শিরোনাম
শনিবার, ৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভারতের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী?

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ভারতের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী?

১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়েছিল কলকাতায় এবং তাদের প্রথম কনফারেন্স হয়েছিল বম্বেতে। সেই জাতীয় কংগ্রেস ১৩৫ বছর পর বিজেপির ইচ্ছায় কি অবলুপ্ত হয়ে যাবে? সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ৩১ শতাংশ ভোট পেয়েও মাত্র ৫২টি আসন পেয়েছে। আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ্গ দলসহ হিন্দুত্ববাদীরা সারা দেশে  সোচ্চার হয়ে উঠেছে, কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়তে হবে। নির্বাচনে পরাজয়ের সব দায়-দায়িত্ব স্বীকার করে কংগ্রেস দলের সভাপতি রাহুল গান্ধী পদত্যাগ করেন। তিনি পদত্যাগপত্র পেশ করেছিলেন কংগ্রেসের নীতিনির্ধারক ওয়ার্কিং কমিটির সামনে। সারা দেশের কংগ্রেস নেতারা রাহুল গান্ধীকে পদত্যাগ না করার জন্য অনেক অনুরোধ করছেন। বিজেপি চাইছে চীনা ধাঁচে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা। ভারতের সংবিধানে বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থার কথা আছে, বিজেপির আরও বক্তব্য হলোÑ এক দেশ, এক জাতি, এক ভাষা ও এক ধর্ম। একই সঙ্গে সারা দেশের রাজ্যগুলোতে এক দিনে নির্বাচন। একই সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিলেন। বৈঠকে কংগ্রেসসহ বহু আঞ্চলিক দল উপস্থিত ছিল না।

এবারের নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির জন্য দায়ী ভোটাররা নয়, দায়ী প্রধানমন্ত্রীর পদের দাবিদার অতি লোভী উত্তরপ্রদেশের বহুজন সমাজবাদী দলের নেত্রী মায়াবতী এবং পশ্চিমবঙ্গের বঙ্গেশ্বরী মমতা ব্যানার্জি। দুজনই চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী হতে। উত্তরপ্রদেশের আরেকটি আঞ্চলিক দল সমাজবাদী দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছিলেন মায়াবতী। নির্বাচনে পরাজয়ের পর তিনি সমাজবাদী দলের সঙ্গে চিরদিনের জন্য সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে মমতা যে বিজেপিকে ডেকে এনেছিল, তাদের হাতেই পরাস্ত হয়েছে। ভারতের নির্বাচন বিশেষজ্ঞ যোগেন্দ্র যাদব একটি টিভি চ্যানেলে বলেছেন, বিজেপি তথা গেরুয়াবাহিনী মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। ভারতে কোনো দিনই একদলীয় শাসন ব্যবস্থা হতে পারে না। দক্ষিণ-ভারতে বিশেষ করে অন্ধ্র, তেলেঙ্গা, তামিলনাড়ু, কেরল এবং পন্ডিচেরি হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পড়েছে। কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। যোগেন্দ্র যাদব আরও বলেছেন, ভারতের সংবিধান আছে, ভারতের ২৭টি রাজ্যের ‘নানা ভাষা নানা মত’ আছে। সুতরাং একদলীয় শাসন ব্যবস্থা অলীক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। কয়েক দিন আগে লোকসভায় দাঁড়িয়ে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদিকে একই সূত্রে গেঁথেছেন এক অর্ধশিক্ষিত মন্ত্রী। তার বক্তব্য হলোÑ স্বামীজির ডাক নাম নরেন্দ্র আর তাদের নেতার নামও হলো নরেন্দ্র। সুতরাং দুজনের খুব মিল আছে, প্রধানমন্ত্রী তখন সংসদে উপস্থিত ছিলেন কিন্তু তিনি প্রতিবাদ করেননি। এমনকি স্পিকার বিড়লা তার বক্তব্য রেকর্ড থেকে মুছে দেননি, তা সংসদের রেকর্ডে নথিভুক্ত হয়ে আছে।

এবারের নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, আঞ্চলিক দলগুলোই বিজেপিকে ক্ষমতায় রাখার জন্য নানাভাবে সাহায্য ও কৌশল করেছে, যেমন তেলেঙ্গার মুখ্যমন্ত্রী কেশিয়ার রাও, অন্ধ্রের সম্প্রতি জেলে যাওয়া মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু মমতার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে বারবার ছুটে এসেছে কলকাতায়। মমতার সঙ্গে সলাপরামর্শ করেছেন এবং মমতার দাবি মেনে নিয়ে তাকেই প্রধানমন্ত্রী পদে বসাতে চেয়েছিলেন। মমতা ও মায়াবতীর বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। বিজেপি তাদের আগেই সতর্ক করে দিয়ে বলেছেÑ খবরদার, তোমরা যদি কংগ্রেসকে সমর্থন কর তবে তোমাদের জেলে যেতে হবে। মুখে মমতা ও মায়াবতী যাই বলুন না কেন- তারা বিজেপির হয়েই কাজ করেছেন নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য এবং এখনো তা করে চলেছেন। তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের সংসদে দেওয়া একটি উক্তি শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সর্ব ভারতকে উদ্বেগের মধ্যে ফেলেছে। তার বক্তব্য ছিল বিজেপি সভাপতি তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যদি পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে নানাভাবে হেনস্থার পথ থেকে সরে আসে তাহলে তৃণমূল নেত্রী ও তার দল মোদিকে সর্ব ক্ষেত্রে সমর্থন করবে। রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে-  তাহলে কি সৌগতের মাধ্যমে মমতা বিজেপিকে নতুন করে বার্তা দিলেন?

