বরগুনার রিফাত হত্যা বাংলাদেশের বিবেক নাড়া দিয়েছে। ‘বিভীষিকাময়’ এই হত্যাযজ্ঞের বিচারের জন্য ফুঁসে উঠেছে বাংলাদেশ। সবার দৃষ্টি ছিল বরগুনার পুলিশ প্রশাসনের দিকে, কখন নয়ন বন্ডসহ সব অপরাধী গ্রেফতার হবে এই প্রত্যাশায়। অবশেষে জাতিকে হতবাক করা উপহার দিল জেলা পুলিশ প্রশাসন। নয়ন পুলিশি হেফাজতে এলো- তবে জীবিত নয় মৃত। অনেকে বললেন, যেমন কর্ম তেমন ফল। সামাজিক মাধ্যমে দেখেছি রক্তাক্ত এক তরতাজা তরুণের লাশ। প্রায় সমবয়সী তরুণ রিফাতের লাশকে জাতি সহজে গ্রহণ করতে পারেনি, শোকার্ত হৃদয়ে ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চিরবিদায় দিয়েছে রিফাতকে। তেমনি একবুক ঘৃণা ছুড়ে দিয়ে নয়ন বন্ডকে বিদায় জানিয়েছেন সবাই। তরুণদের এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। রিফাতকে হত্যা করা হয়েছে প্রকাশ্যে, নির্মমভাবে কুপিয়ে। তরুণী স্ত্রী মিন্নি স্বামীকে বাঁচাতে খুনিদের নিরস্ত করার চেষ্টা করেছেন কোনো কাজ হয়নি। তার আর্তচিৎকারে কেউ এগিয়ে আসেনি। এলাকাবাসী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখার দৃশ্যের কাছে রিফাত পরাজিত হয়েছে। আজও এই সমাজের কিছু স্বার্থান্বেষী ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিতে স্বামীর ওপর ভয়ঙ্কর হামলাকারীর বিরুদ্ধে জীবন বাজি রাখা লড়াকু এক নারীর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।
ভিডিও ধারণ করা ফুটেজে সন্ত্রাসীদের নির্মমতা আমি বারবার দেখেছি। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা একজন গৃহবধূর পক্ষে কতটা চ্যালেঞ্জ তা ভুক্তিভোগীই জানেন। ফেসবুকে অনেকে পোস্ট ও মন্তব্য পড়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বোঝাতে চেয়েছেন যে, মিন্নি নয়নের সাবেক স্ত্রী ও বর্তমান গার্লফ্রেন্ড। নয়নের সঙ্গে তার অনেক ক্লোজ ছবি-টবি আছে। অতএব সে বাজে একটা মেয়ে। আমার প্রশ্ন, মিন্নি যদি রিফাতকে ছেড়ে ঘাতক নয়নের সঙ্গেই সম্পর্ক করতে চাইবে তবে প্রকাশ্য দিবালোকে রিফাতকে এমন নির্মম আর নিষ্ঠুরভাবে চোখের সামনে হত্যা করতে সহযোগিতা করবে কেন? ধরেই নিই মিন্নি নয়ন বন্ডের সাবেক স্ত্রী আর সেখানে ছবি থাকাটা কোনো দোষের মধ্যেই পড়ে না। তা হলে ভাবতে হবে মিন্নি নয়নকে বিদায় করে রিফাতকে বিয়ে করেছে। একজন বখাটে মানুষকে বিদায় করা কি অপরাধ? অপপ্রচারকারীদের কাছে আমার প্রশ্ন, এই মুহূর্তে সর্বাগ্রে আপনারা কি মিন্নির বিচার দাবি করেন নাকি রিফাত হত্যায় জড়িত সব অপরাধীর বিচার? দুটো একসঙ্গে করলে আমরা বরগুনাবাসী প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাই। একটা বেছে নিন, অপরাধকে অপরাধ বলুন, আপনারা এমন কোনো কথা বলবেন না, যাতে পরোক্ষভাবে অপরাধীর সপক্ষে সমর্থন হয়ে দাঁড়ায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন আশা করি। আমার জেলা একটু রিজনেবল। এখানে নৈতিকতার মানদন্ড রয়েছে। এখানে সবাই সবার সুখে-দুঃখে অংশীদার হয়। ধার করে আসা একজন নয়নের জন্য এই সুনামকে কলঙ্কিত করবেন না। আমাদের সমাজব্যবস্থার কিছু মানুষ হিংস্র হয়ে যাচ্ছে। জঘন্য, নির্মম, নিষ্ঠুর কোনো ঘটনার সৃষ্টি হলে তার নেপথ্য খোঁজে না। পাপকে ঘৃণা না করে পাপীকে ঘৃণা করে। অপরাধীরা সব সময় প্রশ্রয়দাতাদের আশ্রয় নেয়। সেখানে নিজেদের বন্ড তৈরি করতেই মরিয়া হয়ে ওঠে। এখন আর মানবিকতা নেই। শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ব্যবধান নেই। আমরা কি ভেবে দেখেছি, আমাদের নৈতিক শিক্ষাগুলো থেকে আমরা কতটা দূরে সরে যাচ্ছি! এই নয়ন বন্ডের নামে অসংখ্য মামলা রয়েছে। জামিন পাওয়া নাগরিক অধিকার। তাই বলে কেন তাদের মতো অপরাধী জামিন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বছরের পর বছর ঘুরে বেড়ায়! মামলার বিচারে অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে অপরাধী বলা যায় না। মামলার দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি হলে অপরাধীরা সাজা পায়। অন্যরা ভয় পায়। তা না হলে বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের কাছে অনায়াসে ঠাঁই করে নেয় নিজেদের নির্দোষ দাবি করে! আমরা জানি একটি অপরাধের বিচার না হলে সমাজে আর একটি অপরাধের সৃষ্টি হয়।
মনে পড়ে, ছোটবেলা যখন খাবার টেবিলে সবার সঙ্গে খাবার খেতাম তখন বাবা-মা, আর পরিবারের সিনিয়ররা পাশের বাড়ির সামান্য বখাটে ছেলেমেয়ের কথা যখন আলোচনা করতেন তখনই বুঝতে পারতাম ভালো আর মন্দের ব্যবধান। বাড়ি থেকে বের হলে প্রতিবেশী/বয়স্ক সিনিয়রদের দেখে ভয় পেতাম কারণ তারাও নজর রাখতেন সবার প্রতি। আর এখন গুরুজনরা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের শাসনের এখতিয়ার রাখেন না। পড়ার টেবিলে প্রতিযোগিতা দিয়ে পড়ার আনন্দ এখন আর নেই বললেই চলে। পড়ার টেবিল এখন ইন্টারনেটে। খাবার টেবিল এখন শূন্য হাহাকার। পরিবারের কাউন্সিলিং এখন ফেসবুকের লাইক কমেন্টসে। বাবা-মা এখন সন্তানের প্রতি খুব বেশি উদাসীন, স্বপ্নহীন। নীড়ের পাখি সন্ধ্যায় নীড়ে ফিরে অথচ ঘরে ফিরে না ঘরের পাখিরা। মাদক ব্যবসা ও মাদকাসক্তি আঠার মতো ঘিরে রেখেছে প্রিয় দেশকে। অর্থলোভী মানুষের কাছে দেশপ্রেম আজ উধাও। নৈতিক শিক্ষার জায়গাগুলো বিলুপ্তির পথে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবনতি ঘটেছে চরমভাবে। নাটক, সিনেমায় নেমেছে ধস। সেখানে শেখার মতো কোনো কিছুই নেই। আগে স্কুল-কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। জানুয়ারি মাসে দিনব্যাপী জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন ক্রীড়া-সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হতো। মাসজুড়ে ছিল প্রতিযোগিতায় জিতবার জন্য প্রাকটিস। আজ আর এসব নেই। এখন শিক্ষার্থীর হাতে অফুরন্ত সময়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই পড়ার তাগিদ। নৈতিক শিক্ষার চরম অবক্ষয় ঘটেছে। পরিবারে ফিরে আসুক মুগ্ধকর পরিবেশ। পরিবার থেকে সুশিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষা নিয়ে গড়ে উঠুক সুনাগরিক হিসেবে, সোনার বাংলার সোনার সন্তানরা স্বপ্ন নিয়ে ছুটবে যোজন যোজন মাইল দূরে সেই প্রত্যাশা রইল।
লেখক : নারী ও শিশু অধিকার কর্মী।