শনিবার, ৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা
মতামত

নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সামগ্রিক উদ্যোগ

অমিয় সৃজন সাম্য

গত ঈদের সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ৭২ ঘণ্টায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২২ জন। এ ছাড়াও গণমাধ্যমে প্রকাশিত অন্যান্য খবর অনুযায়ী, গত সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২০ জন। এ সময়ে আহত হয়েছেন প্রায় ৬৩ হাজার জন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক গবেষণা অনুসারে এসব দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশ ঘটেছে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও অতিরিক্ত গতির কারণে। এ ছাড়াও, আরেকটি মূল কারণ যানজটের নির্ঘুম অবস্থায় দীর্ঘসময় ধরে যানবাহন চালনা ও বিপরীত থেকে আসা গাড়ির আলোয় দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যাওয়া ও চোখের নানা সমস্যা দেখা দেওয়া।

আর এসব সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তির বেশির ভাগই শিশু, তরুণ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি। এই দুই শ্রেণিকে দেশের ভবিষ্যৎ ও অর্থনীতির মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ শুধু সড়ক দুর্ঘটনার কারণে দেশ মোট জিডিপির ২-৩ শতাংশ হারাচ্ছে।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দরকার সবার একসঙ্গে কাজ করা। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে বেসরকারি ও সরকারি সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে হবে। যেমন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) চালকদের সচেতনতা তৈরিতে নানা ধরনের কর্মশালা আয়োজন করে যাচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশের দ্রুতবর্ধনশীল স্টার্টআপ ‘সহজ’। এর মধ্যে রয়েছে গত এপ্রিলে ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনালের (জেসিআই) সঙ্গে আয়োজিত বিনামূল্যে চক্ষুচিকিৎসা ক্যাম্প।

এই আয়োজনে প্রায় এক হাজার চালককে বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা সুবিধা লাভ করে। এই আয়োজনে শুধু যে ক্যাম্প থেকে চক্ষু চিকিৎসা আয়োজন করা হয় এমনটি নয়, বরং জটিলতর সমস্যার ক্ষেত্রে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা পাবে এই চালকরা।

এ আয়োজনে অংশ নেওয়া বাস চালক জয়নাল হোসেন জানালেন, প্রতি ট্রিপে তারা গড়ে ১২ ঘণ্টার বেশি ডিউটি পালন করেন। তিনিসহ তার পরিচিত অধিকাংশ চালকই কোনো না কোনো চক্ষু সমস্যায় আক্রান্ত।

তবে সচেতনতা ও টানা গাড়ি চালানোর কারণে অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না চক্ষু পরীক্ষা করে চোখের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে

জানা কিংবা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেওয়া। যেহেতু টার্মিনালে বসেই এ ধরনের সুবিধা পাওয়া গেছে, তাই ব্যক্তিগতভাবে তিনি এবং তার পরিচিত বহু চালক চিকিৎসা পাওয়ার পাশাপাশি অন্তত জানতে পারছেন চোখের অবস্থা নিয়ে।

‘সহজ’ বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের সহায়তায় চালকদের জন্য আয়োজন করে ‘সুরক্ষা’ শিরোনামে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।

চালকদের অধিকতর প্রশিক্ষিত করে তুলতে দেশে প্রথমবারের মতো কোনো রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। ইউরোপ ও এশিয়াজুড়ে ৩০ বছরের অধিক সময়জুড়ে নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করে চলা ইন্দো-অস্ট্রিয়ান প্রতিষ্ঠান হুবার্ট ইবনার এর প্রণীত ড্রাইভিং ট্রেনিং ম্যানুয়াল অনুসারে ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুলে আয়োজন করা হয় এই বিশেষ প্রশিক্ষণের। এই কর্মসূচির আওতায় মোটরসাইকেল চালকদের নিরাপদ গতিসীমা, অন্যান্য গাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা ও রক্ষণশীল চালনার বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশে রাইড শেয়ারিং সেবার শুরু থেকেই এই পেশায় যুক্ত হওয়া একজন চালক নজরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘ঢাকার মোটরসাইকেল চালনায় সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা ঝুঁকি অতিরিক্ত গতি আর নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রেখে চালানো। বিশেষ করে ফ্লাইওভারগুলো থেকে নামবার সময় নিরাপদ সীমার বাইরের গতি অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটানোর কারণে পরিণত হয়।

তবে প্রথমবারের মতো ‘সহজ’ আয়োজিত এমন একটি প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর থেকে এখন নিজের মাঝেই অনেক পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে সবাইকে ছাড়িয়ে আগে যাওয়ার প্রবণতা অনেকটাই কমে এসেছে।’

ব্র্যাক ও সহজের মতো অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে সড়কে সুরক্ষা নিশ্চিতে। ব্যক্তিপর্যায় থেকে যেমন পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব সবাইকে সচেতনতা নিয়ে জানাতে হবে, তেমনি সরকারি-বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও আয়োজন করতে হবে নানা কর্মসূচি। শুধু চালকদের নয়, কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে হবে পদচারীদেরও। কেননা সড়কে দুর্ঘটনা এড়াতে সবাইকে দায়বদ্ধ হতে হবে এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। 

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক।

সর্বশেষ খবর