ক্ষমতায় থাকার জন্য মমতাদেবী যা খুশি তাই করতে পারেন এবং তা করেও আসছেন, তার একমাত্র ধ্যান ও জ্ঞান পশ্চিমবঙ্গ থেকে কংগ্রেসকে মুছে দেওয়া। এ ব্যাপারে বিজেপির সঙ্গে তার কোনো পার্থক্য নেই, আর এটাই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহলের দৃঢ় ধারণা। স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদিকে এক আসনে বসানো নিয়ে কংগ্রেস প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে কিন্তু মমতা নিশ্চুপ। বিজেপির ওই অর্ধশিক্ষিত মন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের একাধিক স্বামীজির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। নাম বলতে অনিচ্ছুক তারা বললেনÑ আমরা রাজনীতি করি না, আমরা বিবেকানন্দের আদর্শ প্রচার করি। স্বামীজি ছিলেন সব ধর্মের ঊর্ধ্বে। ওই অর্ধশিক্ষিত মন্ত্রীর স্বামীজির লেখা পড়া উচিত ছিল। স্বামীজির ওপর পড়াশোনা না থাকার ফলে এরূপ মন্তব্য তিনি করে বসেছেন।

এবার দেখা যাক, ভারতের বহুদলীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী? সংবিধান সংশোধন না করে গেরুয়াবাহিনী কি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা করতে পারবে? সারা দেশ এখন অপেক্ষা করছে- রাহুল গান্ধীর পরিবর্তে কে কংগ্রেস দলের সভাপতি বা সভানেত্রী হবেন? কংগ্রেস দলকে পুনরুজ্জীবিত করে বিজেপি তথা গেরুয়াবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামাই হলো প্রথম কথা। আর এই প্রতিবাদের মূল উদ্দেশ্য হবে- বিজেপি ও গেরুয়াবাহিনী গত পাঁচ বছরে মানুষের কোনো প্রয়োজনই মেটাতে পারেনি। ভয়াবহ বেকার সমস্যার জন্ম দিয়েছে। এসবের উত্তর বা সমাধানের পথ দেখানোর দায়িত্ব নিতে হবে দ্বিতীয়বার জিতে আসা মোদি সরকারকে। মোদি সরকার উন্নয়নের পথ ছেড়ে কংগ্রেসকে আক্রমণের পথই বেছে নিয়েছে। যেমন- নির্বাচনী প্রচারে নিয়েছিল। এখন ভারতের সামনে ভয়াবহ আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। ভোটের প্রচারে বিজেপি সামরিক বাহিনীকে কদর্যভাবে ব্যবহার করেছে। যার পরিণাম কোন পথে দেশকে নিয়ে যাবে- শুধু কি সামরিক বাহিনীতে গেরুয়াধারীদের চাকরি দিলেই হবে। গত পাঁচ বছরে মোদির প্রথম জামানায় হিন্দি বলয়ে মহারাষ্ট্র, গুজরাটসহ বহু রাজ্যের লাখ লাখ গেরুয়া ক্যাডারকে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ করা হয়েছে। কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সূর্যওয়ালা অভিযোগ করেছে, ওই নিয়োগ নিয়ে তাদের কাছে বহু তথ্য এসেছে। সময়মতো তারা সেই তথ্য ফাঁস করে দেবেন। এ ধরনের নিয়োগ যে হিতে বিপরীত হতে পারে সেই আশঙ্কা শুধু কংগ্রেস মহলেই নয়, সারা দেশে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশে যেমন বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন জনগণের উন্নয়নে প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছে, ভারতেও গান্ধী পরিবার ছাড়া অন্য কোনো দলের পক্ষে উন্নয়ন করা সম্ভব নয়, অন্তত অভিজ্ঞতা তাই বলছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধ করে দেশকে পাকিস্তানমুক্ত করেছেন আর গান্ধী, নেহরু, আবুল কালাম আজাদ ভারতকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করেছিলেন। ভারতকে হয়তো আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে নতুন কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্বভার কে নেন? এবং তা করা উচিত দ্রুততার সঙ্গে কারণ বিজেপির নানা কান্ডে সামনে নানা ইস্যু এসে গেছে। এই ইস্যুগুলো নিয়ে কংগ্রেসের রাস্তায় নামার জন্য দেশবাসী অপেক্ষা করছে। উল্লেখ্য, ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গসহ সব আঞ্চলিক দল তৈরি হয়েছে কংগ্রেস ভেঙে গিয়ে।  অনেকে মনে করছেন নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেও দলের চাপের কাছে হয়তো রাহুল গান্ধী তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারেন। কারণ বছর শেষে মহারাষ্ট্র, ঝাড়খন্ড এবং হরিয়ানায় বিধানসভা নির্বাচন।

লেখক : ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর