক হলো, এ টাকা তারা প্রয়োজনে ভোগ করতেও পারবেন না। কয়েক শতাব্দী আগে বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো রাজনৈতিক নেতৃত্ব সম্পর্কে একটা মূল্যবান কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, একজন রাজনৈতিক নেতার সততা ও দক্ষতা থাকতে হবে। আমাদের দলীয় রাজনীতিতে দক্ষতা ও সততা কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। নির্বাচনে বিজয়লাভসহ সরকার পরিচালনা সবই পুলিশ দিয়েই সম্ভব। শাসনতন্ত্রসম্মত সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো প্রচেষ্টা নেই। বড় ধরনের অপরাধ প্রকাশ পেলেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। আইনের নামে আইনের অপপ্রয়োগ নিয়েই সরকার বেশি ব্যস্ত। জামিন না পেলেই হলো। সরকার সমর্থকদের হাতে বিশ^জিৎ, মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত বা রিফাত শরীফের মতো অনেককেই নির্মমভাবে জীবন দিতে হচ্ছে। সবাইকে অসহায় করে রাখা হয়েছে। জনগণকে অসহায় রেখে সরকার সফল হতে পারে না। সরকারের সাফল্য থাকলে পুলিশ দিয়ে নির্বাচনে ‘জয়ী’ হতে হতো না। বিবেকহীন রাজনীতির নিষ্ঠুর পরিণতি চারদিকে দেখতে হচ্ছে। বিবেকবানদের পক্ষে বেঁচে থাকাই নিরর্থক মনে হচ্ছে।

      লেখক : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।

সর্বশেষ খবর