শনিবার, ৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

অবসর সময়ে কৃষিতে ব্যস্ত শামসুল আলম

শাইখ সিরাজ

অবসর সময়ে কৃষিতে ব্যস্ত শামসুল আলম

টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার মধুরচালা এলাকার শামসুল আলম। ব্যাংকের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ফিরে এসেছেন নিজ গ্রামে, মাটির কাছে। আর এখন কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়ে অবসর জীবনকে ভরে তুলেছেন ফল-ফসলে। কৃষি তার সারা জীবন ধরে বুকের ভিতর লালিত স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে অবসর সময়টা ঢেলে দিয়েছেন ফসলের মাঠে। মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে ফলানো ফল-ফসলের মাঠ হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক এক ক্ষেত্র। তিনি প্রমাণ করেছেন বুদ্ধি আর প্রাণ লাগিয়ে কৃষি করলে মাটি কখনো বিমুখ করে না। ঠিকই সোনার ফসল তুলে দেয় কৃষকের হাতে। তবে, বাণিজ্যিক লাভ পেতে কৃষিকে শুধু মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেই হবে না, হতে হবে একটু কৌশলী, বুঝতে হবে কৃষি বাজার। যেমনটা করেছেন শামসুল আলম। এক সময় ঘাটাইল উপজেলার এ এলাকাটা ছিল আনারস চাষের জন্য প্রসিদ্ধ। দেখেছি মাঠের পর মাঠজুড়ে শুধু আনারস আর আনারস। আনারসই ছিল এ এলাকার জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির মূল। পাহাড়ি এ অঞ্চলের মূল সমস্যা ছিল সেচ। সেচের পানি তো দূরে থাক, টিউবওয়েলে খাবার পানিই মিলত না। পুকুর, নদী, খালের পানিই ফুটিয়ে পান করত এলাকাবাসী। ছোট ছোট ঢিবি কিছুটা সমতল তারপর আবার ঢিবি। এ রকম বন্ধুর ভূমিতে চাষাবাদও ছিল বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। আনারস ছাড়া আর কোনো ফসল চাষের সুযোগ ছিল না। মনে পড়ে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় টাঙ্গাইলে জার্মান সহযোগিতা সংস্থার সহায়তায় একটা প্রকল্প শুরু হয়। প্রকল্পটির নাম ‘টাঙ্গাইল কৃষি উন্নয়ন কর্মসূচি’, সংক্ষেপে টিএডিপি। প্রকল্পের উদ্দেশ্য এলাকায় ফসল বৈচিত্র্য আনা। আর ফসল বৈচিত্র্য আনতে গেলে প্রয়োজন সেচ সুবিধা। আর সেটাকে সম্প্রসারণ করতেই তারা শুরু করে বারিড পাইপ ইরিগেশন। এটি ছিল সে সময়ের বেশ ব্যয়বহুল সেচপদ্ধতি। যেহেতু ওই এলাকার জমি উঁচু-নিচু, বন্ধুর তাই ভূগর্ভস্থ পানি মাটির নিচ দিয়ে পাইপ দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে এ এলাকায় কৃষি ফসলের বহুমুখীকরণ শুরু হয়। এ প্রকল্পটির পরিচালক ছিলেন তরুণ জার্মান আন্দ্রিয়াস ফালক এবং প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন বাংলাদেশের আর এক তরুণ সেলিম। এ প্রকল্প বিষয়ে বিটিভির মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে এ দুই তরুণের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। যাইহোক, তখন আমি লক্ষ্য করেছি এই বারিড পাইপ ইরিগেশন কীভাবে একটি এলাকাকে সবুজ করে তুলেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় টাঙ্গাইলের এ এলাকায় ফসল বৈচিত্র্য এসেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সে সময় ঘাটাইল যাওয়াটাও ছিল দুষ্কর। কালিয়াকৈর পেরিয়ে হাঁটুভাঙ্গা নদী পার হয়ে যেতে হতো। হাঁটুভাঙ্গা নদীতে তখন ছোট্ট একটা ফেরি ছিল। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে, এলাকার কৃষিচিত্র আমূল পাল্টে গেছে। জমিতে চাষ করছেন নানা রকম উচ্চমূল্যের ফল-ফসল। গ্রামের পথ দিয়ে চলতে চলতে চোখে পড়ে বিশাল সব লেবুর বাগান। মনে পড়ছে একসময় লেবু চাষের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল সিলেটের জৈন্তাপুর পাহাড়। সেখান থেকে লেবু চাষ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। লেবুও হয়ে উঠেছে এক অর্থকরী ফসল। লেবু ছাড়াও ড্রাগন, পেয়ারা, আম, মাল্টা নানারকম ফলের চাষ হচ্ছে। অনেক কৃষক এক ফসলের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনেছেন। ফলে চাষবাসের এ বহুমুখিতা  তাদের আর্থিক সমৃদ্ধিও নিশ্চিত করছে। বলছিলাম শামসুল আলমের কথা। তিনিও ৬০ একর জমিতে লেবু, পেয়ারা, ড্রাগন ফল চাষ করে অবসর জীবনকেও অর্থময় করে তুলেছেন।

শামসুল আলমকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনি তো জীবনের দীর্ঘ সময় ব্যাংকে চাকরি করেছেন, অবসরে যাওয়ার আগেও বেশ দায়িত্বপূর্ণ একটি পদে ছিলেন। কর্মসূত্রেই আপনাকে সারা জীবন কাটাতে হয়েছে শহর থেকে শহরে এক নাগরিক জীবন। গ্রামের প্রতি এ টানটা কখন জন্মাল? আর আপনি কৃষির সঙ্গেই যুক্ত হলেন কেন?’

উত্তরে শামসুল আলম বলেছিলেন, ‘আমার নাড়িপোঁতা আছে এ গ্রামে। এখানেই জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি। যেখানেই থেকেছি এ গ্রামের পাট-ধানের ঘ্রাণ আমাকে টেনেছে। এখানে ফেরার তাগিদ অনুভব করেছি সবসময়। আর অবসর নিয়ে আমার অন্যরকম একটা চিন্তা আছে। আমি মনে করি, মানুষের শরীর ও মস্তিষ্ক যতক্ষণ সুস্থ ও সচল, ততক্ষণ তার আসলে কোনো অবসর নেই। আমি আগে একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, দায়িত্বের সঙ্গে সেই কাজ সম্পন্ন করেছি। শৈশব থেকেই বুকে লালন করেছি কৃষিকাজকে। তাই এখন এসে যুক্ত হয়েছি এ কাজে। কাজ সব সময়ই আমার কাছে সমান গুরুত্বের।’ শামসুল আলম বলছিলেন তার কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার গল্প। বলছিলেন, কীভাবে ধীরে ধীরে তিনি গড়ে তুলেছেন তার বাণিজ্যিক কৃষিখামার : ‘কৃষির প্রতি টান থেকেই গ্রামে ফিরে এসে চাষবাস শুরু করলাম। দেখলাম একজন কৃষক এক বিঘা জমি চাষ করে পাঁচ হাজার টাকাও লাভ পায় না। অথচ খাটা-খাটনি তার অন্য কোনো পেশা থেকে কম নয়, বরং বেশিই। তাই চিন্তা করছিলাম, কী ফসল চাষ করলে একই জমি থেকে বেশি অর্থ পাওয়া সম্ভব। একটা জমিতে সার-বীজ-সেচই বিনিয়োগ করছি না, বিনিয়োগ করছি সবচেয়ে মূল্যবান সময়। তাই একই সময়ের ভিতর কোন ফসলের চাষ আমাকে ফলন বেশি দেবে, পাশাপাশি ওটা থেকে লাভ কতটুকু হবে সেটার একটা তুলনামূলক হিসাব আমি করে নিয়েছি চাষের পূর্বেই। দেখলাম যে এ হিসাব খুব কাজে দিয়েছে।’

শামসুল আলম জানেন কীভাবে শুরু করতে হয়। বিন্দু থেকেই যে সিন্ধুর সৃষ্টি শামসুল আলম তা ধারণ করে আছেন জীবনের আদর্শে। তাই প্রথমেই বিশাল কিছু দিয়ে শুরু করেননি। শুরু করেছেন একেবারেই ছোট পরিসরে। প্রথমে ২০১৪ সালে মাত্র বিঘা চারেক জমিতে শুরু করেন লেবু চাষ। পাঁচ বছরে সেই চাষবাস ছড়িয়েছে ৬০ একর জমির বিশাল পরিসরে। এর মাঝে বেশির ভাগ জমিই তার লিজ নেওয়া। ৪০ একর জমিতে করছেন নানান জাতের লেবু চাষ। বাকি জমিতে পেয়ারা, ড্রাগন, পেঁপে ছাড়াও রয়েছে হাঁস-মুরগির খামার। বেশ কিছু তিতিরও দেখলাম তার বাগানে চড়ে বেড়াতে।

শামসুল আলম বলছিলেন, ‘যত্ন ছাড়া রত্ন মেলে না। বাগানের প্রতিটা গাছকেই সমান যতœ দিতে হয়। একেকটা লেবু গাছ থেকে বছরে ১০০০ থেকে ৩০০০ লেবু পাওয়া যায়। এ ফলন পেতে হলে গাছকেও ঠিকমতো পরিচর্চা দিতে হবে। গাছ লাগিয়েই ফল আশা করলে হবে না, ফলের জন্য গাছের সেবাও করতে হবে প্রয়োজন মতো।’

মনে পড়ছে এ অঞ্চলেরই আর এক কৃষক আবদুল আজিজের কথা। যিনি তার বাড়ির আশপাশের জমিতে গড়ে তুলেছেন নানা জাতের ফলের বাগান। আর সেখান থেকে তৈরি করে নিয়েছিলেন নিশ্চিত আয়ের ব্যবস্থাও। শামসুল আলমও সেরকমই। লাভের হিসাবটা খুব স্পষ্ট। বাগান থেকেই প্রতি পিস লেবু বিক্রি করছেন ৪ টাকা দরে। বছর শেষে লেবু থেকে আয় দাঁড়াচ্ছে ২২ লাখ টাকা। আয়ের বিষয়টি নিয়ে শামসুল আলম বললেন, ‘এক বিঘা জমি থেকে কোনো কোনো কৃষক ৫ হাজার টাকাও লাভ পায় না। আমি পাচ্ছি লাখ টাকা। এক লাখ টাকার লেবু বিক্রি করলে চারা, সার, সেচ ও শ্রমিক খরচ ৩০ হাজার টাকা বাদে বাকি ৭০ হাজার টাকাই আমার লাভ থাকে, অর্থাৎ লাভ ৭০ পার্সেন্ট।’

সত্যিই, শামসুল আলম সাহেবের অঙ্ককষা কৃষি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এমনটাই হওয়া উচিত। পরম্পরায় বছরের পর বছর শুধু ধান চাষ করে গেলেই কৃষিতে সাফল্য আসবে না। বর্তমানের কৃষি অনেক হিসাব-নিকাশের। চাষের আগেই হিসাব করে নিতে হবে লাভ-ক্ষতির। এ হিসাব হয়তো সব সময়ই লাভের হবে না। সব উদ্যোগেই ব্যর্থতা আসতে পারে। ব্যর্থতাকে উতরে গিয়ে সাফল্যকে ছিনিয়ে আনাই সফল উদ্যোক্তার কাজ। আর সফল ব্যক্তিদের সাফল্যের পেছনে থাকে শক্ত মনোবল। যেমনটা আছে শামসুল আলমের। তিনি ৩০-৪০টি পিলারে ড্রাগন ফল চাষ করে প্রথম বছর পেলেন ৩০-৪০ কেজি ড্রাগন। খেয়ে-বিলিয়েও ড্রাগন বিক্রি করে দেখলেন এ ফল চাষ বেশ লাভজনক। পরের বছর ১৮০টি খুঁটিতে ড্রাগন চাষ করে বিক্রি করতে পারলেন ২ লাখ টাকার মতো। এবার লেবুর পাশাপাশি তার নজর ফিরল ড্রাগনের দিকে। প্রতিটি গাছের যতœ নিলেন। আর তাতেই গত বছর ১৮০টি খুঁটি থেকে পেলেন ৫ লাখ টাকার ফলন। এবার আরও ২৫০টি খুঁটি যুক্ত করেছেন।

কৃষি অন্তপ্রাণ শামসুল আলমের লাভের হিসাবটা টাকায় হলেও, সবচেয়ে বড় লাভ হচ্ছে তার কর্মময় জীবন। এ কর্মব্যস্ততা অক্ষুণ্ন রেখেছে শারীরিক সুস্থতা। ফল-ফসলের সান্নিধ্য দিচ্ছে মানসিক প্রশান্তি। কৃষি নিয়ে চিন্তাভাবনায় মগ্ন শামসুল আলমের নেই দু-দন্ড অবসর। তার জীবনের অবসর সময়ের এ অবসরহীনতাই তাকে সচল রেখেছে আশ্চর্য গতিময়তায়।

কৃষিতে সাফল্য যেমন আছে, তেমনই আছে ব্যর্থতার গভীর  শঙ্কা। কৃষি চুলচেরা হিসাবের একটি খাত- সেটা মাথায় রেখে বুঝেশুনেই করতে হবে চাষাবাদ। তবেই সাফল্য আসবে। কৃষি বরাবরই সম্ভাবনাময় একটি খাত। এখানে জেনেবুঝে বিনিয়োগে ক্ষতি নেই। বেকার তরুণরা হতাশ না হয়ে ধৈর্য নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে কৃষির কোনো খাতে মেধা ও শ্রম বিনিয়োগ করলে সাফল্য আসবেই। আর তাদের সাফল্যেই বেগবান হবে দেশের অর্থনীতি।  পাল্টে যাবে আমাদের সমাজচিত্র। এমনটাই প্রত্যাশা আমার।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর